ডা শাহাদাত হোসেন
Published:2022-09-19 19:40:36 BdST
"আমাকে কাছের মানুষজন পাগল বলে! কারণ আমি বিয়ে করতে চাই না! "
লেখক অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
____________________
ভদ্রমহিলা, "আমাকে কাছের মানুষজন পাগল বলে! কারণ আমি বিয়ে করতে চাই না! মা বাবার কুচ্ছিত সম্পর্ক জন্ম থেকেই দেখেছি। বাবার বহুগামিতার জন্য ডিভোর্স হয়। আমাকে জোর করে দাদাদাদি রেখে দেন মা'কে এক হাত দেখাবে বলে। ইগো! সোনার আংটি বাঁকা ও ভালো! কত বড় সাহস তাদের ছেলেকে রিজেক্ট করা হয়! সত্তরের দশকে ডিভোর্স ভয়ংকর মর্যাদাহানিকর! তখন আমার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। সবে পাড়ার কিন্ডাগার্টেনে ভর্তি হয়েছি। দাদীর এক ভাগ্নে থাকতো! আশ্রিত! বলতো মা কে দেখাতে নিয়ে যাবে আমাকে যদি আমি ওকে … … … ... !"
ভদ্রমহিলা একটু থমকালেন। গলাটা ধরে গেলো! চুপ করে আছি। ওনার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে! ঠোঁট দুটো বেঁকে যাচ্ছে অপার্থিব ব্যাথায়। বুঝলাম এই ব্যাথার উৎস এই মুহূর্তে নয়!
তিনি অতীতকে এই মুহুর্তে একই তীব্রতায় উপলব্ধি করছেন। একে ফেনোমেনোলজিক্যাল ডায়াগনোসিস বলে। তাঁর শরীর তিনি একই কষ্ট অনুভব করছে। তাঁর মন একই যন্ত্রণা অনুভব করছে। ইমোশন বা আবেগ আমাদের শরীরে প্রোথিত থাকে। সচেতন মন কখনো সেটা ভুলে গেলেও অবচেতন মন ঠিকই থ্রেট ফিল করলে সেই আবেগ ঝাঁপি খুলে বের করে আনে। বুঝতে পারছি! একে একে মনের ঘরের ঝাঁপি খুলে বন্যার মত কুৎসিত কিছু আবেগ ভদ্রমহিলাকে স্পর্শ করছে।
টিসু বাক্সটা এগিয়ে দিয়ে আলতো করে হাতে হাত রাখলাম। তিনি হাত সরিয়ে নিলেন। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ভদ্র মহিলা এখন সেই পাঁচ বছরের শিশুটি। তাঁর মাথায় রিপ্লে হচ্ছে ছোটো বেলা।
বেশ অনেকক্ষণ সময় পার হলো।
তিনি আবার শুরু করলেন, "দিনের পর দিন আমার উপর যৌন নির্যাতন চলতো। আর আমার বাবা দাদা-দাদী কেউ জানতো না। মানুষের ইগো এত বড়? মাকে একহাত দেখানোর জন্য মায়ের কাছ থেকে বাচ্চা আলাদা করে ফেলে?"
ভদ্রমহিলা পানিতে চুমুক দিলেন। আমি খেয়াল করলাম ওনার নাকছাবি চিক চিক করে উঠলো ঠিক যেমন ওনার চোখ জ্বলছে!
আবার শুরু করলেন, "ডিভোর্সের পরে নানা বাড়ি থেকে আমার মার আবার বিয়ে দেয়া হলো! এই ভদ্রলোকের প্রথম পক্ষের ছেলে আমার মায়ের থেকে বয়সে বড়! এদিকে আমার বয়স ১৩ বছর হতে হতে, আমার দাদা-দাদী, বাবা তিনজনই মারা যান একটা সড়ক দুর্ঘটনায়। আমার এখনো সন্দেহ ওটা কি আসলেই দুর্ঘটনা ছিল নাকি দাদীর সেই ভাগ্নের কারসাজি! আমার পৈত্রিক সম্পত্তির কিছুই আমার ভাগে জুটেনি! এবং একদিন আমি বুঝতে পারলাম আমাকে বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সেই ভাগ্নে! ততদিনে কিছুটা বড় হয়েছি। পড়াশোনায় কখনো দ্বিতীয় হয়নি বলে স্কুলের শিক্ষকদের প্রচন্ড মমতা পেতাম। ক্লাস টিচারের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত মার কাছে পৌঁছাতে পারি। মায়ের নতুন সংসারে আশ্রয় জুটলো ঠিকই, কিন্তু এবার শুরু হলো সৎ ভাইয়ের যৌন নির্যাতন! আমার মায়ের নতুন সংসার ছিল যৌথ পরিবার। শরিকী ঘর! এজমালি সম্পত্তি! আমার শরীরটা নিয়ে কে না খেলেছে! ১৬ থেকে ৮০ বছরের পুরুষ! সেই একই ঘিন ঘিনে কুৎসিত স্পর্শ! আমি তো বরাবরই চুপ! সমস্ত কেন্দ্রবিন্দু পড়াশোনায় সরিয়ে আনলাম। দাঁতে দাঁত চেপে দিন গুনতাম কবে এখান থেকে বের হয়ে যাব। মানুষের ফার্স্ট হতে চাই তো আমি চাইতাম ডবল প্রমোশন। তাহলে একটা বছর কমবে। মা সবই বুঝতেন কিন্তু বোবা পশুর মতো অসহায়। নানা নানী মারা গেছেন ততদিনে। মামা সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছেন। মায়ের যাবার কোথাও জায়গা নেই। আমার মত মা'ও আশ্রিত। এই সংসারে মায়ের কোন সন্তান নেই। মায়ের শরীরে,সেই নৃপংসুক বৃদ্ধ স্বামী প্রবরের কামড়ের দাগ আমার মায়ের অন্তিম গোসলের সময় ও জ্বলজ্বল করছিল। এক সময় পড়াশোনা শেষ হলেও স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে আসলাম। আমার প্রেম হলো! কিন্তু আবিষ্কার করলাম আমার ফ্রিজিডিটি। ডাক্তার দেখলাম। তিনি বললেন এটা দীর্ঘদিনের যৌন নির্যাতনের ফসল। আমার শরীর পুরুষের স্পর্শ পছন্দ করে না। কিন্তু আমি এর জন্য আপনার কাছে আসি নাই!"
ভদ্রমহিলা আমার চোখে তাকালেন। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম তিনি বর্তমানে পূর্ণ মাত্রায় ফিরে এসেছেন।
আমি, " আপনি আজকের এই সেশন থেকে কি চান?"
ভদ্রমহিলা, " আমি সারোগেসি চাই! তার আগে বুঝতে চাই আমার মাতৃত্বের এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা কতটুকু সুস্থ্য?
আমি, " মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ সহজাত। প্রকৃতি আপনার শরীরকে মাতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করে করে বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তন দিয়ে। কাজেই সেই দাবি থেকে মনোদৈহিকভাবে মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে ! এটাকে আমি মোটেও অস্বাভাবিক ভাবে দেখছি না! আপনি সিঙ্গেল পেরেন্টিং চাচ্ছেন! সেটাও কোন সমস্যা নয়। বহু মা ডিভোর্সের পরে অথবা স্বামী মারা গেলে এক হাতে বাচ্চা পালছেন। কিন্তু এখানে খেয়াল করবার বিষয় যেটা, সেটা হলো আপনার PTSD। যেখান থেকে অবচেতন মন ফ্রিজিডিটি তৈরি করেছে আপনার শরীরে। যৌন সহিংসতা বা যৌন নির্যাতনের শিকার যাঁরা তাঁরা এতে ভুগতে পারেন। এই অবচেতন মন আপনার প্যারেন্টিং এ কতটুকু প্রভাব ফেলবে সেটা বিশ্লেষণ করা জরুরী সারোগেসির আগে।"
ভদ্রমহিলার মানসিক শক্তি যে সাংঘাতিক সেটা ওনার বসবার ভঙ্গিতেই টের পেলাম। উনি আসলেই পলিসি লেভেলে দুঁদে আলোচক। এমনই এই আন্তর্জতিক খ্যাতি তাঁর হয় নাই।
ভদ্রমহিলা, "আমার বয়স ৫০ পার হচ্ছে … ... সেটা কি সমস্যা?"
আমি, "আসলে প্রশ্নটা কি আপনি দ্রুত মারা গেলে কি হবে বাচ্চার বা বাচ্চাদের? বাচ্চাদের বলছি কারন এভাবে অনেক সময় যমজ হয়!"
ভদ্রমহিলা, "হ্যাঁ!"
আমি, " সেটা যেই মা বাবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাচ্চা হয় তাঁদের যা পরিণতি একই। বিষয়টা সম্পূর্ন নির্ভর করবে আপনি আপনার সন্তানদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য কি ব্যবস্থা নিয়ে যাবেন তার উপর। প্রত্যেকটা মানুষের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা আছে। নিজের সেই সীমারেখাটা বুঝে নেওয়া দরকার তাই না?"
ভদ্রমহিলা, " জ্বী! বাংলাদেশের আইনে সারোগেসি আলোচনার অবকাশ কি?"
আমি, " যতটুকু জানি বাংলাদেশের সরোগেসি সম্পর্কিত আইন খুব বেশি দূর আগায় নাই। আমি এই বিষয়ে এক্সপার্ট নই। একজন উকিলের পরামর্শ নিন।"
ভদ্রমহিলা, " ইন্ডিয়াতে যদি যাই?"
আমি, " যতটুকু জানি ইন্ডিয়াতে কমার্শিয়াল স্যারোগেসি বন্ধ করার আইন এসেছে। প্রায় এক দশক ধরে এটা একটা এথিক্যাল ইস্যু হয়ে যুঝেছে সেইখানে। এর আগে ১২ থেকে ১৫ লাখ রুপির মত লাগতো। ওদের সেন্ট্রাল গভমেন্ট সারোগেসি রেগুলেশন রুলস ২০২২ এ বেশ শক্ত কিছু নিয়ম জারী করেছে। মোদ্দা কথা আগের মতো আর নেই।"
ভদ্রমহিলা চুপ করে থাকলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে মৃদু গলায় বললেন, "মা হতে চাওয়াটা কি অন্যায় আমার জন্য?"
আমি ভদ্রমহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, "না! তবে তার আগে পুরোটা সামাল দেবেন কিভাবে সেটা বুঝে নিন। নিজের মানসিক, সামাজিকভাবে। আগে নিজের মাথায় ছক কষে নিন। কোনটার পরে কি করবেন। আপনার জীবনের ঘটনা যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেই ভয় আপনার আছে। কিভাবে সেই সমস্যার সমাধানের উপায় আছে আপনার আয়ত্বের মধ্যে? বাচ্চাদের নিরাপত্তা কি কি ভাবে সুনিশ্চিত করবেন?। কারণ আমরা পুতুল খেলতে বাচ্চা আনি না। বাচ্চা অ্যাকসিডেন্টালি হয়ে গেলো বলাটা যত সহজ, বাচ্চার বেড়ে ওঠার প্যারেন্টিং ঠিক ততটুকুই কঠিন। প্যারেন্টিং করতে গেলে নিজেকে বুঝতে হয় আমার কোন কোন আচরণ বাচ্চার অবচেতন মনে ক্ষত তৈরি করে। যেটা বাচ্চার পরিণত জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ বাচ্চা পালা একটা ২৪x৭ চাকরি। নিজেকেই প্রশ্ন করা দরকার আমি এর জন্য কতটুকু প্রস্তুত? কোথায় কোথায় আমার প্রস্তুতির ফাঁক আছে? এটাতো পুতুল নয় যে ইচ্ছা মত কিনে এনে ঘরে সাজিয়ে রাখলাম। সন্তান জন্ম দিতে যোগ্যতা লাগে না। কিন্তু বাবা মা হয়ে উঠতে গেলে যোগ্যতা লাগে। নিজের চোখে নিজেরই আয়না ধরা প্রয়োজন আমার কি সেই যোগ্যতা আছে?"
( কথোপকথনের অংশটুকু মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ভদ্রমহিলার অনুমতি সাপেক্ষে কনফিডেন্সিয়ালিটি বজায় রেখে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশে প্রকাশ করা হলো।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া।
চিকিৎসক, কাউন্সেলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাক্টিশনার।
আপনার মতামত দিন: