SAHA ANTAR, Kolkata

Published:
2022-09-07 06:57:55 BdST

অন্ধ চোখের দুঃসাহস :কেমোথেরাপির দিনরাত


মোশতাক আহমদ : কবি কথাশিল্পী চিকিৎসক


মোশতাক আহমদ

কবি কথাশিল্পী চিকিৎসক
____________________

কেমোথেরাপির দিনরাত ---------------------
কথাটা অদৃষ্টবাদীর মতো মনে হলেও শুরুতেই বলে নিতে চাই, কোভিড- ১৯ এর প্রথম ধাক্কাতেই আমার খুব ঘনিষ্ট এক বন্ধুর প্রয়াণ সম্ভবত আমার অবচেতনে বিশাল এক ঝাঁকি দিয়ে যায়— আর তারই প্রেক্ষিতে হয়তোবা আমি গুছিয়ে ফেলি আমার নির্বাচিত কবিতার পাণ্ডুলিপি, অনুবাদ কবিতাবলীর পাণ্ডুলিপি, একটি স্মৃতিকথা এবং লকডাউনের মধ্যেই সেসব ছাড়াও আর একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশেরও উদ্যোগ নিই; কেননা ভয় হচ্ছিল – আমাকে যেনবা সবকিছু প্রকাশ করে যেতে হবে! এ সব গুছিয়ে ফেলার পরপরই আমার পক্ষে প্রায় ম্যামথসম কাজ ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ বইটি লিখতে আরম্ভ করি। মজার বিষয় হল, কিছু দূর লেখা হয়ে গেলেই প্রকাশককে ইমেইলে একটি কপি পাঠিয়ে রাখি, কেননা কখন আমার চলে যাবার ডাক আসে! হয়তোবা আমি মনে মনে কিছু একটার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
প্রায় দশ বছর ধরে কবি আবুল হাসানের জীবন ও কবিতা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার পর কবির জীবনভিত্তিক একটি ডকু-ফিকশন লেখার শেষ পর্যায়ে আছি তখন; প্রচ্ছদ শিল্পী রাজীব দত্ত প্রচ্ছদের খসড়া করেছেন, পাণ্ডুলিপি দেখতে দিয়েছি বন্ধু হামিদ কায়সারকে; আর আমি শেষবার ঢেলে সাজানোর আগে সুনীল গংগোপাধ্যায়ের লেখা ইতিহাস আশ্রয়ী একটা ঢাউস উপন্যাস নিয়ে বসেছি, আমার বইটা সাজানোর কোনো সূত্র যদি পাই! আসলে কবিতার পাশাপাশি স্বল্প আয়তনের কিছু গল্প লিখলেও আমার পক্ষে তিনশ পৃষ্ঠার উপন্যাসোপম রচনা সৃষ্টির প্রয়াস তো এই প্রথম – তাই নিজের উপর হয়ত ভরসা পাচ্ছিলাম না; আমি কি উপন্যাস লিখছি নাকি ডকু-ফিকশন লিখছি – কোন নামে লেখাটিকে শ্রেণিভুক্ত করা হবে—তাও জানা নেই।
এই পর্যায়ে এসে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এক সপ্তাহ তো মাথাই তুলতে পারলাম না। আমাদের একটা বেড়াল ছানা প্রায় এক মাস এমনি করেই কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে ছিল জানালায়। সুনীলের বই রইল পড়ে, এক্সরে আর রক্ত পরীক্ষার ফাঁকে হামিদের সাথে একদিন দেখা করে ওর কাছ থেকে কিছু মন্তব্যসহ আমার পাণ্ডুলিপিটা ফেরত নিলাম, কিন্তু আমি তখন ঠিকমতো পড়তে পারছি না, মাঝে মাঝে দুটো করে অক্ষর দেখছি বা দুটো করে প্রতিবিম্ব দেখছি। পড়ায় মনোযোগ নেই মোটেও, আসলে পড়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। পেন্ডুলামের মিথুন রশীদকে বিষয়টা দেখার দায়িত্ব দিতে হল। আমার মাথার ছবি তুলে দেখা গেল বাম চোখের পিছনে মস্তিষ্কের ভিতরে টিউমার জন্মেছে। সেই টিউমারের কারণেই চোখ আর মাথায় বেদনা আর দৃষ্টি বিভ্রম হচ্ছে। সে সময়ে মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনে লিখে রেখেছি-
করোটিতে ঝিনুকের ঝাঁক
জীয়ল মাছের মতো ঘাই মেরে গেল কিছুকাল,
নিবিড় বন্ধুর মতো আচ্ছাদিত করে আছে
আরোগ্য নিকেতন;
যাবতীয় অসুখ শুষে নিয়ে নীলকণ্ঠ হবে
পাল্লা দিচ্ছে অহর্নিশ কর্কট আক্রমণের সাথে।
এরপরে মাথায় অস্ত্রোপাচারের পর নন- হজকিনস লিম্ফোমা নামের এক ধরণের রক্ত-নিবাসী কর্কট রোগ নিশ্চিতভাবেই ধরা পড়ল, কেমোথেরাপি শুরু হল, অসুস্থতার মাঝেও আমি দিন পনেরো একটু থিতু হলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম, সেরে উঠতে শুধু সময়ের অপেক্ষা। আব্বাস কিয়োরাস্তেমির জীবনবাদী সিনেমাগুলো দেখি এসময়ে। এই পনেরো দিনের সুযোগেই বইটার প্রুফ দেখা আর কিছু কিছু জায়গায় কিছু টেক্সট সংযোজন- বিয়োজনের সুযোগটা নিতে পারলাম, প্রচ্ছদের চূড়ান্ত রূপটি দেখে আনন্দ পেলাম, যদিও সম্পাদনা আর প্রুফ দেখার সময়ে মাঝে মাঝে উথালপাথাল জ্বর এসে আমকে বিরত রাখতে চাইতো! আমার রোগটা কত দ্রুত ছড়াচ্ছে আর আমি কতোটা জীবন সংশয়ে আছি, সেটা চিকিৎসকের কাছ থেকে আমার স্ত্রী জানতেন, তাই হয়তো আমার বই সংক্রান্ত শ্রম স্বীকার দেখে হয়ত গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। মাথায় স্থূল আর ভোঁতা একটা অনুভূতি নিয়ে লিখতাম-
পৃথিবীর শেষ মাথা খুব দূরে নয়!
পিয়ানোর চাবি মুখস্ত ছিল -
অন্ধ সুরকার বেঁচে থাকবেন; পৃথিবী ধ্বংসের দিন
ইসরাফিল অপেক্ষা করবেন; -- প্রান্তরে
সিম্ফনির রেশ মিলিয়ে যাবার।
নোটপ্যাডের একতলা দোতলার অক্ষরগুলো মুখস্ত রেখে
অন্ধ চোখের বেদনা উপেক্ষা করেছি,
লিখেছি সাধ্যমতো মন ভুলানোর গান।
মুনকার নাকিরের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি
দুই স্কন্ধে ভারী হয়ে আছে,
পৃথিবীর ওই মাথার দিকে হেঁটে যেতে যেতে ভাবি
কখনো পাবো না সোনালি মলাটের সেই বই;
পৃথিবীর শেষ মাথা অত কাছে নয়।
প্রকাশকের কর্ম তৎপরতায় দ্রুতই হাতে পেয়ে গেলাম শোভন মুদ্রণের ‘ ঝিনুক নীরবে সহো’। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতেই এবারে আমি চরম জীবন সংশয় নিয়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র অর্থাৎ আইসিইউতে চলে গেলাম। শুরু হল আমার দেশ বিদেশের বন্ধু আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের উৎকন্ঠা, কারো কারো বিনিদ্র মনোযোগ। আইসিইউতে ঘোর-অঘোরের দোলাচলে বই পড়তে চেষ্টা করেছি; চিকিৎসকদের কাছে এ এক আশ্চর্য দৃশ্য ছিল।
আবার নিম্ন রক্তচাপের ভার্টিগো, শিহরণ
অসহায় শয্যাশায়ী;
কখনো মাথা নেড়ে নেড়ে
অকুস্থল থেকে মুক্তির চেষ্টা।
প্রিয়জনের কথাবার্তা, উৎকীর্ণ ডাকাডাকি
দূর নগরীর প্রতিধ্বনি -
ভয়কে জয় করেছি কনিষ্ঠা কন্যার মুখ দেখে।
আইসিইউ থেকে বের হয়ে আবার কেমোথেরাপি শুরু। আমার অবয়ব তখন কঙ্কালের মতো, চেহারা বদলে গেছে, মাথা চুলশূন্য। পৃথিবীতে বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে হাসপাতাল থেকে বাসায় যাবার সুযোগ মেলে। কিন্তু ফুলের বাগানে যাওয়া নিষেধ। ফুল থেকেও নাকি সংক্রমণ হতে পারে। ঘরের বারান্দা পেরোলেই তো অপরাজিতা, জবা আর গোলাপ ফুটে আছে। আমি তখন হাঁটতেও পারি না, তাই ফুলের কাছে যাওয়া থেকে এমনিতেই নিরাপদ। কয়েকটা বিড়াল ছিল ঘরে। ওদেরকেও তাড়াতে হল সংক্রমণের ভয়ে। বন্ধুদের অনেকে আসে, অনেকেই আসে না – কেননা একদিকে করোনা, অন্যদিকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াতে আমি সহজেই সংক্রমিত হয়ে যেতে পারি— সেই ভয়ে। টেলিফোন এলে তখন আর ধরি না, কথা বলতে গেলে শ্বাসকষ্ট হয়, আরো মাস দুয়েক টেলিফোনহীন থাকলাম।
শ্রাবণ তুমুল
আমার জানালায় -
বাগান তো নিষিদ্ধ
বারান্দাও অগম্য প্রায়;
পোষা বিড়ালেরা
পরিত্যক্ত -
সংক্রমণের ভয়ে
বন্ধুরাও বিচ্ছিন্ন
কত যুগ --
কবিতাও জটলা করে না
এই শ্রাবণের জানালায়।
আমার বাম চোখটা কিন্তু কাহিনির শুরুতেই অন্ধ হয়ে গেছে! ডান চোখের দৃষ্টি তখনো এতোটাই স্পষ্ট আর নিখুঁত – বর্ণে এবং রেখার ইমেজ দর্শনে, যে অন্ধ চোখের অস্তিত্ব আমলে না নিয়েই সৈয়দ মুজতবা আলীর খণ্ডগুলো একটা একটা করে হাসপাতালে আনাতে থাকি। মাঝে মাঝে ফুলে থাকা বাম চোখ নিয়ে একটা অলীক আশা হয় যে, অপারেশনের ফলে চোখের স্নায়ুর চারপাশে হয়তো যথেষ্ট জলকাদা জমে আছে, ভাঁটার টানে ওরা চলে গেলে আবার দৃষ্টির ফুল ফুটবে! আমি ফোনের পর্দায় লিখতে শুরু করি ‘ শায়ের তো নেহি’ নামের এক খামখেয়ালি সিরিজ কবিতা-
বুলবুলির অপেক্ষায় বসন্তদিন এসে গেল
কুঁড়ি থেকে ফুটল গোলাপ -- স্বাগত বাগিচায়
এই বসন্তে অন্ধ আমি গোলাপের কাঁটা বিঁধে
অবেলায় দেখতে এলো গানের পাখি বুলবুলি
চিবুক ছুঁয়ে বলো কি কখনো রূপের তৃষ্ণা মিটে?
রঙিন ছবি কি অর্থহীন নয় অন্ধ চোখের কাছে?
দু চোখে দেখতে পেলে -- পাতাহীন গাছেও সৌন্দর্য ফুটে শীতে
মোহর করা চোখে বসন্ত বা বুলবুলি -- দুইই ভিন্ন গোলার্ধে
আমি ও পিদ্দিম জ্বলে থাকি দীর্ঘ রাতের দোহা
ভোর হলে ব্যর্থ হবে প্রদীপের বেঁচে থাকা
★ ডায়েরি থেকে এর পরের বৃত্তান্ত
এন্ট্রি-১
চোখে একটু একটু ঝাপসা দেখছিলাম। সেটা অক্টোবরের শেষ থেকে খেয়াল করলাম। তবে শারীরিক অবস্থায় মনে হচ্ছে আমি কিছুদিনের মধ্যেই ক্যান্সারকে জয় করতে যাচ্ছি! জটিল লেখাপত্র পড়তে মনঃসংযোগ থাকে না। হুমায়ূন আহমদের পুরনো বইগুলো পড়ে সময় কাটাই। চোখের ডাক্তার জুতসই কোনো কারণ খুঁজে পান না। বলেন, সব ভালো আছে। অস্বস্তিময় আশ্বস্ত হয়ে ফিরে আসি। কেমোথেরাপির নানা ওষুধ চলছে – একেক অষুধে একেক রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। এত ঘাবড়ালে চলবে না। এত গবেষণা করেও কুলাবে না। ডিসেম্বরে কেমোথেরাপি শেষ হোক, পিইটি - সিটি স্ক্যান রিপোর্ট পরিষ্কার আসুক, তখন দেখা যাবে। হয়ত ততদিনে চোখের দৃষ্টি ঠিক হয়ে যাবে। জানুয়ারিতে যখন পেট স্ক্যান একদম পরিষ্কার এলো -- আপাতত কোনো ক্যান্সার বীজ নাই -- তখন গত সাত মাস যারা আমাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় রেখেছিলেন, তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তাদের ফোকাসের একটু বাইরে চলে গেলাম; আর বিধাতা মুচকি হাসি হাসলেন।
… কিংবা হাসপাতালের গায়ে তাই নীল রঙ মাখিয়ে দিয়েছে কবির বন্ধুরা
একজোট
দিগন্তে মুছে গেছে আপাতত অসুখের ক্রোধে ভরা সিডর আকারের মেঘ
ক্রমশঃ মুছে যাচ্ছে প্রিয়জনদের নৈরাশ্য
উদ্বিগ্নতা
সহিষ্ণুতার সবটুকু কাঁধ মেলে রাখছে পরিবার।
★ " কী খেলা তুমি নতুন করে যাবে আবার খেলে/ যে ক্ষতি আমি নিয়েছিলাম মেনে!"
ড্রাগের কারণে কঠিন রকমের স্নায়বিক সমস্যা হয়ে গেছে! নিউরোলজিস্ট বন্ধু আহসান হাবীব হেলাল আর শরীফ উদ্দিন খানের পরামর্শ নিই। থপ থপ করে হাঁটি, জামার বোতাম লাগাতে পারি না। ভাত মাখতে কষ্ট হয়। ওদিকে, জানুয়ারির শেষে বইপত্র, ল্যাপটপ আরো ঝাপসা। ক্রমশঃ আমার বই পড়া বন্ধ হয়ে গেল, সান্ধ্যকালিন টিভি দেখা বন্ধ হয়ে গেল। আমার বাম চোখ অন্ধ, আর যে- ডান চোখই আমার পৃথিবী, সেটা ঝাপসা হয়ে গেছে। আমার জীবনে কখনো এতটা বিপন্ন হইনি। আমি রাস্তা পার হতে পারি না। সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। এদিকে স্ত্রী আর বড় মেয়ের অফিস, ছোট মেয়ের ভার্সিটির ক্লাস -- কিছুই আর ভার্চুয়াল নয়। আমি বাসায় একা, একদম নিঃসংগ হয়ে গেলাম, পরিবারের সদস্যরা এরই মাঝে পালা করে কাছে থাকার চেষ্টা করে। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে এক মুহূর্তের জন্য মন খারাপ করিনি, কিন্তু এবারে চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসাতে মনে হল পৃথিবী ক্রমশঃ অন্ধকার হয়ে আসছে। ক্যান্সারমুক্ত হবার আনন্দ দু সপ্তাহও সইলো না। এই অবস্থায় চক্ষু বিশেষজ্ঞ মোস্তাক আহম্মদ স্বপন ভাই আর আমার বন্ধু মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আদনান চৌধুরী আমার চোখের সমস্যার কারণটা ধরে ফেললেন; আততায়ী ওষুধটা বন্ধ করলাম। কিন্তু চোখের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার ভীতি কাটেনি।
হাওয়া মহলে বাস করি -- দরোজা দেয়াল নাই
বিজলি বাতির অভাবে জ্বেলে রাখি পিদ্দিম
বৃষ্টি নামে -- বসে থাকি ঠায় ঝোড়ো হাওয়ায়
আমার পিদ্দিম নিভে না কখনো -- দেখে যাও
বজ্রপাতের চাইতেও জোরে শব্দ করে ঠা ঠা হাসি
সাপ এসে ফিরে যায় -- আমরা তো নীলকন্ঠ
আমি ও পিদ্দিম জ্বলে থাকি দীর্ঘ রাতের দোহা
ভোর হলে ব্যর্থ হবে প্রদীপের বেঁচে থাকা
এন্ট্রি-২
আমি তখন আপাতত ক্যান্সারমুক্ত হয়েছি কিন্তু হাতে-পায়ে স্নায়বিক সমস্যা আর চোখদুটো রাজরোগের সাক্ষীগোপাল! বইহীন হয়ে গিয়ে আমি খুব বিপন্ন দিনরাত্রি পার করছিলাম। সারাদিন শুয়ে- বসে থেকে শেষ বিকেলে একটু হাঁটাহাঁটি করি। কুড়ি মিনিটে হাঁটার চক্র শেষ করতে হয়, কেননা এরপরে হাঁপিয়ে যাই। কখনো ছাদে যাই সূর্যের আলো গায়ে মাখার জন্য। খেতে চেষ্টা করি, কিন্তু খেতে পারি না।
বন্দি বাঘরূপী ছবি বিশ্বাসের ঠুমরী শোনার রাতি
জেল্লাবিহীন জলসাঘর, তার ঝুলে ভরা ঝাড়বাতি
ঘুঘু চড়া সিন্দুকে শেষ মোহরের ঝংকার
বাঈ এসেছে না রাই -- দুই দুয়ারে টংকার
চনমনে ভোরবেলা -- এখনো কিছু মোহর আছে
অশ্বমেধিক যজ্ঞের ঘোর -- তেপান্তরে নাচে
এন্ট্রি-৩
আজ যখন নিয়মিত অফিস করতে পারছি, কালো পর্দার একটা বড় কম্পিউটার মনিটরের সামনে বসে সব ধরনের কাজ করতে পারছি, ভাত মাখতে পারছি, চারতলা সিঁড়ি বেয়ে একা একাই ওঠানামা করতে পারছি -- তখন মনে হয় ‘এ গলিটা ঘোর মিছে!’ কয়েক সপ্তাহ আগেই যে- আমি পুরো দেড় মাস কোনো বই-ই পড়তে পারিনি, টিভির ঘরেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম -- অলীক লাগে সেসব।
যে ওষুধের কারণে অন্ধ হতে বসেছিলাম, সে ওষুধ বন্ধ করার পর থেকে প্রতিদিন সকালে বড় ফন্টের একটা বই নিয়ে বসতাম- উন্নতি বোঝার জন্য। দিন দশেক পর থেকে চশমা কপালে তুলে খালি চোখে কোনো রকমে বই পড়তে পারতাম। একটা রোমাঞ্চোপন্যাস পড়েছিলাম ৫/৬ দিন লাগিয়ে!
পথ হারানো এক জোনাকি -- সাথী হতে চাইলো
আকাশে দেখি সিঁদুরে মেঘ -- কী করে যাই বলো
উটপাখি সেজে থাকি -- উইপোকা হয়ে গড়ি চক্রব্যুহ
'এ কী জোনাকি' উড়ে গেল -- মতিগতি বোঝা দুরূহ
এন্ট্রি- ৪
ডাক্তার দূর্গা প্রিয়দর্শিনীর চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এসে ফাইলের অপেক্ষায় আছি। ডাক্তার আরেকবার আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে দরোজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। আমার ঝাপসা চোখেও স্পষ্ট হচ্ছে তাঁর সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের আভা।
★ মুক্তগদ্য
প্ল্যানেটোরিয়ামের ছাদময় ছুটন্ত তারার মতো শ্বেত বিন্দুর দেখা মিলতেই হাতের জয়স্টিক দিয়ে জানান দিতে হচ্ছিল : আমি দেখতে পাচ্ছি। ফিফটি পার্সেন্টই দেখতে পাইনি বলে রিপোর্টের পাতায় কালো কালো ডট বসে গেল। নার্স বলল, তুমি আরেকবার চেষ্টা করো। আমি বললাম, না আমি রিটেক দেব না; আজ ফেল করছি এটা আমি মনে রাখতে চাই। পরের বার যোগ্য হয়েই পাস দিব। এমনিতে হুটহাট মোটর সাইকেল, পথচারী, বিপজ্জনক বয়সের নারী -- আমার দেহের বাম সীমানায় প্রায়ই ধাক্কা খায়, দেখতে আমি পাইনি বলে। অবশ্য আমার শখের চশমা বানানো বন্ধ হয়নি; মনের জোরে ফিল্ড অব ভিশন বেড়ে বেড়ে প্ল্যানেটোরিয়ামের ছাদ ছুঁয়ে দিচ্ছে! চশমা মোছার কাপড়ে লেখা আছে – কল্পনাশক্তির সীমানাকে চ্যালেঞ্জ করো! অন্ধ চোখের কী দুঃসাহস!@

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়