SAHA ANTAR

Published:
2021-10-25 22:34:21 BdST

"তুই কী করে রক্ত দিলি ওই অমানুষটাকে!"


লেখক

 

 

রাজিক হাসান
লন্ডন থেকে
_____________

 

জামরুল গাছের ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো ঠিকরে পড়ছে মাটিতে। অদ্ভুত এক ছায়া নকশা তৈরী হয়েছে সেখানে। সেই নকশার দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে অরুন কবিরাজ। টুইট শব্দ করে অর্জুন গাছ হতে উড়ে গেল একটি পাখি। পাখির শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। এবার তার মনোযোগ পড়ল তুলসী ঝোপের উপর হলুদ প্রজাপতিদের দিকে। মনটা তার ভরে গেল এক অপার্থিব আনন্দে। পারিবারিক এই বাগান যেন রাজ্যের সব আনন্দ নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে। তাই বহুদিন যাবৎ বাগানটাতে রোজ তার আসতে ভালো লাগে। অরুন কবিরাজ আজ এসেছে বাগানে বাসক পাতা নিতে। জেলে পাড়ার গোপাল মাঝির ছেলের জন্য কাশির ঔষধ বানাতে হবে। বাগানের পশ্চিম দিকে বাসক ঝোপের দিকে এগিয়ে গেল কবিরাজ। ঝোপের আড়ালে একটি মানুষের দেহ দেখে আঁতকে উঠলো সে। ভালো করে চোখ কচলে নিল, নাহ চোখে কোন ভুল দেখছে না সে। কাছে গিয়ে দেহটাকে উল্টে দিল সে। এ যে চাকু রতনের দেহ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। নাকের কাছে হাত নিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস যাচাই করে নিল কবিরাজ। এখনও জীবন আছে। এই দুর্ধর্ষ ছেলেটার কে এই হাল করল?! আর কেনই বা এখানে ফেলে গেলো, এই বাগানে! ভোরের নীরবতা ভেঙে চিৎকার দিয়ে কবিরাজ ছুটলো তার বাড়ির দিকে। অনিল, অনিল, চিৎকারে বেরিয়ে এলো তার নাতি অনিল কবিরাজ। কলেজ পড়ুয়া অনিল বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো চাকু রতনের দিকে। বিস্ময় ভেঙে জিজ্ঞাসা করল, আমরা এখন কি করব দাদু ভাই।

কবিরাজ বললো, চল ঘরে নিয়ে যাই। আর কথা না বাড়িয়ে চাকু রতনের দেহ ঘরে নিয়ে গেল তারা দুজনে। তারপর শুরু হল অরুন কবিরাজের কবিরাজি। চাকু রতনের সব ক্ষত পরিষ্কার করে বেঁধে দেওয়া হল খুব যত্ন করে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি তার। মাঝে মাঝে গোঙানির মত শব্দ করছে সে। কবিরাজ চাকু রতনের মাথার কাছে বসে আছে। অনিলকে বাইরে পাঠালো চাকু রতনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে।

মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগের কথা। তখন নির্বাচনের মৌসুম। দুষ্টলোক জমিরের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিল চাকু রতন। প্রচারণা না বলে অত্যাচার বলাই ভালো। এই গ্রামের উত্তর পাড়ায় বহু বছর যাবৎ সহবস্থান পাল, কবিরাজ আর ঘোষদের। কয়েক ঘর মুসলমান চাষীও মিলেমিশে ছিল।

গ্রামের উত্তর পাড়ার সাথে অন্য পাড়ার সম্পর্ক ভালো ছিল। তবু সময়ের আবর্তে বহু পুরানো জিনিস হারিয়ে যাবার মত সেই সুসম্পর্কটাও হারিয়ে গেল। ঘোষদের ছানা, সন্দেশ খেয়ে বড় হওয়া ছেলেপিলে উত্তর পাড়ার লোকদের বলতে লাগলো সংখ্যালঘু। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে এলো বাড়তে লাগলো তাদের নির্যাতন। চাকু রতন আর তার দলবলদের হাতে উত্তর পাড়ার পালদের হাড়ি ভাঙলো আর উল্টে পড়লো ঘোষদের দুধের বালতি।

এই চাকু রতনই একদিন অরুন কবিরাজকে এসে বললো, "জমির ভাইরে ভোট দিয়েন। নইলে মালোয়ানদের দ্যাশে পাঠাইয়া দিমু।" কবিরাজের দেশ তো বাংলাদেশ। আর কোনো দেশ তো সে চেনে না। তবু কোথায় পাঠাতে চায় তাকে রতন? আজও তার উত্তর পায়নি কবিরাজ।

এতো কিছু ভাবতে গিয়ে কোথা দিয়ে যে সময় গড়িয়ে গেল টের পায় নি কবিরাজ। ঝড়ো বাতাসের মত এসে সামনে দাঁড়ালো অনিল। হাঁপাতে হাঁপাতে জানালো যে, চাকু রতন গতকাল বিকেল থেকে নিখোঁজ। সে আরও জানালো, "তুমি ভয় পেয়োনা দাদু, চাকু রতনের বাসায় গিয়ে আমি সব বলে এসেছি।" কিছুক্ষন পর চাকু রতনের পরিবার আর চ্যালারা এসে হৈ হৈ করে তাকে নিয়ে গেল কবিরাজের বাসা থেকে। কেউ এতটুকু ধন্যবাদ সূচক কিছু বলার প্রয়োজনই মনে করল না।

এই বাড়ির প্রতিটা সকাল সন্ধ্যা একই রকম। বহুদিন পর একটা সকাল শুরু হয়েছিল আতঙ্ক নিয়ে। ঠিক যেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতন। তখন প্রতিটি দিন শুরু হত আতঙ্ক নিয়ে। আজ আর সে দিন নেই। দেশ তো স্বাধীন। তবু কোথায় সেই শান্তি আর কোথায় সেই স্বাধীনতা?

সন্ধ্যে বেলা অরুন কবিরাজ তার নাতিটিকে নিয়ে গেল হাসপাতালে চাকু রতনকে দেখতে। অসুস্থ রতনকে আর তেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে না। তার বউ মাথার কাছে বসে মিহি সুরে কাঁদছে। এমন সময় ডাক্তার এসে বললো, "বি নেগেটিভ রক্ত লাগবে। রক্ত জোগাড় করুন। এখুনি লাগবে, অন্তত তিন ব্যাগ। রোগীর শরীর থেকে প্রচুর রক্ত চলে গিয়েছে। নিস্তব্ধতা নেমে এলো সমস্ত ঘরে। রতনের এক চ্যালা বলে উঠলো, "আমাদের রক্তের গ্রূপ কী তাই তো জানি না, রক্ত দিমু ক্যামনে ?" হঠাৎ অনিল বলে উঠলো, আমি রক্ত দিমু, আমার গ্রুপ বি নেগেটিভ। সবাই বিস্ময়ে তাকালো অনিলের দিকে।

বাড়ি ফেরার সময় অরুন কবিরাজ তার নাতিকে বলল, "তুই কী করে রক্ত দিলি ওই অমানুষটাকে!"

অনিল হেসে বলল, "অমানুষ হলেও সে তো রক্ত-মাংসেরই মানুষ দাদু।"

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়