Dr. Aminul Islam

Published:
2022-02-28 01:29:44 BdST

বিমান ভ্রমণের তাজা খবর


লেখক


ডা সুকুমার সুর রায়

______________

সকালে যাত্রা ভালোই শুরু হয়েছিলো। আমরা যে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি তার হাতে নাতে প্রমান পাওয়া গেল। বাসা থেকে স্মার্ট ফোনে 'উবারে' যোগাযোগ করতেই ড্রাইভার আব্দুল্লাহ তার মুখচ্ছবি, গাড়ির নম্বর, সম্ভাব্য ভাড়া, এবং আমার বাসায় পৌছাতে তার মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগবে ইত্যাদি তথ্যসহ আমার ফোনের স্ক্রিনে ধরা দিলেন। সম্মতিসূচক বোতাম টিপে দিলে তিনি যথাকালে দোরগোড়ায় হাজির হয়ে আমাকে বিস্মিত করে তুললেন। অতঃপর অবর্ননীয় জ্যাম ঠেলতে ঠেলতে অলি গলি ঘুরে সুড়ুৎ করে গাবতলি বাস টার্মিনালে পৌছে দিয়ে একগাল আকর্ণ হাসি উপহার দিয়ে যেন - 'যে সমস্ত সিএনজি ড্রাইভার গন্তব্যে যেতে নিতান্ত অনিহা প্রকাশ করে থাকে এবং নিদারুন দুর্ব্যবহার করে থাকে তাদের গালে সজোরে চপেটাঘাত করলেন!

পাবনাগামী শাহজাদপুর ট্রাভেলসের কাউন্টারে উঁকিঝুঁকি মারতেই তেনারা সগর্বে বলে উঠলেন' -" এখনই নতুন এসি গাড়ি বিমানের মতো সিট 'পাবনার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে তাত্তাড়ি টিকিট কেটে ল'ন।"
বললাম - ভাই, নন এসি গাড়ি নেই ? সদ্য ফাল্গুনের প্রথম বৃষ্টিপাত হয়েছে, ধূলা বালির কিছুটা হলেও প্রশমন ঘটেছে, গাছ পালা মাঠঘাট বৃষ্টির ছোঁয়ায় অনেকটাই সবুজ হয়ে উঠেছে, গাড়ির খোলা জানলা দিয়ে দুই চোখ মেলে সেই সব উপভোগ করবো, ফাল্গুনি বাতাসের ঝাপটা খাবো তা যদি কিছুটা ধুলি মিশ্রিত থাকে এবং মাথার চুল আঠালো করেও দেয় তাতেও কোন অসুবিধা নেই। বাড়ি যাচ্ছিতো! সাবান শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করে দুপুরে বাড়ির খাবার খেতে পারবো,এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!
" শাহজাদপুর ট্রাভেস'' - অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মোবাইল ফোনে খাজুরে কথা বলতে বলতে নির্বিকার ভাবে বললেন - " নন এসি গাড়ি এর পরে আছে, বিমানের মত এসি গাড়িতে আরামে তাত্তাড়ি বাড়ি যেতে চাইলে তাত্তাড়ি টিকিট নেন, অনলাইনে সব টিকিট বুক হয়ে গেল বলে। অগত্যা দ্বিগুন ভাড়া দিয়ে দুই খানা বিমানের' সিট কিনে স্ত্রীকে নিয়ে লাউঞ্জে বসে রইলাম ।
অত:পর বিমান এলো। ক্রুগন বিমানে আরোহন করার জন্য হাঁক ডাক শুরু করে দিলেন।
বিমানে উঠে সত্যিই সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম! এযে সত্যিই বিমানের মতই বটে। ব্যাগ ব্যাগেজ রাখবার কেবিন খুলতে গিয়ে নাস্তা নাবুদ হতে হলো। পাশের বিশাল বপু ভদ্রলোক যথেষ্ট সহযোগীতা করলেন এমনকি অনেক কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত রইল না। কিছুক্ষন পরে অবশ্য মনে হতে লাগল, বিশাল বপুকে কোথায় যেন দেখেছি! হ্যাঁ, মনে পড়েছে! তিনি স্কয়ার ফার্মা কোম্পানির উর্ধতন মার্কেটিং কর্মকর্তা । তিনি আমাকে চিনতে পারেন নাই। তাতে যথেষ্ট মঙ্গল হয়েছে। তাঁর সাথে প্যাঁচাল চলতে থাকলে এই লেখালেখির প্রতি অখন্ড মনোযোগ নিঃসন্দেহে বিঘ্নিত হতো।
বিমানে উঠবার কিছুক্ষন পরেই এক বোতল জল ও একখানা দৈনিক খবরের কাগজ সরবরাহ করা হল । প্রথমে ভেবেছিলাম খবরের কাগজ কোন পত্রিকার হকার দিচ্ছে। পয়সা দিয়ে 'ফকা মার্কা ' পত্রিকা কিনবো না বলে তা প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিলাম। যখন বুঝলাম বিমান কোম্পানি সরবরাহ করছে বিনামুল্যে, তখন মাগনা আলকাতরা খাবো বলে তা একেবারে লুফে নিলাম।
অত:পর যাত্রা শুরু হলো।
প্রথমে ভালই গতিতে উড়াল দিলো। পর্দা সরিয়ে কাঁচের জানলা ভেদ করে বাইরের বৃষ্টিস্নাত গাছ গাছালি দেখতে লাগলাম। আমার স্ত্রীও নন এসি বাস ও ধুলার বদলে নতুন এসি বাসের নরম গদিযুক্ত সিটে বসে আহ্লাদিত হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই আরামের ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়তে লাগল। কিছু সময় পরে আমারো চক্ষু মুদে আসতে লাগল। ভাগ্য অতীব ভালো যে গাবতলি বিমান বন্দরে অসাধু পরিবহন শ্রমিকদের খপ্পরে পড়ে নাস্তা নাবুদ হতে হয় নাই। বাড়ি হতে বের হয়ে ডিজিটাল ' উবার' সার্ভিসের' আব্দুল্লাহ ড্রাইভারের স্মিত হাসি, উবার হতে নেমেই "শাহজাদপুরট্র‍্যাভেলস" এর স্ক্যানিয়া এসি গাড়িতে উঠে 'বিমানের 'স্বাদ আস্বাদন করতে করতে মনে হতে লাগলো আহা! দেশ অনেক এগিয়ে গেছে! আমরা সত্যিই ডিজিটাল জমানায় প্রবেশ করেছি! খুব শিগগীরই আমরা উচ্চ মধ্যবিত্ত দেশে পরিনত হতে যাচ্ছি। যারা নিম্নবিত্ত থাকবে তারাও 'উপচে পড়া ' অর্থনীতির সুফল ভোগ করতে থাকবে... এইসব সুন্দর আশার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলো জব্বার ভাইয়ের কর্কশ ফোনের শব্দে। তিনি বেমক্কা জিজ্ঞেস করলেন বাড়িতে পৌছেছি কিনা?
প্রথমে ঘড়ি দেখলাম। বিকাল তিনটা বাজে। দশটায় বিমানে চেপেছি। পাঁচ ঘন্টা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। তবে কি ঘুমের ঘোরে আমার বাড়ি পাড় হয়ে গিয়েছি? দেখলাম বিমান মাটিতে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সাইনবোর্ড খুঁজতে লাগলাম। স্পষ্ট অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড দেখতে পেলাম - " মা হোটেল " আশুলিয়া, সাভার, ঢাকা!
কী আশ্চর্য কথা!পাঁচ ঘন্টা বিমান ভ্রমণ করার পর মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে!
" মা হোটেলের " সাইনবোর্ড এবং সেই সাইনবোর্ডে গরু, ছাগল, মুর্গী ও কাতল মাছের ছবি দেখে পেটের ক্ষিধা চাগাড় দিয়ে উঠলো। বাড়িতে পৌছে লাঞ্চ করার কথা ছিল।বিকালে চেম্বারে বসবো বলে ইতিমধ্যে দুই একজনকে বলে দিয়েছিলাম । জব্বার ভাই ফোনে বললেন- বাড়িতে গিয়ে ডিনার 'করতে পারলে তাকেই ভাগ্য বলে মেনে নিতে হবে।'
একথা শুনে পেটের ভিতরে আরো বেশি মোচড় দিয়ে উঠল।
বোঝা গেল, বিমান টেকঅফ করে নাই - মাটি দিয়ে যাচ্ছে! সকাল বেলার ' উবারের ড্রাইভার ' আব্দুল্লাহর ডিজিটাল স্মিত হাসি' ক্রমেই মলিন হতে হতে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে লাগল।
--- সুকুমার সুর রায়।

। 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়