SAHA ANTAR

Published:
2023-02-13 22:58:24 BdST

মহামানবের মন :যে কারণে নিয়মিত পচা মাছ আনতেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়



সংবাদ সংস্থা
_________________


নিয়মিত পচা মাছ আনতেন। তা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলাও হত। শুধু বলতেন, ওঁর (যাঁর কাছ থেকে মাছ কিনেছেন) বউনি হচ্ছিল না। তাই এনেছি। না হলে ওঁদের চলবে কী করে। মানুষের সঙ্গে এই সহজ সম্পর্ক ঘুরে-ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়, কবিতায়। সক্রিয় বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পার্টি করেছেন দীর্ঘ বছর।
তিনি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় | একাধিক বার জেলে গিয়েছেন তিনি। স্বাধীনতার পরে এ রকম সৌভাগ্য কোনও বাঙালি কবির কপালে আর জোটেনি। ‘টোটো কম্পানি’তে লিখছেন, ‘‘যখন জেলে গেলাম, মনে হল সেও এক ভ্রমণ… দড়িচালী থেকে ঘানিঘর ঘুরে ঘুরে দেখা। মানুষগুলো প্রত্যেকেই যেন রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের বই। পড়ে শেষ করা যায় না। মামলা থাকলে জাল দেওয়া গাড়িতে রাস্তা দেখতে দেখতে কোর্টে পৌঁছনো। ভ্রমণ বৈকি। রীতিমতো ভ্রমণ। তার ওপর আছে এক জেল থেকে অন্য জেলে যাওয়া। শুনলে অনেকে হিংসে করবে। জেলে থাকার সুবাদেই আমার জীবনে প্রথম এরোপ্লেন চড়া।’’ হাজতবাসকে এত সহজ করে নিতে পারে কেউ? যে সব তরুণ কবি আজকাল কথায় কথায় ডিপ্রেশনে চলে যান, তাঁরা তাঁর জেলজীবন পড়ে দেখলে তাঁদের আর ঘুমের বড়ি খেতে হবে না।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে ।পিতা ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন সরকারি আবগারি বিভাগের কর্মচারী | মা ছিলেন যামিনী দেবী | নিজের বাল্যকাল সম্পর্কে এক চিঠিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমার শৈশব কেটেছে রাজশাহীর নওগাঁয়। বাবা ছিলেন আবগারির দারোগা। নওগাঁ শহর ছিল চাকরি, ব্যবসা, নানা বৃত্তিতে রত বহিরাগতদের উপনিবেশ। হিন্দু-মুসলমান এবং বাংলার নানা অঞ্চলের মানুষজনদের মেলানো-মেশানো দিলদরাজ আবহাওয়ায় আমরা একটু অন্যরকমভাবে মানুষ হয়েছিলাম। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে যৌথ জীবন। সব সম্প্রদায়েই এমন সব মানুষের কাছে এসেছি যাঁরা স্বধর্মে গোঁড়া, কিন্তু মানুষের সম্বন্ধে উদার। আমার অক্ষরপরিচয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা নওগাঁয়। পড়েছি মাইনর স্কুলে। পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বেশি পড়েছি পাঠাগারের বই। সেই সঙ্গে আমাকে শিক্ষা দিয়েছে খেলার মাঠ, গান আবৃত্তি অভিনয়ের মঞ্চ। নওগাঁ শহরের জীবন আমার ব্যক্তিত্বের গোড়া বেঁধে দিয়েছিল।’
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ভবানীপুরের মিত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন | এরপর ১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স-সহ বিএ পাস করেন। ১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল-এর সক্রিয় সদস্যরূপে যোগ দেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এই সময় কবি সমর সেন তাকে দেন হ্যান্ডবুক অব মার্কসিজম নামে একটি গ্রন্থ। এটি পড়ে মার্কসীয় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন কবি। সঙ্গে চলতে থাকে সাহিত্য | ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক।
শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মানুষের বৈষম্যলাঞ্চিত দুর্দশার বিরূদ্ধে দ্রোহ তাঁর কবিতার মূল সুর। ‘পদাতিক’ প্রারম্ভে ছিল ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য কাঠফাঁটা রোদে সেঁকে চামড়া’। পদাতিক কাব্যগ্রন্থের মে দিবসের কবিতা কেবল শ্রমিক শ্রেণির এক বিজয়কাব্য নয়, এতে ব্যক্ত হয়েছে ঔপনিবেশবাদের উচ্ছেদসাধনের ঋজু প্রত্যয় –
“শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;
মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না –
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা।
প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয়, হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন আত্মা।
পরে লেবার পার্টি ত্যাগ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। তারপর মাসিক ১৫ টাকা ভাতায় সর্বক্ষণের কর্মীরূপে যোগ দেন পার্টির জনযুদ্ধ পত্রিকায়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে বহু কমিউনিস্ট বন্দীর সঙ্গে দু-বার কারাবরণ করেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও।
কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তীব্র আর্থিক সংকটে পড়েন তিনি | মাত্র ৭৫ টাকা বেতনে সাব-এডিটর নিযুক্ত হন তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থায়। ১৯৫১ সালে পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন সুলেখিকা গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হলে তিনি থেকে যান পুরনো পার্টিতেই। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হলে আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন। এই দফায় ১৩ দিন কারারুদ্ধ ছিলেন কবি। মাঝে কিছুকাল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একযোগে সন্দেশ পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন তিনি। সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে একে একে লিখে গেছেন অগ্নিকোণ, চিরকুট, কাল মধুমাস, ফুল ফুটুক, যত দূরেই যাই, ছেলে গেছে বনে, জল সইতে, একটু পা চালিয়ে ভাই প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ; হাংরাস, অন্তরীপ, হ্যানসেনের অসুখ বা ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন প্রভৃতি গদ্যরচনা | চিঠি জুড়ে জুড়ে লেখা চিঠির দর্পণে-এর মতো অপ্রচলিত কাঠামোর উপন্যাস। অনুবাদ করেছেন নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা ও হাফিজ-এর কবিতা, চর্যাপদ ও অমরুশতক ইত্যাদি।
চল্লিশের যুদ্ধ-দাঙ্গা-তেভাগা-মন্বন্তর সঙ্কুলিত রাজনৈতিক টালমাটালের যুগসন্ধিক্ষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—
“আমি আসছি—
দুহাতে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে আমি আসছি।
সঙীন উদ্যত করেছ কে? সরাও।
বাধার দেয়াল তুলেছ কে? সরাও।
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আমি আনছি
দূরন্ত দুর্নিবার শান্তি।’
চল্লিশের যুদ্ধ-দাঙ্গা-তেভাগা-মন্বন্তর সঙ্কুলিত রাজনৈতিক টালমাটালের যুগসন্ধিক্ষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—
“আমি আসছি—
দুহাতে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে আমি আসছি।
সঙীন উদ্যত করেছ কে? সরাও।
বাধার দেয়াল তুলেছ কে? সরাও।
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আমি আনছি
দূরন্ত দুর্নিবার শান্তি।”
“প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য় এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা” বা “ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত” প্রভৃতি তার অমর পঙক্তি বাংলায় আজ প্রবাদতুল্য। পরিণত বয়সে গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, পরনে সাদা পায়জামা, মাথাভর্তি ঘন কোঁকড়ানো চুল, বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চোখ, চোখে চশমা, বামে চশমার নিচে বড় একটা আঁচিল – একটি প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। যকৃৎ ও হৃদপিণ্ডের অসুস্থতার কারণে দীর্ঘকাল রোগভোগের পর ২০০৩ সালের ৮ জুলাই কলকাতায় তার প্রয়াণ ঘটে। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী ছাড়াও তার তিন পালিতা কন্যাকে।
মুখ থুবড়ে পড়তে তো হয়ই, কিন্তু ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানোর নাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
জন্মদিবসের শ্রদ্ধার্ঘ্য ।
তথ্য : আনন্দবাজার পত্রিকা

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়