Ameen Qudir

Published:
2017-02-17 01:51:08 BdST

বইমেলা ও একজন চিত্তরঞ্জন সাহা


 

 

দীপংকর গৌতম
_______________________


আঁধার নামুক যতোই আলো আসবেই। বিখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্রকার কিওরেস্তামির সিনেমায় যখন উচ্চারিত হয়- পৃথিবীর সব দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেলেও কোথাও না কোথাও একটি জানালা খোলা থাকে। এই জানালা আমাদের আশা-উদ্দীপনা-সংগ্রামের প্রেরণা জোগায়। বইমেলার ওপর কয়েক বছরে ঘাতকের হামলা আমরা লক্ষ করেছি। এরা লেখক-শিল্পী-সাংবাদিকসহ মুক্তমনাদের হত্যা করতেই শুধু চায় না।

মেলাটাকে বন্ধ করে দিতে চায়। ওরা কোনো কিছু তৈরি করে না। শুধু বন্ধ করে। ওরা অন্ধকার। ওরা ওদের কালোয় ভরে দিতে চায় মুক্ত জানালাগুলো। তারপরও সব হুমকি আতঙ্ককে পায়ে দলে ভাষা শহীদদের স্মরণে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বইমেলা। ভিন্ন দ্যোতনা ছড়িয়ে দিল বইমেলা প্রাঙ্গণ মুখরিত, মানুষের মনে নতুন আশা। সারাদেশ থেকে আসছেন লেখক বইপ্রেমীরা। কত আড্ডা, নতুন বই স্মৃতিচারণের কত আয়োজন। দূর গ্রাম থেকে একটি লিটলম্যাগ নিয়ে এসেছে বন্ধু। ভালোবাসার সর্বোচ্চ প্রকাশ এটি। বিদেশ থেকে আসছে বাঙালিরা বইমেলার টানে। বুলবুল আহমেদ নামে এক সাহিত্যপ্রেমী, কবি কোরিয়া থেকে ৭ দিনের জন্য এসেছিলেন একটি বইপ্রকাশ করতে।

ফেরারি তার কবিতার বই। প্রকাশ করেই দেশ থেকে চলে গেছেন। যেতে ইচ্ছে করছিল না। ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ায় থাকতে পারেনি। যে বন্ধু গ্রাম থেকে এসে অত্মীয়-স্বজনকে বিরক্ত না করতে হোটেলে ওঠে। টাকা ফুরিয়ে যায়। আড্ডা? এই টান ফুরায় না। শেষে আত্মীয়ের বাসায় যায়। তারপর টিকতে না পেরে বাড়ি ফেরা। আবার এক বছরের জন্য প্রতীক্ষা। নিঃস্ব হয়েও বইমেলার আড্ডা, নতুন বইয়ের গন্ধের মধ্যে থাকার প্রানান্তকর চেষ্টা, এইতো বইমেলা। বাঙালির প্রাণের উৎসব। নতুন বইয়ের গন্ধ জড়ানো মাদকতাময় মাস এটি। বাঙালির প্রাণের মেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।

 

বিগত কয়েক বছর হরতাল, আন্দোলন, জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণে ঠিকমতো জমতেই পারেনি বইমেলা। স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলছিল প্রাণের এ উৎসব। গত বছর থেকেই পুরনো ছন্দে জেগে উঠেছিল বইমেলা। এবারে আর প্রকাশ ভিন্নমাত্রার।

বইমেলা প্রাঙ্গণকে যেভাবে সাজানো হয়েছে তা দেখলে মন ভরে যাবে সবার। মেলার বিন্যাসে নতুনত্ব আনা হয়েছে। সারা মেলায় ছড়িয়ে রাখা হয়েছে প্যাভিলিয়ন। আর প্যাভিলিয়নকে কেন্দ্র করে স্টলগুলোকে গুচ্ছ গুচ্ছভাবে বিন্যাস করায় প্রতিটি গুচ্ছই প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। প্রতি বছর ঘিঞ্জি-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা স্টল দেখে বিরক্ত হন যারা এবার তাদের অবাক হবার পালা। শুধু বই কেনার জন্যই নয়, কিছু সময় কাটানোর জন্য, আড্ডা দেয়ার জন্যও অনেক জায়গা রেখেছে মেলা কর্তৃপক্ষ।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বইমেলাকে এতটাই সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে যে, ভিড়ে ঠেলাঠেলি করবার প্রয়োজন পড়ে না। মেলায় ঘুরে বেড়ানোর, স্টলে স্টলে ঘুরে ক্লান্ত লাগলে আছে বসে জিরিয়ে নেয়ার বেঞ্চ। বইমেলার দ্বার উন্মোচন হতেই তোড়ের মতো ছড়িয়ে পড়লো অসংখ্য বইপ্রেমিক। প্রাণের মেলা বইয়ের মেলা পরিণত হলো মানুষের মেলায়। এই যে এত আয়োজন, নতুন প্রকাশনা, এত অনুষ্ঠান আয়োজন, উদ্বোধনের এত ঘটা- এসব কিছুই তো পাঠককে উদ্দেশ করেই। সেই পাঠকের আগ্রহ নিয়ে মেলায় ছুটে আসা ভরিয়ে দেয় প্রাণ। সাধারণ দর্শনার্থীর জন্য মেলা উন্মুক্ত করার অনেক আগে থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও দোয়েল চত্বর এলাকায় জড়ো হয় অনেক দর্শনার্থী, যাদের অধিকাংশই তরুণ। চলে রাত দিন আড্ডা। বিভিন্ন বয়সীদের আড্ডা, সারা দেশ থেকে আসা সাহিত্যরসিকদের আড্ডায় প্রাণ ভরে যায়। প্রাণের মেলার এ আয়োজন লক্ষণীয়।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুধু বাংলাদেশের যে কোনো মেলাকে ছাপিয়ে তার সুদৃঢ় স্থান তৈরি করেনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ মেলা বেশ পরিচিত। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করায় অমর একুশে গ্রন্থমেলাও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। আজকের এই সর্বজনীন ব্যাপ্তি গ্রন্থমেলার সূচনাটা ছিল খুবই সাধারণ।

মেলা ও একজন চিত্তরঞ্জন সাহা

আজকের এই মেলায় ফুটে উঠেছে একজন সৃজনশীল বই প্রকাশকের জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম। জ্বলে উঠেছে তার জীবনের প্রত্যাশার প্রদীপ। তিনি হলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।

১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা এই মেলার সূচনা করেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মানুষ যখন নিজেকে গোছাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই মানুষের মাঝে আলো জ্বালাতে চিত্তরঞ্জন সাহা চট বিছিয়ে বসে পড়লেন বই নিয়ে। কতটা বইপ্রেমী এবং মানব কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন এ থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বইপ্রেমিক এই মানুষটি ১৯২৭ সালে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কৈলাশ চন্দ্র সাহার ছিল কাপড়ের ব্যবসা। কাপড়ের ব্যবসা ঐতিহ্যগতভাবেই ছিল তাদের পরিবারের। কিন্তু সেই ঐতিহ্য ভাঙলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৪৮ সালে চৌমুহনী কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর শুরু করলেন বইয়ের ব্যবসা।

চৌমুহনীতে একটা বইয়ের দোকান পরিচালনার মধ্য দিয়ে তার ব্যবসায়িক জীবনের সূচনা। ওই দোকানে প্রধানত স্কুলের পাঠ্যবই ও নোটবই বিক্রি করতেন।

এরপর বাসন্তী প্রেস নামে একটি ছাপাখানা ক্রয় করেন। নাম বদল করে রাখলেন ছাপাঘর। এর পাশাপাশি পুস্তক বাঁধাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তিনি এ ব্যবসা ঢাকায় সম্প্রসারিত করেন। ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা প্রেস নামে একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। এর পাশাপাশি গড়ে তোলেন ‘গ্রন্থঘর’ নামে একটি বইয়ের দোকান। এ দোকানে বিক্রি হতো হিন্দু অর্থাৎ সনাতন ধর্ম সংক্রান্ত বইপত্র। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন পাঠ্য পুস্তক ও নোট বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা পুঁথিঘর লিমিটেড।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দেশে শুরু হলো পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি গণহত্যা ও নির্যাতন। চিত্তরঞ্জন সাহা তখন সাহিত্যিক সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর পরামর্শে আগরতলা হয়ে কলকাতা চলে যান। তখন কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিল অসংখ্য বাঙালি। তাদের মধ্যে বাঙালি সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীও ছিলেন অনেক। তাদের পরামর্শেই চিত্তরঞ্জন সাহা উদ্যোগ নিলেন বাংলাদেশের লেখকদের সৃজনশীল বই প্রকাশের। সূচিত হলো স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ মুক্তধারার। এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথম দুটি বই প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ কথা কয় এবং রক্তাক্ত বাংলা নামে দুটি সংকলন গ্রন্থ।

চিত্ত বাবুর অবিস্মরণীয় এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত হলেন চিত্র নির্মাতা ও সাহিত্যিক জহির রায়হান, সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি-ঔপন্যাসিক আহমদ ছফাসহ অনেক লেখক-সাংবাদিক-কবি-সাহিত্যিক।

 

মুক্তধারা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের ৩২টি বই। ওই ৩২টি বই ছিল বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অভিব্যক্তি। আর এই বই নিয়েই শুরু হয়েছিল আজকের ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থমেলা।

চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বটতলায় চটের ওপর মাত্র ৩২টি বই নিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এ বইয়ের সবগুলোই মূলত শরণার্থীদের লেখা।

প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালে ‘মুক্তধারা’র নাম ছিল ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’। এ বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান।

এরপর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা একাই বইমেলা চালিয়ে যান। তার দেখাদেখি ১৯৭৬ সালে অন্য প্রকাশকরাও অনুপ্রাণিত হয়ে বইমেলায় যুক্ত হন। পরে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হয়, ‘বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি’। এ সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।

১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজনের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু এ বছর তৎকালীন ক্ষমতাসীন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি।

 

এর পরের বছর ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র সূচনা হয়। এরপরই বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় পূর্ণরূপ পায়। তারই পরিণত রূপ আজকের বইমেলা। কিন্তু ভাষা শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত এ বইমেলা, যেভাবে শুরু হয়েছিল, সে আবেশে আর নেই। বইমেলাটা হওয়া উচিত মননশীল প্রকাশকদের আয়োজনে। তা না হয়ে এটি বাংলা একাডেমির দায়িত্বে থাকায় মেলাসর্বস্ব হয়ে উঠছে এই মননশীল প্রতিষ্ঠানটি। অভিধান বিক্রি আর বছরে একটি বইমেলা ছাড়া এদের আর কাজ নেই। এর কর্তাব্যক্তি সরকারের লবির হওয়ায় যে সরকার ক্ষমতায় থাকে ওই সরকারের লোকজনের প্রভাব, অযোগ্যদের দলীয় টিকিট দেখিয়ে বই প্রকাশের চর্চা ছাড়া এল ফড়িয়াগিরি। যা রীতিমতো লজ্জাকর। বাংলা একাডেমি পুরস্কারও একটি হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এখানে গবেষণার সঙ্গে সৃজনশীল লেখকদের লেখা প্রকাশ না করলে এ প্রতিষ্ঠান অচিরেই হতদরিদ্র একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। যেটা হবে আত্মঘাতী একটি ঘটনা। বিষয়টি নিয়ে দেশের বিশিষ্টজনদের ভাবা উচিত। বাংলা একাডেমি কি শুধু বইমেলার ফড়িয়াগিরি করবে নাকি মননশীল প্রকাশনা কাঠামো নির্মাণের সঙ্গে জরুরি সব গবেষণা কাজ করবে সর্বোপরি একটি গ্রন্থমেলা সংঘটনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে।

আমরা চাই, লেখক প্রকাশক হত্যার ক্ষত বুকে নিয়ে দাঁড়াবে বইমেলা, বাংলা একাডেমি। সব অন্ধকারকে অতিক্রম করে আমরা গাইবো তিমির বিনাশী গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…’

_____________________________

লেখক দেশের প্রখ্যাত কবি ও সাংবাদিক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়