ডা কামরুন লুনা

Published:
2022-05-16 22:10:27 BdST

পার্ট না ডাট: এই প্রজন্মের ওরা বলে পার্ট;আমাদের সময় ছিল ডাট


অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুস, প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধান নেফ্রোলজী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ



অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুস,
প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধান নেফ্রোলজী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
_______________________________

এই প্রজন্মের ওরা বলে পার্ট। আমাদের সময় ছিল ডাট। সোজা কথায় যা হল অহংকার। আমরা খুব অহংকারী ছিলাম চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র তাই। তখন, এখন, সারাক্ষন।ষাটের দশকে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হতে পারা ছিল স্বপ্নের মতো। সেই সময়ের অধ্যক্ষের মতে চট্টগ্রাম কলেজ ছিল সারা দেশের রেংকিঙে চার। ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা কিছুটা ধরা ছোয়ার বাইরে।মার্কস ও সরাসরি ইন্টারভিউতে সার্বিক ভাবে মনপুত করতে পারাটাই ছিল মাপকাটি। শুধু মাত্র মার্কস নয়। এসএসসি পরীক্ষার পর নিজে নিজে যখন মুল্যায়ন করতাম তখন কখনও চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তির মার্কস হতো না। যখন ভর্তি হতে পারলাম তখন মনে হলো পার্টটা হাতে ধরা দিল। সারাক্ষন মনে হতো সবাই জিজ্ঞেস করুক কোথায় পড়ি যাতে মুখটাকে অন্যরকম করে বলতে পারি চট্টগ্রাম কলেজে। সেটাই ছিল আমাদের পার্ট বা ডাট।
ছোট ছোট ঘটনা, কিছু বলা কথা, কিছু রটনা, কিছু ঘটনা, কিছু পাওয়া বা না পাওয়া, কিছু বলতে পারা বা না পারা সব মিলিয়ে হয় কিছু কাহিনী। তরপর কল্প কথা। আপাত দৃষ্টিতে কোন ছোট শব্দ, ছোট কোন কিছু, ছোট কোন ঘটনা হয়ত হীম শিলার চুড়া যা পানির উপরে ভেসে থাকে, আসল অবযব তো দেখার বাইরে পানির নীচে। এই ছোট ছোট চুড়া গুলোর সমন্বয় ও অদেখাদের সম্মক উপলব্ধি অনেক বড় পেন্ডোরা বাক্সের ডাকনি খোলে দিতে পারে। যেমনি কিছু উম্মোচন করেছিলেন নন্দিত লেখিকা অরুন্ধুতি রয তার ‘গডেস অব স্মল থিংকস’ এ। চট্টগ্রাম কলেজকে নিয়ে সব প্রাক্তনী, আমাদের মনের গভীরে চির বাঙময় নিজেদের আকা নিজ নিজ পংতি ও চিত্রমালা গাথা আছে।
স্কুলের ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে চট্টগ্রাম কলেজ, পুকুর থেকে সরোবর। হারিয়ে যাওয়া ডুবে যাওয়া হাবুডুবু খাওয়া। এক ক্লাশ থেকে অন্য ক্লাশে, এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে। এক এক কক্ষের এক এক নাম। এখনও তা আছে কিনা জানা নেই। কখনও হেলতে দুলতে কথনও দৌঢ় কক্ষ থেকে কক্ষে। সব চেয়ে বেশী দুরত্ব ছিল জি১ খেকে পিএলটি। এই দুরত্ব অতিক্রম করে এক ক্লাশ থেকে আরেক ক্লাশে যেতে পাচ মিনিটের বেশী লাগতো না। আমাদের কোন কোন সহপাঠি সামনের বেঞ্চে বসার জন্য রীতিমত দৌড়াতো। প্রথম দুই সারি মেয়েদের জন্য নির্ধারিত ছিল এবং তারা শিক্ষকের সাথে সাথে কক্ষে ঢুকত। এখন অবশ্য সেই সব প্রথা আর নেই।মেয়েদের আর পাহারা দিতে হয় না। কলেজের এক এক গ্যালারীর এক এক বিশেষত্ব ছিল। তবে সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় আর পরিচিত ছিল সিজি বা কেমেষ্ট্রি গ্যালারী। কলেজের কেন্দ্রে অবস্থিত এই গ্যালারীতে সব ছাত্র সংগঠন গুলোর পলিটিকেল সভা গুলো হতো এবং তা হতো দুপুরের ব্রেক সময়ে, কখন ক্লাশের সময়ে কখনও নয়।যা এখন কল্পনাও করা যাবে না।
চট্টগ্রাম কলেজের স্থাপনাগুলো তিনটি ভিন্ন ভিন্ন লেভেলে লেন্ডস্কেপিং করে গড়া হয়েছিল। দুটি প্রাচীন ভবন আছে এখনও কার্জন হলের আদলে বৃটিশ ভারতীয় নকশায়। চট্টগ্রামে এমনি অনেক গুলো স্থাপনা ছিল। আমাদের নষ্ট করে দেয়ার লিপ্সায অনেকগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ বলি হয়েছে জেলা পরিয়দ ভবন। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে এই অতীত নষ্ট করার কোন প্রচেষ্টা দেখা যায় না।বৃটিশ পার্লামেন্ট তার সবচেয়ে বড় উদাহরন। কলেজের কেন্টিন, অডিটরিয়াম, লাইব্রেরী, মসজিদ, মেয়েদের কমনরুম, হষ্টেল ও খেলার মাঠ। ছড়ানো ছিটানো। সবখান থেকে আকাশে উকি দেয়া যায়। বাতাসের দোলার ছোয়া দেয়, কৃষ্ণচুড়ার লালিমা বা অন্যসব রঙবেরঙ সবুজের সমারোহ মন টানে। ঋতুতে ঋতুতে নিত্য নতুন রূপে। সবুজ, লাল, ধুসর। শুকনো, ভিজা, চকচকে। কিশোরোত্তর বয়ে যাওয়া বর্ধনশীল সময়ে এসবের প্রভাব সুদুর প্রসারী । সংবেদনশীল, অমায়িক, উদার, সহিষ্ণু ও বিনয়ীর ফাইন টিউনিং হওয়া।যার অভাব চারিদিকে এখন প্রকট।
এই মহিসোপান বা সরোবর বা মালভুমিতে স্কুলের খুদ্র গন্ডি থেকে আছড়ে পড়া। প্রথম কদিনের অবস্থা ছিল ‘পথের পাচালী’ র অপুর মতো। পুকুরের মাছ সাগরে। নিজকে হারানো। প্রথম দিনের ক্লাশ পর পর, ফিজিক্স, মেথমেটিক্স, বোটানী, কেমেষ্ট্রি, ইংলিশ ও বাংলা। এক ভবনের এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে। দৌড়ানো। বিরক্তিকর। তবুও ভালো লাগছিল। অন্যরকম ভালো লাগা। স্যারদের ক্লাশ গুলো একেক জনের এক এক রকম। কিন্ত একটি কমন ফরম ছিল। জ্ঞান। শব্দস্রোত হয়ে তা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল জলপ্রপাতের মত।কত কথায়, কত ভাবে, কত রূপে। অবাক হয়ে যেতে হতো জ্ঞানের ভান্ডার কত বিশাল হলে এমনি ভাবে অবলীলায় কথামালার বলয় আর সম্মোহন সৃজন করা যায়। মাঝে মাঝে ছন্দ পতন, ক্লাশ ডিস্টার্বেন্স, আসামী বের করা, শাস্তি। এখন আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষকগন ছিলেন এক এক জন লিজেন্ড। মনে হয় তারা গ্রন্থনা করছিলেন, ‘প্রাঙ্গনে মোর শিরিষ শাখায পাতায পাতায় ফুল ফোটাবার এই খেলা’। চট্টগ্রাম কলেজ ও এর শিক্ষকগন দেশ ও জাতির জন্য ফুল ফুটিয়েই যাচ্ছেন। শিক্ষকগন ছিলেন সবচেয়ে বড় সম্পদ। তারা প্রত্যেকে ছিলেন যার যার বিষয়ে পন্ডিত। তবে সব চেয়ে আকর্ষনীয় ছিল উনাদের দৃশ্যমান ক্যারিশমা, স্বকীতায় সমুজ্জল। তবে কেউ কেউ বেশী মনে দাগ কাটা। বাংলার মোমতাজ উদ্দীন স্যার, আমার কাছে যাকে মনে হত আনপ্রেডিক্টেবল হ্যামিলনের বংশীবাদক। কেমেষ্ট্রির সিরাজুল ইসলাম স্যার, কাষ্টম আর কেননের রিজিড দিশারী। বোটানীর ওবায়েদুল্লাহ স্যার তার ক্লাশের সমযের মধ্যেই দিনের পড়া শেষ করার কৌশুলী। তবে জুলজীর জয়নাব মেডাম ছিলেন অন্যরকম। যার চারদিকে বিচ্ছুরিত হত আমাদের জন্য অশেষ স্নেহাশীষ।
চট্টগ্রাম কলেজ দ্যুতির চিরন্তন উৎস। শুধু মাত্র জ্ঞান বিতরনে নয়। তার বাইরের অনেক দিগন্তে। শিক্ষাকে দীক্ষায রুপান্তর করে ব্যক্তি, গোষ্টি আর সমষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত করার সক্রিয়জন তৈরী করে দেয়া। বুদ্ধির মুক্তিতে উজ্জিবীত করে। তাই এই কলেজের টেষ্টিমোনিয়ালের শেষলাইনে পরাধীনতার ডিকটেশন ছিলনা। ‘হি/সি ওয়াজনট ইনভল্বড ইন এনি একটিভিটি সাবভারসিভ অব দা ষ্টেট অর অব ডিসিপ্লিন’। তার বদলে লিখা ছিল ‘আই নো নাথিং এগেইনষ্ট হিম’। আমি এখনও ভাবি কত প্রখর ছিল মাথা নত না করার সেলফ এসটিম। কারন পরাধীন সময়ে এন্টিষ্টেট বা সাবভারসিভবতাই ছিল দেশপ্রেমিকতা। পুথিগত শিক্ষার বাইরেও চট্টগ্রাম কলেজের পরিধি পরিব্যাপ্ত। সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, স্বাধীনতার চেতনা, আন্দোলন, প্লাবন, বিবর্তন, ইত্যাদি সব সীমানায়। গন্ডির বাইরে দেখানোর উদ্যোমতা। বব ডিলানের কথায়, ‘দি আন্সার মাই ফ্রেন্ড ব্লইং ইন দা উইন্ড, দি আন্সার ইজ ব্লইং ইন দা উন্ড’। চট্টগ্রাম কলেজিয়ানরা তাই পেয়ে চলছেন সেই দীক্ষা। বিশ্বজোড়া পাঠাশালা থেকে।
টুল, বেঞ্চ, গ্যালারী আর ছুটাছুটির মাঝে লুকিয়ে ছিল অন্য এক টান। সেটা হল উদিয়মান তরুন হৃদয়গুলির মধ্যে নিশঃব্দ ফিসফিসানি। ’মনেরো রঙ্গে রাঙাবো মনেরও ঘুম ভাঙাবো’ র চিরন্তন আবেশ।মন কেমন করা। বুকের ধুকপুকানি। চকিত দেখা দেখি আর বা কথা বলা, ভাবসাব। কখনও সখনও মন দেয়া নেয়া, কখনও সাময়িক কখনও সুদুর পরিব্যাপ্ত। কখনও সফল কখনও বিফল। তরুন তরুনীর চিরন্তনতা। প্রতিদিন নুতন নুতন ছোট গল্প উপন্যাস চিত্রনাট্য রচিত হয়। কবি গুরুকে মনে করিয়ে দেয়,’যা ঘটে তা নয়, যা রচিছ তাই সত্য, কবি তব মনোভুমি রামের অযোধ্যার চেযেও সত্য’। টুল বেঞ্চি গ্যালারীর কাহিনী। চলছে, চলে আর চলবে। কিন্তু তাতে যোগ আছে আরেক অবস্থানের, যার আছে দারুন চুম্বকিয় ভুমিকা। সেই লিচুতলা। রেলিং দিয়ে দুই সমতলের বেড়া। কখনও নীরব থাকা, কখনও সরব, কখনও দীর্ঘশ্বাস, দুরে চাহনি আরও না বলতে পারা অনেক।
কলেজ আঙ্গিনায় যে দেয়ালের লিখনটি প্রথম চোখে ধরেছিল তা হল,’যাত্রা তব শুরু কর যে যাত্রিক কর হানি দ্বারে নবযুগ ডাকিছে তোমারে’। মনে গুঞ্জন উঠেছিল, দ্বার খোলতে হবে মেধা ও শিক্ষা দিয়ে দীক্ষায় রুপান্তর। জ্ঞান, প্রজ্ঞা দিয়ে দিগন্তের স্বপ্ন দেখার দুয়ার খোলার। তার কদিন আগে ১৯৬৯ এর সেই উত্তাল দিনগুলিতে চট্টগ্রামে দেয়ালের লিখন দেখেছিলাম, ‘তুলে দিয়ে গেল তার মুখের ভাষা সহস্র মুখে, দিয়ে গেল বাশের বাশরী সহস্র হাতে, বাংলাদেশ কাদে, নিজুম রাত প্রতিরাত অপেক্ষা করে নুতন সূর্য জ্বলে উঠার’। অনেক অনেক দিন পর কয়েক সপ্তাহ আগে কলেজ অঙ্গনে যেতে হলো পুনর্মিলনীর রেজিণ্ট্রেশন করার জন্য। দুটো বেদনাকর দৃশ্য হজম করতে হলো। প্রথমত ১৯৬৯ এর শেষের দিকে ‘একোয়ার নলেজ’ এর আদ্য অক্ষরের ছাচে তৈরী করা নান্দনিক তোরনটা ভেঙ্গে নতুন করে ব্যবসায়ী বা নির্বাহীদের দফতরের মত বিদ্যাপিঠের সাথে অসামঞ্জক একটি গেট মুখবৎাদান করে আছে। কোন একজন মনে করেছিলেন গেটের ইংরেজী আদ্য অক্ষরকে পাকিস্তানের পতিত স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের নামের ইনিটিয়াল। না জেনে ‘চিলে কান নিয়ে গেল’ মনে করে এই নান্দনিক তোরনটাকে ধ্বংস করা হয়। অথচ যখন তোরন তৈরী করা হয় তখন তার পতন হয়ে গেছে। অন্যটি হলো কলেজের আঙ্গিনায় পুলিশের স্থায়ী ফাড়ি। আমি বিস্মিত। তাহলে টেস্টিমোনিয়ালের শেষ লাইন কি পাল্টে গেল। শিক্ষার্থীরা কি এখন দুর্বৃত্ত?
১৯৬৯ একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হওয়ার বছর। সে বছর ছিল চট্টগ্রাম কলেজের শতবার্ষিকী। মোমতাজ স্যারের নেতৃত্বে শত বার্ষিকীর কাজ শুরু হয়েছিল। বাংলা বিভাগের কোনায় একটা কক্ষে শতবার্ষিকী অফিস খোলা দিয়ে। কিন্তু উত্তাল ১৯৬৯ এর ঘূর্ণীতে তা আর হয়নি। এবং তা আর কখনও হবে না। নাকের বদলে নরুন শান্তনা এই আমরা চট্টগ্রাম কলেজের শতবার্ষিকী ব্যাচ। শত বার্ষিকীর কথা জাগলেই আমার কেন জানি মনে পড়ে যায়, কবি গুরুকে, ‘ঝড়ের রাতে ছিনু প্রহর গনি, হায় শুনি নাই শুনি নাই রথের ধ্বনি, তব রথের ধ্বনি’।
কি করে দুবছর কেটে শেষটায় একাকার হয়ে গেল মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার যুদ্ধে তা উপলব্ধির অনেক দুরে। চিন্তার ভাবার সবকিছু তখন জমাট বেধে শুধুই এককেন্দ্রিক। দ্রুত স্বাধীনতা। ষ্টিভেনসনের কথায়, ‘ফাষ্টার দেন ফেইরিজ, ফাষ্টার দেন উইচেস’। এবং দুবার এইচএসসি পরীক্ষা, এক বছর পিছিয়ে যাওয়া। আমাদের জীবনের একবছর স্বাধীনতার জন্য দিতে পারার সৌভাগ্য অর্জন করা মুক্ত বাংলাদেশের প্রথম এইচএসসি অর্জনকারী।
চট্টগ্রাম নগরে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় হলো বুদ্ধির মুক্তি, ইচ্ছাঘুরি উড়াবার আর স্বপ্ন বুননের পিঠস্থান। নিগাদ মনগুলো আর সফেদ হাত গুলো এখানে সম্মিলিত ভাবে গড়ে কত কল্যাণকামী অবয়ব। চট্টগ্রাম কলেজ আর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ চট্টগ্রাম নগরে সেই শুন্য স্থান পুরন করছে। সৌভাগ্য, এই দুই বিদ্যায়তনে পদচারনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। চট্টগ্রাম কলেজে একাদশ দ্বাদশে চারটি শেকশন ছিল। এ আর বি বিজ্ঞান ও সি আর ডি মানবিক। আমি এ তে ছিলাম। এই সব শ্রেণীতে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, চট্টগ্রাম সরকারী মুসলিম হাই স্কুল, সেইন্ট প্লাসিড স্কুল, সেইন্ট স্কলাষ্টিক স্কুল, খাস্তগির আর অপর্নাচরন স্কুল দল হিসাবে প্রধান্যে থাকত। তাই কিছু কিছু শিক্ষক কলেজিয়েট, মুসলিম ও সেইন্ট প্লাসিডের প্রাক্তনীদের রোল নাম্বারের পাশে ষ্টার দিয়ে রাখতেন। ক্লাশে যে কোন ডিস্টার্বেন্সের জন্য সব সময়ের জন্য দায়ী করে রাখা।ক্লাশে স্যংখ্যাধিক্য ছিল গ্রামের বিভিন্ন স্কুলের। আমাদের অগ্রগতি হয়েছে অনেক। কিন্তু এখনকার দিনে গ্রামের স্কুলের কেউকি চট্টগ্রাম কলেজে সহজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে?
ক্লাশে উপদ্রব আর বিশৃঙ্খলা করার কিছু পদ্ধতি দেখে শিখে ছিলাম চট্টগ্রাম কলেজে। মার্বেল ছাড়া গ্যালারীতে! ছন্দময় শব্দের সঞ্চার। কাগজের এরোপ্লেন বানিয়ে উড়ানো। বা রোল কলের সময় বিকৃত শব্দ করা। এর সাথে সাথে গোলমাল করার কারনও জেনেছিলাম। কোন না কোন কারনে বিরক্তিকর ক্লাশ গুলোই হলো সব গোলমালের উৎস। শিক্ষকের জ্ঞান, ব্যক্তিত্ত ও উপস্থাপনা গোলমাল না হওয়ার সব চেয়ে বড় প্রতিষেধক। ক্লাশে গোলমালের এই অভিজ্ঞতা খুব কাজে লেগেছিল যখন আমি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক হয়েছিলাম। কারন আমি গোলমালের কারন অনেকটা জানতাম এবং তা দুর করে রাখতাম। আমার শিক্ষকতা জীবনের প্রথম ক্লাশ ছিল, ‘হাও টু ডিস্টার্ব এ ক্লাশ’।
চট্টগ্রাম নগরীর কোতয়ালীর মোড় থেকে একটি রাস্তা কোর্টরোড চলছে সামনে চট্টগ্রাম সরকারী মুসলিম হাই স্কুলের সম্মুখ দিয়ে, লাল দিঘীর পাড় হয়ে আন্দরকিল্লার মধ্য দিয়ে ও মিউনিসিপালিটিকে পাশ কাটিয়ে আন্দরকিল্লা রোড হয়ে কেবি আবদুস সাত্তার রোড নাম নিয়ে তারপর, কলেজ রোড দিয়ে চট্টগ্রাম কলেজের সামনে থমকে দাড়ায়। অতপর আরো সামনে চকবাজার মোড়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে হয়ে যায় কেবি ফজলুল কাদের রোড আর তার বাপাশে জেগে উঠে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। স্তরে স্তরের এই তিনটি শিক্ষায়তন একজনকে গড়ে তোলে বানায় পেশাজিবী, চিকিৎসক। কিন্তু এগুলোতে ডুকতে পারা সহজ নয়। আমার পরম সৌভাগ্য আমি এই পথ দিয়ে হেঠেছি, ঢুকেছি। পর্যায়ক্রমে তিনটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হয়েছি। তেমনি করে হয়ত বা আমি, ‘চঞ্চলও হে আমি সুদুরের পিয়াসী’র অনুরননে অভিসিক্ত হতে পেরেছি কবি গুরুর কথামালায়।
চট্টগ্রাম কলেজ ছিল রিনিকি ঝিনিকি জ্ঞান বিতরনের ঝর্ণাধারা।কল্প কথার ‘নীল কন্ঠ পাখীর পালক’ বিলিয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত দানবকে হারিয়ে মানবই নীল কন্ঠ পাখীর পালক ছিনিয়ে নিতে পেরেছ। এতকাল শিক্ষকতার পর আমার কাছে মনে হয়, জ্ঞানই হলো নীল কন্ঠ পাখীর পালক। অন্যদিকে মনের প্রজ্জ্বোলন থেকে মনে জাগে চট্টগ্রাম কলেজ হলো ‘আগুনের পরশ মনি’। অজস্র প্রাণে গুঞ্জন তোলা, ‘আগুনের পরশ মনি ছোয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য কর দহন দানে’। আমরা চট্টগ্রাম কলেজের সব প্রাক্তনীরা এই এক বিন্দুতে সমর্পিত। নীল কন্ঠ পাখীর পালক আমরা সবাই পেযেছি। আগুনের পরশ মনি দিয়ে আমদের জীবন পুণ্য হয়েছে।
চট্টগ্রাম কলেজের অঙ্গন হলো হারিয়ে যাওয়ার। কলেজের প্রাক্তনী আমি এই লিরিকের সাথে গুনগুনিয়ে, পার্ট বা ডাট যাই হোক না কেনো তা নিয়ে হারিয়ে যেতে চাই।
‘হারিয়ে যেতে যেতে অজানা সংকেতে ছাড়িয়ে গেছি সেই পথ
কখনো মেঘে ঢাকা কখনও আলো মাখা ভুলেছি ভবিষৎ’।
[অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস, ইন্টারনিষ্ট ও নেফ্রোলজীষ্ট, প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধান নেফ্রোলজী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, ও, জিসিপি এলুমনাই ও বৈজ্ঞানিক কন্সালটেন্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, খন্ডকালীন অধ্যাপক পাবলিক হেলথ চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি]
আজিকে এই আকাশ তলে ২০২২। পাতা ৮৭-৯০।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়