Dr.Liakat Ali

Published:
2021-10-19 02:26:03 BdST

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অফিস আদালতের অব্যবহৃত জমিগুলো হয়ে উঠুক পশুপাখিদের ছোটখাটো অভয়ারণ্য


লেখক

 

ডা. সুরেশ তুলসান
__________________

দেশের সকল পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিস আদালতের অব্যবহৃত জমিগুলো হয়ে উঠুক বন্য পশুপাখিদের ছোটখাটো এক একটি অভয়ারণ্য।
-------------------------
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস্ করলে তাড়া,
বলি থাম্ একটু দাঁড়া।
------
সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ভাইরাল খবর পড়েই কবিতা টি আমার মনে পড়ে গেল।
খবরটা হলো,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর ক্যাম্পাস এ রোকেয়া হলের পিছনে লিচু বাগান থেকে লিচু পাড়তে গিয়ে ( যদিও খবরে লিখেছে চুরি করতে গিয়ে) বাগানের লিজ গ্রহীতাদের হামলায় দুই ছাত্র মারাত্মক আহত। এর মধ্যে একজন ছাত্রের এর দুই হাতই ভেংগে দেয়ে হয়েছে, আরেক জনের মাথায় এবং পায়ে জখম হয়েছে।
এরপর মামলা হয়েছে সেই সব লিজ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে যারা ছাত্রদের মারধর করেছে।
তারপর ছাত্রদের সদলবলে সেই বাগানের সমস্ত লিচু লুটপাট।
এরপর লিজ গ্রহীতারা হয়তো পালটা মামলা করবে চুরি অথবা ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য এর জন্য, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

উপরের কবিতার পঙক্তিগুলো জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম এর বিখ্যাত কবিতা "লিচু চোর" এর থেকে নেয়া।
কাজী নজরুল ইসলাম এর বিখ্যাত কবিতা গুলির একটি হলো এই কবিতা।
সেই সাথে মনে পড়ে গেলো আমাদের মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের একটি ঘটনা। ক্যাম্পাসে সামান্য কয়েকটি আমগাছ, তা আবার দেয়া হলো লিজ।
ঘটনা যা হবার ছিলো তাই হলো।আমাদের কয়েকজন ছাত্রের সাথে আম পাড়া নিয়ে লিজ গ্রহীতাদের গোলমাল হাতাহাতি অনেকে কিছু।
পরের বছর অবশ্য লিজ না দিয়ে একটি কমিটির মাধ্যমে আমগুলো পেড়ে উৎসবমুখর পরিবেশে হলের রুমে রুমে বিলি করা হয়েছিল।
তবে নিসন্দেহে কাজটি ছিলো বিশাল ঝক্কি ঝামেলার এবং এটা বাস্তবে সবসময় সব প্রতিষ্ঠানে সম্ভবও না।
৩০৩.৮ হেক্টর আয়তনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর ক্যাম্পাস নিসন্দেহে দেশে সেরা শিক্ষায়তন এর ক্যাম্পাস।
প্রকৃতির কোলে লালিত এই ক্যম্পাসকে অনেকেই আদর করে মতিহারের সবুজ চত্ত্বর বলে ডাকেন।
প্রচুর গাছগাছালি আর প্রাকৃতিক সম্পদ আর সৌন্দর্যে ভরপুর এই ক্যাম্পাস।
ক্যাম্পাসে প্রচুর বনজ ও ফলজ গাছপালা আছে।
সাথে আছে পুকুর, ডোবা আর জলাভূমি। যেন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম।

এত্তোবড় এই ক্যাম্পাস নিশ্চয়ই চাষাবাদ জন্য করা হয় নাই। করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য আর মননশীলতার বিকাশের জন্য।

যদি বানিজ্যিকভাবে চাষাবাদই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে তো এখানে কৃষি খামারই করা উচিৎ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কেন ?

এই ক্যাম্পাসের একজন শিক্ষার্থী অবশ্যই এই ক্যাম্পাসকে নিজের মনে করে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি মননশীলতার বিকাশ ঘটে তাদের মধ্যে।

আর ক্যাম্পাসে ফলজ গাছপালা থাকলে শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে ফল আহরণ করবে এটাই স্বাভাবিক।
ফল আহরণ করে খাওয়ার জন্য কোন শিক্ষার্থীকে ভৎসনা করা যেতে পারে। তবে সরাসরি চুরির অপবাদ দিয়ে হাত, পা, মাথা ভেংগে দেয়া একেবারেই অন্যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাগান লিজ না দিলে তো আর এই গ্যাঞ্জামটা বাধতো না।
লিচু বাগান লিজ দিয়ে কটা টাকাই বা আয় হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সারা বছরের বাজেটের তুলনায় এই টাকা নস্যিও না।

কেননা সরকারি বাগান বা গাছপালার লিজ দেয়ার বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা একেবারেই তিক্ত।
এরকম বেশ কিছু নিলামের নাটক দেখেছি।
নিলামের দিন যারা নিলাম ডাকে তারা অনেক সময় জোট বেঁধে খুব অল্প টাকাতেই নিলামে বিক্রি করতে বাধ্য করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কে। পরে লাভটুকু নিজেদের মধ্যে বাটোয়ারা করে নেয়।
তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাগান লিজ দেয় অনেকটা বাধ্য হয়েই।
প্রথমত জবাবদিহিতা আর হিসাব নিকাশ এর স্বচ্ছতা, আর দ্বিতীয়ত এই বাগানগুলো লিজ না ফিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের খাওয়ার জন্য রেখে দিলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যেই মারামারি আর কাটাকাটি করবে।
এছাড়া কোন কমিটি করে বাগানের ম্যানেজমেন্ট সেটা তো আরও বিশাল ঝক্কি ঝামেলা, অনেকটা বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধা।
আরও একটা বিষয়, সেটা হলো, সরকারি প্রতিষ্ঠান সমুহের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যাবস্থাপনায় ছোটখাটো দুর্নীতির সুযোগও থেকে যায়।

তারচে এমন করলে কেমন হয়।
----------
কিছুদিন পূর্বে একটা খবরে দেখলাম খাওয়ার মত ফল এবং বাসস্থানের অভাবে দেশের ফলাহারী পাখি এখন বিলুপ্তির পথে।
তবে প্রকৃত সত্য এই যে শুধু ফলাহারী পাখিই না, পতংগভুক পাখি এবং অন্যান্য ছোট ছোট বন্য প্রাণী যা আমাদের বসতবাড়ির আশেপাশের বাগানে, বনজঙ্গলে বসবাস করতো তাদেরও অনেকেই হয় সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত অথবা বিলুপ্তির পথে।
একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বনভূমির পরিমাণ নুন্যতম ২৫ শতাংশ। অথচ আমাদের দেশের বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৭ শতাংশ।
এবং মাথাপিছু বনভূমির পরিমান মাত্র ০.০১৮ হেক্টর। আর এই বনাঞ্চলের পরিমান দিনের পর দিন কমছে।
ফলে বনজ সম্পদের পাশাপাশি অনেক দেশজ পশুপাখিও আজ বিলুপ্তির পথে। তার মধ্যে সবচাইতে হুমকির মুখে পাখি এবং বিশেষ করে ফলাহারী পাখি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি ফলের চাষের প্রসার ঘটলেও মানুষের নানাবিধ তৎপরতা যেমন নেট দিয়ে ঘিরে রাখা, পাহারা দেয়া, কীটনাশক প্রয়োগ, ফাঁদ পাতা ইত্যাদি কারণে এই ফলগুলো কিন্তু বন্য পশু পাখিদের নাগালের বাইরেই থাকে।
ফলে বাসস্থান এবং খাদ্যাভাবে দেশের ফলাহারী পাখিদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।এদের পাশাপাশি পতংগভূক পাখি এবং অন্যান্য ছোটখাট অন্যান্য বন্য প্রাণীদের অবস্থাও তথৈবচ।

তাই আমার মনে হয় দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান সমুহের ফাঁকা, অব্যাহত জমিগুলো এই সকল ছোট খাটো বন্য প্রাণী এবং পাখিদের অভয়ারণ্য হিসাবে রাখা হোক। এবং বেছে বেছে এমন ধরনের বনজ গাছপালা লাগানো হোক যা এদেকে আশ্রয়স্থল এবং খাদ্য দিবে।
এবং পশুপাখিদের পছন্দের এই ধরনের ফলজ গাছপালা যেমন খুদে জাম , বট, পাঁকুর জাতীয় ফলের গাছ ( আমি এধরণের অধিকাংশ ফলের নামও জানিনা ) লাগানো উচিৎ যা ফলাহারী পাখি এবং পশুদের খাবার জোগান দিবে কিন্তু মানুষের কাছে এই সকল ফলের খাদ্য হিসাবে কোন অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকবে না।
তাহলে মানুষের ক্ষুধাতুর লোলুপ দৃষ্টি পশুপাখি দের এই সব খাদ্যে ভাগ বসাতে পারবে না।
শুধু তাই নহে, যে সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমিতে মানুষের আহারের উপযোগী যেসব ফলের গাছ আছে সেইসব গাছগুলো কেটে শুধুমাত্র পশুপাখিদের খাদ্যের যোগান দেয় এইরুপ গাছপালা লাগানো উচিত।
একই সাথে আমাদের দেশের বিলুপ্তপ্রায় গাছ গুলোও লাগানো যেতে পারে।
আর ছোটখাটো একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী যে যে ক্ষেত্রে দেয়া সম্ভব সেক্ষেত্রে দিতে হবে যেন মানুষ সহজেই এদেরকে বিরক্ত বা এদের কোন ক্ষতি করতে না পারে।
তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও এইসব পশুপাখিদের আমরা বাসস্থান আর খাদ্যের যোগান দিতে পারবো।
কিছুটা হলেও হয়তো রক্ষা করতে পারবো এইসব অভাগা পশুপাখিদের।

এদেরকে চিরতরে বিলুপ্তির হাত থেকে সম্পুর্ণ রক্ষা করতে না পারলেও বিলুপ্তিটা কিছুটা হলেও বিলম্বিত করতে পারবো।

ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়