Dr. Aminul Islam

Published:
2021-10-02 21:18:43 BdST

গান্ধীজির একটি কাল্পনিক ইন্টারভিউ


জিন্নাহ র সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী

 

 

ডা.সুকুমার সুর রায়

প্রাক্তন সহকারী পরিচালক 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা 
________________________________
প্রশ্নকর্তা ঃ
কী বলে যে সম্বোধন করি আপনাকে! আপনি স্বাধীন ভারত রাস্ট্রের জাতির পিতা। আপনি রাজনীতিতে এমন এক অহিংস নীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন যা সারা বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য৷
আপনি যখন জাতির পিতা হননি তখনো কোটি কোটি মানুষ আপনাকে শ্রদ্ধাভরে ' বাপুজি' সম্বোধন করতো। ভারতীয় গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের কোটি মানুষ আপনাকে মহাত্মা বলেই জানে। আমি না হয় আপনাকে ' বাপুজি ' বলেই সম্বোধন করবো।

গান্ধীজি ঃ
হেঃ হেঃ হেঃ, আমার পৈত্রিক নাম মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। অনেকেই আমাকে গান্ধীজি বলে সম্বোধন করে। অনেকেই বাপুজি বলে। আপনার যেমন ইচ্ছা তেমনই আমাকে সম্বোধন করতে পারেন৷

প্রশ্ন কর্তা ঃ আচ্ছা বাপুজি, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। আপনি সারাজীবন অহিংস নীতিতে অটল ছিলেন সেই আপনাকেই কিনা চরম হিংসার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে! আপনার মৃত্যুর পৌনে এক শতাব্দী পরেও বিনা বাক্যব্যয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য সম্মতি প্রকাশ করায় আপনাকে স্বাগত জানাই।

গান্ধীজি ঃ
আপনাকেও অজস্র ধন্যবাদ জানাই। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনে বিশ্বাস করা হয় যে শারীরিক মৃত্যু আত্মার মৃত্যু ঘটায় না। আপাত শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও একজন মানুষের আত্মা, তার আদর্শিক ভাবনা অনাদিকাল টিকে থাকে। তাই আমার শারীরিক মৃত্যুর এতো বছর পরেও আমার নীতি আদর্শের উপযোগিতা রয়েছে এটা জেনে এবং আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করায় আপনাকেও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

প্রশ্নকর্তা ঃ
অহিংসা একটি নীতি। বিভিন্ন ধর্মে এবং দর্শনে অহিংসার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন মনিষীর ভাষ্যেও আমরা অহিংস নীতির কথা শুনতে পাই। আপনি ঠিক কখন থেকে কীভাবে অহিংস নীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন?

গান্ধীজি ঃ
দেখুন, ভারত বর্ষে যে তিনটি প্রধান ধর্মের বিকাশ হয়েছে সেই তিনটি ধর্ম যথাক্রমে 'হিন্দু ধর্ম ', জৈন ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি হলো অহিংসা।
এই সকল ধর্মীয় মূলনীতি আমার জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
গুজরাটের প্রত্যন্ত সুদামাপুরিতে আমার জন্ম হয়েছিলো । সেখানকার সংস্কৃতি ছিলো পুরোপুরি ভারতীয় ধর্ম ও দর্শন নির্ভর সংস্কৃতি। এছাড়া দক্ষিন ভারতীয় প্রাচীন কবি থিরুভাল্লুভার কর্তৃক রচিত ' তিরুক্কুরালে' বর্নিত পবিত্র শ্লোক থেকে আমরা নৈতিকতা, পবিত্রতা, সত্যবাদীতা, সহনশীলতা, বিষয়গুলির শিক্ষা পেয়ে থাকি। এই নৈতিকতা শিক্ষার প্রভাব দক্ষিন ভারত থেকে আমাদের গুজরাট পর্যন্ত অস্তিত্বশীল ছিলো। এর উপরে এক ধরনের পারিবারিক আবহতো ছিলোই।

প্রশ্নকর্তা ঃ
আচ্ছা, আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গঠনে আপনার পরিবারের ভুমিকার ব্যাপারে একটু বলবেন কি?
গান্ধীজি ঃ
অবশ্যই। ধরতে গেলে আমার পারিবারিক আবহই আমার চারিত্রিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলো।
আমার পরিবার ছিলো ধর্মীয় রক্ষনশীল পরিবার। আমার পিতা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন হিন্দু বৈশ্য বর্নের মানুষ। আমার মা পুতলিবাই খাঁটি বৈষ্ণব পরিবার থেকে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন কঠোর নিরামিষভোজী বৈষ্ণব। বাড়িতে ভাগবত পুরান, শ্রীমদভগবদগীতা পঠিত হতো এবং কঠোর অনুশীলন করা হতো।
১৮৮৮ সালে আমি যখন ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে যাই তখন পরিবারের অনেকেই রাজি ছিলেন না। এক পর্যায়ে মা'য়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয় যে ' আমি ইংল্যান্ডে গেলেও কখনো ' মাংস ভোজি' হবো না, মদ স্পর্শ করবো না এবং নারী সংসর্গে যাবো না।

প্রশ্ন কর্তা ঃ আচ্ছা বাপুজি, আপনি অহিংসা বলতে ঠিক কী বুঝাতে চান তা একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?

গান্ধীজি ঃ
অহিংসা' শব্দটি এক বিরাট তাৎপর্য বহন করে।
এটা শুরু হয় একদম নিজের ভিতরের আত্মোপোলব্ধি থেকে। নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। নিজের কাছে সৎ থাকতে হবে। সততা ও সত্যবাদীতাকে আঁকড়ে ধরতে হবে। শারীরিক ও মানসিক শুচিতা বজায় রাখতে হবে। খাদ্য দ্রব্য হবে নিরামিষ যাতে কোন প্রানি হত্যা করতে না হয়। নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি,সমাজের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে। ধৈর্য ও সংযমশীল হতে হবে। জীবন যাপন , খাদ্য, যৌনতা, সকল ক্ষেত্রেই সংযমি হতে হবে। অপরের প্রতি সামান্যতম হিংসা পোষণ করা চলবে না তা সে যত বড় শত্রু বা ভিন্ন মতাবলম্বী হোক না কেন। সকল ক্ষেত্রেই সহনশীল হতে হবে।

প্রশ্নকর্তা ঃ
আচ্ছা, আপনি যে অহিংসার কথা বলছেন তা প্রানি জগতের সাধারণ বৈশিষ্টের সাথে খাপ খায় না। যেমন জঙলে হিংস্র প্রানি নিরিহ তৃনভোজি প্রানিকে শিকার করে খায়। জলে বড় মাছ ছোট মাছ শিকার করে। মানুষ এই প্রানি বৈশিষ্টের বাইরে নয়। এই বিষয়টাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

গান্ধীজি ঃ
হেঃ হেঃ হেঃ। দেখুন, মানুষ এক রকমের প্রানি হলেও এবং সকল জৈবিক বৈশিষ্ট ধারণ করলেও মানুষ এমন কিছু বৈশিষ্ট লালন করে যা মানুষকে অন্য প্রানি থেকে পৃথক করেছে আর তা হলো ' র‍্যাশনালিটি '। র‍্যাশনালিটি মানুষকে এনিম্যালিটি থেকে পৃথক করেছে।
মানুষের আছে আত্ম-জিজ্ঞাসা। আধ্যাত্বিকতা, সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির বিষয়ে গভীর চিন্তা ও চেতনা শুধুমাত্র মানুষেরই আছে অন্য কোন প্রানির নেই। তাই জঙ্গলের আইন কিংবা জলের মৎস্য ন্যায়ের নীতি মানুষের বেলায় প্রযোজ্য হবে না।

প্রশ্ন কর্তা ঃ
ঠিক আছে, আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি বলতে চাইছেন মানুষ তার চিন্তা চেতনা, দর্শন, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, সামাজিক ভাবনায় অন্য প্রানি থেকে নিজেদেরকে পৃথক করে উন্নততর সমাজ গঠন করেছে। কিন্তু একথাওতো ঠিক যে , ধর্মের ভিত্তিতে যে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো সেখানে ' ধর্মযুদ্ধ ' বলে একটা শব্দের অস্তিত্ব আছে। রামায়ণে, মহাভারতে আমরা যুদ্ধের বর্ননা পাই। সেখানে দেখতে পাই রক্তপাত, জিঘাংসা, হানাহানি আর হিংসা!

গান্ধীজি ঃ হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। প্রারম্ভিক যুগে অধর্ম, অন্যায়, হিংসা দূরিভুত করে ন্যায়, ধর্ম, অহিংসা প্রতিষ্ঠা কল্পে ধর্মযুদ্ধের প্রয়োজন ছিলো। শ্রীমদভগবদগীতায় স্বয়ং ঈশ্বর বলেছেন যে - ' ধর্ম সংস্থাপনের জন্য তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হন! ' তিনি আবার একথাও বলেছেন যে শুধু যুদ্ধ নয় প্রেম ও ভালোবাসার মাধ্যমেও তিনি মানব জাতিকে শান্তি, ন্যায় ও অহিংসার পথ দেখাবেন।

প্রশ্নকর্তা ঃ
ঠিক আছে আমরা যদি পৌরানিক যুগের কথা বাদ দিয়ে প্রাচীন যুগের কথায় আসি তাহলে দেখবো ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল যুগের সাম্রাজ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই ছিলো।
বিশ্ব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মেসোপোটেমিয় সারগন সাম্রাজ্যের শুরু থেকে, পারস্য সাম্রাজ্য, গ্রীক সাম্রাজ্য, রোমান সাম্রাজ্য সবখানেই যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেছিল।
পরবর্তীতে অর্ধপৃথীবিব্যাপী মোঙ্গল সাম্রাজ্য, ভারত বর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য এবং সর্বশেষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পর্যন্ত কোথায় যুদ্ধ বিগ্রহ ছিলো না?
পৃথীবির ইতিহাসের পাতায় পাতায় রক্তের দাগ লেগে আছে! কোথাও আমরা অহিংসার মর্মবাণী দেখতে পাইনি।

গান্ধীজি ঃ হ্যাঁ, একথা অনস্বীকার্য যে, পৃথীবির ইতিহাসের পাতায় পাতায় যুদ্ধবিগ্রহ, হিংসা আর হানাহানি লেগে আছে। তার মানে এই নয় যে এই যুদ্ধবিগ্রহ অনাদিকাল যাবত চলতে থাকবে এবং মানবজাতি অনাদিকাল যাবত তা মেনে নিতে থাকবে!
একথা তো সত্য যে, প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্যবাদ এবং পরবর্তীতে উপনিবেশবাদের
ধ্যান ধারনার অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সূচনা হয়েছে। জ্ঞান বিজ্ঞান, দর্শন, রাস্ট্রচিন্তা সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক আলোকিত যুগের উদ্ভব ঘটেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পৃথিবীর বহু দেশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের কবলমুক্ত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটেছে।সার্বজনীন মানবাধিকারের বিষয়ে বিশ্ব ঐক্যমতে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাপী শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে নিয়ে লীগ অব ন্যাশনস / জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাই একথা আপনি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, ধাপে ধাপে মানবজাতি তার মানবিক গুনাবলিতে বিকশিত হচ্ছে।
আর একথা সবাই স্বীকার করে যে, যত মানবিক গুনাবলি আছে অহিংসা তার মধ্যে সর্বোত্তম।

প্রশ্নকর্তা ঃ
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
ব্রিটিশ উপনিবেশের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন ভারতবর্ষ অর্জনের যে সংগ্রাম তাতে ভারতের নানা প্রান্তে নানান ব্যাক্তি ও সংগঠন সশস্ত্র কায়দায় ব্রিটিশ রাজ হটানোর লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিলো। আপনি বরাবরই এই ধরনের সশস্ত্র সংগ্রামের বিরোধিতা করেছেন। আপনি কীভাবে ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতিতে অহিংস নীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন এবং কেমন করে আপনার মনে হলো যে পৃথিবীব্যাপী প্রচলিত রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপরীতে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে আপনি সফল হবেন?

গান্ধীজি ঃ
আপনি জানেন যে ইংল্যান্ড থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে আমি দক্ষিন আফ্রিকায় চলে গিয়েছিলাম একজন আইনজীবী হিসেবে।
সেখানে প্রতিনিয়ত আমাকে বর্নবাদের বিরুদ্ধে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালাতে হচ্ছিলো। আমি নিজে একজন আইন কর্মকর্তা ছিলাম এবং ট্রেনের টিকিট থাকা সত্বেও শুধুমাত্র ভারতীয় নেটিভ হওয়ার কারনে আমাকে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে বসতে দেওয়া হয়নি এমনকি আমাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো।
দক্ষিন আফ্রিকান নেটিভদের সাথে ভীষণ রকমের বর্নবাদী আচরণ করা হতো।
এই সব বর্নবাদী, মানবাধিকার বিরোধী, আধুনিক আইনবিরোধী ভয়ানক আচরণ একজন আইনজীবী হিসেবে আমার পক্ষে মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টদায়ক ছিলো।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাসী ভারতীয়দের এবং দক্ষিন আফ্রিকান নেটিভদের সংগঠিত করা হয়।
একজন আইনজীবি হিসেবে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে, সহিংস পথে না গিয়ে অহিংস পথে ব্রিটিশ সরকারের আইন দিয়ে আইনী পথেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে জেতা সম্ভব।
দক্ষিণ আফ্রিকায় দীর্ঘ একুশ বছরের প্রবাসী জীবনে সেখানে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একটি শক্ত পোক্ত ভিত্তি গড়ে উঠেছিলো।
১৯১৫ সালে ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে দক্ষিন আফ্রিকার সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার আলোকে বৃহত্তর ভারতবর্ষের জন্য কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো।

প্রশ্নকর্তা ঃ
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হাল ধরে আপনি আসলে কীভাবে কাজ শুরু করেছিলেন?

গান্ধীজিঃ
প্রথমেই আমি সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমন করে ভারতের মাটি ও মানুষকে চিনতে চেষ্টা করছিলাম। ভারত বর্ষে বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্মীয়, বহু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের অধিকারী মানুষের বসবাস। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, জাতপাতের বাছবিচার, পারস্পরিক ঘৃনা আমাদের সমাজকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছিলো।
বহুত্ববাদীতা বজায় রেখে কুসংস্কার ও জাতপাতের অবসান ঘটিয়ে কীভাবে ভারতবাসীকে একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনে সামিল করা যায় সেটি ছিলো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্নকর্তা ঃ
বাপুজি, যতদুর মনে পড়ে ১৯২১ সালে আপনি
একজন ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যারিস্টার হয়েও ব্রিটিশ বেশভূষা ছেড়ে প্রায় খালি গা হয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক তখন থেকেই কী মূলত আপনার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো?
গান্ধীজি ঃ
না, ঠিক তা নয়। এর আগেই ১৯১৫ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথেই বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ি। আর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন! সেতো দক্ষিন আফ্রিকায় অবস্থানকালীন সময়েই শুরু হয়।
হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, ১৯২১ সালে আমি আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্রিটিশ পোশাক বর্জন করেছিলাম।
প্রথমত ভারতীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নানান জাতপাতের অবসানের লক্ষ্যে আমাকে কাজ করতে হয়েছিলো।
ধাপে ধাপে কৃষকের অস্বাভাবিক খাজনা কমানো, নারীর প্রতি বৈষম্যের বিলোপ, বিভিন্ন বৈষম্যমুলক উপনিবেশিক আইনের সংস্কার, লবন আইন বিরোধী আন্দোলন, বিলাতী পন্য বর্জনের আন্দোলন, সর্বশেষে ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং স্বাধীন ভারত বর্ষের দাবিতে আন্দোলন। এই সব কিছুই একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো।

প্রশ্নকর্তা ঃ
বাপুজি, যতদুর মনে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আপনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে অস্ত্র ধরার জন্য ভারতবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। এটাতো কোন ভাবেই আপনার অহিংস নীতির সাথে মেলানো যায় না। তাছাড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে লড়াই করাটাও আমাদের স্বারাজ আন্দোলনের সাথে মেলানো যায় না। ব্যাপারটি যদি খোলাসা করতেন।

গান্ধীজি ঃ
হ্যাঁ, আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি স্বরাজ নীতির সাথে স্ববিরোধী ছিলো। কিন্তু ব্রিটিশ ভাইসরয়ের সাথে বৈঠকে তিনি আমাকে আস্বস্ত করেছিলেন যে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে তিনি ভারত বর্ষের স্বরাজের' বিষয়টি বিবেচনা করবেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তিনি সামান্য সংস্কার ছাড়া স্বরাজের ব্যাপারে তার কথা রক্ষা করেননি।
আর সাধারণ সৈনিকদের রিক্রটমেন্ট সংক্রান্ত আহবানের ব্যাপারে আমার ভাবনা ছিলো এরকম যে অহিংস নীতির সাথে এটা খাপ না খেলেও স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত হলে স্বাধীন ভারতের জন্য একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর প্রয়োজন পড়বে। তখন এই ভারতীয় সেনারা স্বাধীন দেশ রক্ষার সেনাবাহিনীতে ভূমিকা রাখতে পারবে।

প্রশ্নকর্তা ঃ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয় যার উদ্দেশ্য ছিলো তুরস্কের নেতৃত্বে মুসলিম উম্মাহ বা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আপনি এই খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। অথচ খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হয় এবং কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে সেকুলার তুরস্ক রাস্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়।
খিলাফত আন্দোলন সফল হলে ভারত বর্ষেও তার প্রভাব পড়তো। এটা আপনার ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো বলে কি আপনি মনে করেন না?

গান্ধীজি ঃ
না, আপনাকে সেই সময়কার রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে।
খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করার যুক্তি সঙ্গত কারণ ছিলো এই যে, তুরস্কে খিলাফত প্রতিষ্ঠা হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চাপের মধ্যে পড়তো তখন ভারতের স্বরাজ আন্দোলন মুসলিম সমাজের
সমর্থনে ও ঐক্যে আরো শক্তিশালী আন্দোলনে রুপ নিতো এবং আমাদের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হতো।

প্রশ্নকর্তা ঃ
কিন্তু খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতার পর মুসলিম নেতৃবৃন্দ কংগ্রেসের দিক থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।

গান্ধীজি ঃ হ্যাঁ, একথা অনস্বীকার্য যে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ডাক্তার আনসারি, হাকিম আজমল খান প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ ব্যতীত অনেক মুসলিম নেতৃবৃন্দই কংগ্রেসের রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন।

প্রশ্নকর্তা ঃ
এতে করে আপনি যে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের মাধ্যমে বৃহত্তর ভারতীয় জাতীয়বাদ এবং অখন্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা কি কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছিলো?

গান্ধীজি ঃ
হ্যাঁ, কিছুটাতো থমকে যেতে হয়েছিলো বইকি।
তারপরেও ধাপে ধাপে লবন আন্দোলন, স্বরাজ আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, পরিশেষে ভারত ছাড়ো আন্দোলন বেগবান হয়েছিলো।

প্রশ্নকর্তা ঃ
স্বাধীনতাকামী ছোট ছোট সশস্ত্র বিপ্লবী গ্রুপগুলোকে আপনি সমর্থন করেননি। ভগত সিংয়ের মত বিপ্লবীর ফাঁসীর আদেশ যখন কার্যকরী হচ্ছিলো তখনো এবিষয়ে আপনি মুখ খোলেননি। এমনকি স্বাধীন ভারতের জন্য নেতাজি সুভাসচন্দ্র বোসের মত ও পথকে আপনি মেনে নিতে পারেননি। এজন্য আপনার অনেক সমালোচনা হয়েছে এবিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?

গান্ধীজি ঃ
ছোট ছোট গ্রুপগুলো ছিলো সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ। একজন অহিংসনীতির অনুসারী হিসেবে এটা আমি সমর্থন করতে পারিনা।
সুভাস বোস সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরেছিলেন যেটা অহিংস নীতির সাথে খাপ খায় না। তাছাড়া তিনি জার্মানি ও জাপানি অক্ষশক্তির সহায়তা নিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ হঠাতে জার্মান ফ্যাসিবাদ মেনে নেওয়ার উপায় ছিলো না।

প্রশ্নকর্তা ঃ
বাপুজি, এইবার আমি একটু আক্রমনাত্মক প্রশ্ন করতে চাই। আপনাদের নেতৃত্ব অখন্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আনতে পারেনি। দেশকে টুকরো টুকরো করতে হয়েছে।
খন্ডিত ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছে। কোটি কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ভিটেমাটি, জমিজমা, বাড়িঘর, ব্যবসা বানিজ্য, জন্মস্থান হারিয়ে কোটি কোটি মানুষ অবর্ননীয় জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছে। জাতীয় নেতা হিসেবে এটাকে আপনাদের চরম ব্যার্থতা হিসেবে মনে করেন কিনা?

গান্ধীজি ঃ
অবশ্যই। এটা ছিলো নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা। যদিও এটা ছিলো অনিবার্য। কোনভাবেই রোধ করার কোন বিকল্প ছিলোনা। রাজনৈতিক অনিবার্যতাকে মেনে নিয়েই এই ব্যর্থতা, কোটি কোটি মানুষের অবর্ননীয় দুঃখভোগের দায়ভার নেতৃত্ব কোন ভাবেই অস্বীকার করতে পারে না।

প্রশ্নকর্তা ঃ
আপনার জীবৎকালেই স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা দেখেছিলেন। যদিও লীগ অব ন্যাশনস গঠিত হয়েছিলো তারপরেও বিশ্বের শান্তি ও স্থিতি এখন পর্যন্ত অনেকটাই শক্তির ভারসাম্যের উপরে নির্ভরশীল। এখনো কি আপনি অহিংস নীতিতে অটল থাকবেন?

গান্ধীজিঃ
অবশ্যই। অহিংস নীতির কোন বিকল্প নেই। হিংসা আরো হিংসাকে ডেকে আনে। যুদ্ধ আরো যুদ্ধকে ডেকে আনে। তাই অহিংসা, সত্য, ভালোবাসার কোন বিকল্প আছে কী?

প্রশ্নকর্তা ঃ
আপনি যথার্থ বলেছেন। তবে অন্যায়কারীকে যদি বার বার ক্ষমা করা হয় তাহলে কি অন্যায়কে এক ধরনের প্রশ্রয় দেওয়া হয় না?
আপনার নৃশংস হত্যাকারীকে আপনি কোন চোখে দেখবেন?

গান্ধীজি ঃ
হত্যাকারী তো হিংসায় মত্ত থাকে। সে ভালো মন্দ, ন্যায় অন্যায় অনুধাবন করতে পারে না।
সে জানে না যে সে কী অন্যায় করছে! ঈশ্বর নিশ্চয়ই তার অজ্ঞানতাকে ক্ষমা করবেন।

প্রশ্নকর্তা ঃ
আপনার মৃত্যুর পরেও আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার আন্দোলন অহিংস পন্থায় সফল হয়েছে। যদিও পরবর্তী ইতিহাসে হিংসা ও হানাহানির অবসান হয়নি। আপনি কি মনে করেন অহিংস পন্থা ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য কার্যকরী হবে।

গান্ধীজি ঃ অবশ্যই। আমি বিশ্বাস করি অহিংস পথের কোন বিকল্প নেই। অহিংসা, সত্যবাদীতা, বিশ্বস্ততা এবং মানবিকতাই হিংসায় উম্মত্ত পৃথ্বীকে শান্তির বাতাবরণের পথ দেখাতে পারে। বিশ্ব বাসীর কাছে আমার সেই আহবান থাকবে।

প্রশ্নকর্তা ঃ
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
গান্ধীজি ঃ
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

_ সুকুমার সুর রায়।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়