SAHA ANTAR

Published:
2021-11-14 23:30:50 BdST

রবীন্দ্রনাথ যে দিনে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন


 

রাজিক হাসান
লন্ডন থেকে
__________________
১৩ নভেম্বর ১৯১৩ সাল। এই দিনে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

নোবেল পাওয়ার আগে থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কবিকে বাক্তিগত আক্রমণ করে ব্যাঙ্গাত্মক নাটক লিখেছিলেন এবং ঘটা করে তার প্রদর্শনীও করান! নিরোদ সি চৌ লিখেছিলেন তার এন্ট্রান্স পরীক্ষার একটা প্রশ্ন নাকি ছিল রবীন্দ্রনাথের গদ্য শুদ্ধ বাংলায় লেখো!

১৫ নভেম্বর ১৯১৩ রবীন্দ্রনাথ খবর পেলেন, ১৯১৩ সালের সাহিত্যের নোবেল প্রাইজ তাঁকেই প্রদত্ত হয়েছে। এই টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। শুভসংবাদ বহন করে নিয়ে এলেন জামাতা নগেন্দ্রনাথ।
এরপর রবীন্দ্রনাথকে দেয়া সংবর্ধনায় তিনি জানান,

“এই সম্মান আমার পক্ষে এক বিষম পরীক্ষার বিষয় হইয়াছে। পাবলিক উত্তেজনার যেঘূর্ণীবায়ু উঠিয়াছে, তাহা বিভীষিকাময়। একটি কুকুরের লেজে টিন বাঁধিয়া দিলে, বেচারা নড়িলেই যেমন শব্দ হয় এবং চারিদিকে লোকের ভীড় জমে, আমার দশা তদ্রূপ। গত কয়েকদিনের টেলিগ্রাম ও পত্রের চাপে আমার শ্বাস বন্ধ হইয়া আসিতেছে। যে সব লোকের আমার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নাই বা যাহারা আমার রচনার একটি ছন্দও পড়ে নাই তাহারাই তাহাদের আনন্দ জ্ঞাপনে সর্বাপেক্ষা অধিক মুখর। এই সব উচ্ছ্বাস আমাকে যে কি পরিমাণ ক্লান্ত করিয়াছে তাহা বলিতে পারি না। সত্য কথা কি, ইহারা আমি যে সম্মান লাভ করিয়াছি সেই সম্মানকে সম্মান দেখাইতেছে আমাকে নহে।”

শান্তিনিকেতনেও তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বহু জ্ঞানী গুণী মানুষ সেখানে এসে কবিকে শ্রদ্ধা জানান। তিনি বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন,
“কবি বিশেষের কাব্যে কেউ বা আনন্দ পান, কেউ বা উদাসীন থাকেন, কারো বা আঘাত লাগে এবং তারা আঘাত দেন। আমার কাব্য সম্বন্ধেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় নি। দেশের লোকের হাত থেকে যে অপমান ও অপযশ আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে, তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয় নি এবং এতকাল আমি নিঃশব্দে তা বহন করে এসেছি। এমন সময় কি জন্য যে আমি বিদেশ হতে সম্মান লাভ করলুম তা এখন পর্যন্ত আমি নিজেই ভাল করে উপলব্ধি করতে পারি নি। আমি সমুদ্রের পূর্বতীরে বসে যাকে পূজার অঞ্জলি দিয়েছিলেম তিনিই সমুদ্রের পশ্চিমতীরে সেই অর্ঘ্য গ্রহণ করবার জন্য যে তাঁর দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করেছিলেন সে কথা আমি জানতুম না। তাঁর সেই প্রসাদ আমি লাভ করেছি এই আমার সত্য লাভ। যাই হোক, যে কারণেই হোক আজ ইউরোপে আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন তার যদি কোন মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের মধ্যেই আছে। আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোন আন্তরিক সম্বন্ধ নেই। নোবেল প্রাইজের দ্বারা কোন রচনার গুণ বা রসবৃদ্ধি করিতে পারে না। অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করব? এ সম্মান আমি কতদিনই বা রক্ষা করব? আমার আজকের এদিন তো চিরদিন থাকবে না; আবার ভাঁটার বেলা আসবে, তখন পঙ্কতলের সমস্ত দৈন্য আবার তো ধাপে ধাপে প্রকাশ হতে থাকবে। তাই আমি আপনাদের কাছে করজোরে জানাচ্ছি, যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় করে নেব, কিন্তু যা সাময়িক উত্তেজনার মায়া, তা আমি স্বীকার করে নিতে অক্ষম। যিনি প্রসন্ন হলে অসম্মানের প্রত্যেক কাঁটাটি ফুল হয়ে ফোটে, প্রত্যেক পঙ্কপ্রলেপ চন্দনপঙ্কে পরিনত হয়, এবং সমস্ত কালিমা জ্যোতিষ্মান হয়ে ওঠে তাঁরই কাছে আজ আমি এই প্রার্থনা জানাচ্ছি তিনি এই আকস্মিক সম্মানের প্রবল অভিঘাত থেকে তাঁর সুমহান বাহুবেষ্টনের দ্বারা আমাকে নিভৃতে রক্ষা করুন”।

রবীন্দ্রনাথের এই বক্তৃতায় অতিথিরা অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং কলকাতার সংবাদ পত্রে অনেক দিন ধরে এই নিয়ে সমালোচনা চলে। কিন্তু কবি তাঁর ভাষণের জন্য জবাবদিহি বা দুঃখপ্রকাশ করেন নি।##

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়