Dr.Liakat Ali

Published:
2021-12-30 23:29:46 BdST

ঝালকাঠির লঞ্চ দুর্ঘটনা এবং আমার অতীত কিছু অভিজ্ঞতা


লেখক

 

 

ডা. সুরেশ তুলসান
-------------------------------------
-কয়েকবছর আগের কথা, একটা ট্রেনিং প্রোগ্রামের জন্য গিয়েছিলাম থাইল্যান্ডে। একদিন আমরা সদলবলে বের হলাম একটা প্লেজার ট্যুরে। এরই অংশে হিসাবে একদিন বোটে করে কয়েকটি দ্বীপে ভ্রমণ। সমুদ্র লাগোয়া অপরুপ সুন্দর ছোট্ট শহর কাবি থেকে যাত্রা শুরু। সারাদিন কয়েকটি দ্বীপে ভ্রমণ শেষে পরবর্তী গন্তব্য ফুকেট। বোটে উঠার আগ মুহূর্তে আমাদের গাইড আমাদের সকলকে গোল করে দাঁড় করিয়ে সমুদ্র ভ্রমন কালীন সম্ভাব্য বিপদ, সাবধানতা, এবং করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন, বেশ নাটকীয় ভংগিমায় অভিনয় করেই। শুরুতেই বললেন এই সময়ের আবহাওয়া এই ছোট্ট বোটে সমুদ্র যাত্রার জন্য মোটের নিরাপদ না বরং বিপদজনক। কিন্তু মালিকদের তো টাকাই সবকিছু। তারা হলেন ব্যাবসায়ী। ব্যাবসা ছাড়া কিছু বোঝেন না। নিরাপত্তা না, বরং ব্যাবসা-ই তাদের কাছে মুখ্য। আরও বললেন- "লাস্ট উইক ওয়ান বোট সিংকিং, এভরি পিপল সুইমিং, নো পিপল ডাই"। বলেই তার সারা গায়ে অর্ধ শুকানো অসংখ্য বিভৎস ক্ষতগুলো দেখিয়ে বললেন, সেই বোটে তিনিও ছিলেন। দুর্ঘটনার পর আজই প্রথম আবার সমুদ্র যাত্রায় যাচ্ছেন। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই তাকে কাজে যেতে হচ্ছে, কারণ অন্যথায় মালিক তাকে বেতন দিবেন না। ভয়ে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। বোটে উঠার সময় বোটের চেহারা, আর গাইডের কথাবার্তা সবমিলিয়ে মনটা কোন মতেই সায় দিচ্ছিলো না বোটে উঠার জন্য। কিন্তু নিরুপায়, দলের সকলেই সমুদ্র ভ্রমন শেষে ফুকেটে রাত্রী যাপন করে সেখান থেকেই ব্যাংককে ফিরে যাবেন, তাহলে তো আমাকে একাই থাকা লাগবে কাবি-তে। অগ্যতা বাধ্য হয়েই সকল ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে সদলবলে বোটে চেপে বসলাম। কিছুক্ষণ পরেই টের পেলাম সামান্যতম বিরুপ আবহাওয়াতেই সমুদ্র কতটা ভয়ংকর হতে পারে এধরণের ছোটখাটো বোটের জন্য। বিরুপ আবহাওয়ার কারণে আমাদের ট্যুর কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে একটা দর্শনীয় দ্বীপ ভ্রমণ তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেল। বারবার মনে পড়ছিলো গাইডের সেই কথাগুলো - "লাস্ট উইক ওয়ান বোট সিংকিং, এভরি পিপল সুইমিং, নো পিপল ডাই" আর গাইডের সারা শরীরের আধা শুকানো অসংখ্য সেই ক্ষতগুলো।

এবার আসি পাতাং বিচের ঘটনা। পারাগ্লাইডিং করছিলাম দলের সকলে। স্পিডবোটে টানা প্যারাসুটে মাত্র কয়েক মিনিটের উড়ান, এক হাজার বাথ (বাংলাদেশের ২৬৫০/- টাকা)। এক এক করে এলো আমার পালা। ভয়ার্ত শুকনো গলায় বললাম, ফিতা আর লকগুলো একটু ভালোভাবে লাগান। উত্তরে উনারা যা বললেন তার অর্থ এই যে তাদের দেশে পর্যটন আইন খুবই কড়া। দুর্ঘটনায় কোন পর্যটক মারা গেলে মোটা টাকার জরিমানা গোণা লাগে। টাকার অংক শুনে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ আর জীবন প্রায় খাঁচাছাড়া। জরিমানার পরিমান বাংলাদেশি টাকায় মাত্র আট হাজার !!! তাদের মাত্র কয়েকটি পারাগ্লাইডিংয়ে অল্প সময়ের আয়ের সমান। তা সে যাই হোক, কয়েক মিনিটের পারগ্লাইডিং এর উড়ান বেশ নিরাপদেই শেষ করতে পারলাম। শুধু শেষ করলাম এটাই না, পুরো উড়ান টাই ডিজিটাল ক্যামেরায় ভিডিও বন্দী করে ফেললাম। ভাগ্যিস কোনরকম কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমার জীবন যেতে পারতো। তবে কেন যেন মনে হলো, এটা বড় কথা না, ওদেরকে প্রায় আট হাজার টাকা জরিমানা গোণা লাগেনি এতেই স্বস্তি। তবে দেশে ফেরার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই শুনলাম-" থাইল্যান্ডের পাতাং বিচে দড়ি ছিড়ে পারাগ্লাইডিং দুর্ঘটনা, এক ভারতীয় নারীর মৃত্যু "।
স্বস্তির ঢেকুর তুলে ভাবলাম, বন্দুকের গুলিটা কানের গোড় দিয়ে বেড়িয়ে গেল।
সেই বাচ্চাকাল থেকেই প্রতিনিয়তই রেডিও, টিভি, পত্রিকার পাতায় দেখে আসছি দেশের অসংখ্য দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর মিছিল। আজ অবধি একটি ঘটনারও সুষ্ঠু বিচার আর শাস্তি পেতে দেখিনি কাউকে।

উপযুক্ত আইন, আইনের প্রয়োগ, তদারকি, এবং সুষ্ঠু তদারকির জন্য উপযুক্ত বডি আর ব্যাবসায়ীদের ব্যাবসা সুলভ নিষ্ঠুর মনোবৃত্তির পরিবর্তন সেই সাথে ব্যাপক হারে জনসচেতনতা ছাড়া দেশে এই দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর মিছিল সমানতালে চলতেই থাকবে।
আমরা শুধু চোখ মেলে দেখবো আর কান পেতে শুনবো। আর বুকের গভীরে একরাশ ক্ষত নিয়ে অপেক্ষায় থাকবো, কবে-কখন আমার বা আমাদের পালা।

ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়