Dr. Aminul Islam

Published:
2021-09-26 21:07:45 BdST

লিঙ্গ প্রাগৈতিহাসিক


প্রয়াত কমলা ভাসিন


ডা.সুকুমার সুর রায়
-----------------
" লয়ং, -যাতি -ইতি -লিঙ্গম! " --- অর্থাৎ যাঁর মধ্যে সমস্ত কিছুই লয়প্রাপ্ত হয় - তাই "লিঙ্গ"।
সংস্কৃত 'লিঙ্গম ' থেকে 'লিঙ্গ ' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ------যার অর্থ --- 'প্রতীক' বা ' চিহ্ন।'
অথর্ব বেদে একটি স্তম্ভের 'স্তব' করা হয়েছে -- সম্ভবত এটিই 'লিঙ্গ পূজার' উৎস হতে পারে।

সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এক বিরাট অংশ হল -শৈব' সম্প্রদায়ভুক্ত।
দেবাদিদেব মহাদেব বা শিবের উপাসনাই তাদের কাছে মুখ্য। 'শিব' - হতে পারেন- জটাজুট ধারি, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত,ভস্ম মাখা দেহ, গলদেশে সরীসৃপ জড়ানো, শশ্মান চারী, আলাভোলা এক পুরুষ মূর্তি!! অথবা স্তম্ভের' মত আকৃতিবিহীন প্রস্তর নির্মিত 'শিবলিঙ্গ।'
হাজার বছর ধরে, শৌর্য বীর্যের প্রতীক 'শিবলিঙ্গ 'পুজা পুরুষানুক্রমে চলে আসছে।

ধান ভানতে 'শিবের গীত' গাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়।
আমার আলোচনার বিষয় 'হিন্দু দেবতা-' শিব ' বা ' 'শিবের লিঙ্গ ' নয়।
তবে 'লিঙ্গ। '
স্কুল জীবনে ব্যাকরণ পুস্তকে 'লিঙ্গ ' বিষয়টি পড়ানো হয়েছিল।
পুরুষ বাচক বা স্ত্রী বাচক বুঝাতে এই লিঙ্গ ' শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন - পুং লিঙ্গ, স্ত্রী লিঙ্গ, উভলিঙ্গ, ক্লিব লিঙ্গ ইত্যাদি।
আমাদের জীবন বৃত্তান্ত ফর্মে একটি ঘর আছে যা সবাইকে পুরন করতে হয় - যেমন - নাম, বয়সের সাথে --' লিঙ্গ'।
ইংরেজিতে - (Name, age, sex) ।
এই 'সেক্স' বা 'লিঙ্গ' আমাদের পুরুষ বা স্ত্রী চরিত্রের পরিচয় তুলে ধরে।
এর দ্বারা আমাদের বায়োলজিক্যাল পরিচয় চিহ্নিত হয়ে থাকে। এটা আমাদের জন্মগত পরিচয়।
এর দ্বারা আমাদের জন্মগত ভাবে প্রাপ্ত শারীরিক বৈশিষ্টের প্রকাশ হয়ে থাকে এবং যা অপরিবর্তিত থাকে। তবে যৌবন প্রাপ্তির সাথে সাথে কিছু সেক্সুয়াল অংগপ্রত্যংগের গঠন ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে থাকে, যেটাকে সেকেন্ডারি সেক্স ক্যারেক্টার বলা হয়ে থাকে।
এই 'সেক্স'বা 'লিঙ্গ'ও আমার আলোচনার বিষয় নয়।

যদিও আমার আলোচনার বিষয় ' লিঙ্গ '।
এটি আরেক ধরনের লিঙ্গ যা বুঝাতে 'সামাজিক লিঙ্গ বা ইংরেজিতে ' জেন্ডার' শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
একে 'সমাজ আরোপিত লিঙ্গ 'ও বলা যেতে পারে।
সমাজ আরোপিত লিঙ্গ বলতে আসলে আমরা কি বুঝে থাকি?
উদাহরন দেওয়া যেতে পারে।
ধরুন আপনার ঘরে আজ একটি ' বাচ্চা' জন্মালো।
আপনি এই বাচ্চার জন্য দোকানে জামা কিনতে গেলেন, দোকানি জিজ্ঞেস করবে ছেলে না মেয়ে?
ছেলে হলে তার জন্য একধরনের জামা আর মেয়ে
হলে ফ্রক জাতীয় আরেক ধরনের জামা আপনাকে কিনতে বলা হবে।
ধরুন আপনি আপনার বন্ধুর বাচ্চার জন্মদিনের গিফট -খেলনা- কিনতে দোকানে গেলেন, - এখানেও আপনাকে জিজ্ঞেস করা হবে ছেলে না মেয়ে?
ছেলে হলে ফুটবল, গাড়ি, এই জাতীয় খেলনা আপনাকে দেখানো হবে। মেয়ে হলে পুতুল' হাড়ি কুড়ি জাতীয় খেলনা আপনাকে নিতে বলা হবে।

আপনার উঠতি বয়সী ছেলেটি রাস্তায় যখন একটি মেয়েকে ইভটিজিং করবে এবং মেয়েটির বাবা যখন আপনার কাছে নালিশ করবে তখন আপনি বলবেন --"ছেলেরা ' এরকম এক আধটু করেই থাকে আপনার মেয়েকে সামলান। "
আপনার মেয়ে হলে বলবেন - - " মা তুমি বড় হয়েছো, এখন আর ছেলেদের মত বাইরে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। "
এই যে সমাজ, -- 'ছেলে 'ও 'মেয়ে ' কে দুই রকম দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে ; তার পোশাক আশাক, তার আচার আচরন, তার লেখাপড়া, তার খেলাধুলা, তার চাকুরী বাকুরি, তার চলা ফেরা সব কিছুকে ভিন্ন ভাবে বিচার করছে এটাই হল সেই সমাজ আরোপিত 'লিঙ্গ '।।

ফলে সমাজে এক ভয়াবহ রকমের 'লিঙ্গবৈষম্য ' তৈরি হয়ে আছে।
এই বৈষম্যের শুরু জন্মের আগে থেকেই।

ধরুন আপনার স্ত্রী প্রথম বারের মত সন্তান সম্ভবা হল। এখানে আপানারা নব দম্পতি তো বটেই, পরিবারের সবাই চাইবে - একজন পুত্র সন্তানের জন্ম হোক। কারন 'পুত্র' হল বংশ ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।
সেখানে পুত্র না হয়ে কন্যা জন্ম নিলে সবারই মুখ বেজার হবে। পুত্র সন্তান জন্ম নিলে, আজান অথবা সংখধ্বনি দিয়ে বরন করা হবে ; কন্যা সন্তানের বেলায় এসব কিছুই করা হবে না। এমনকি জন্মের আগে কোনভাবে যদি জানা যায় যে গর্ভস্থ শিশুটি কন্যা, তাহলে গর্ভেই তার ইচ্ছাকৃত জীবনাবসানের আশংকা থেকে যায়! কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েই দেখবে তার প্রতি অসন্তোষ। জন্মই যেন তার আজন্ম পাপ।
পুত্র সন্তান অসুস্থ হলে পরিবারে হুলস্থুল পড়ে যায়, কন্যা সন্তান অসুস্থ হলে বলা হয় মেয়েদের জান শক্ত।
মাছের মাথাটা ছেলের পাতে দেওয়া হয়; মেয়ে ধুকে ধুকে পুষ্টিহীনতায় ভুগতে থাকে।
ছেলেদের পড়াশোনার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। মেয়েদের লেখাপড়ার কোন সুযোগ হয় না।
চাকরি বাকরির ক্ষেত্রে কত বাধাবিপত্তি -- তুমি মেয়ে তোমার জন্য বিমান বাহিনীর চাকরি নয়, তুমি করবে শিক্ষকতা।
বাল্য বিবাহের কারনে অকালে গর্ভধারণ, অকালে গর্ভধারনের কারনে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি।
শাশুড়ি কর্তৃক নির্যাতন, স্বামী কর্তৃক বউ পিটানি, ননদ কর্তৃক যৌতুকের খোঁটা, অবশেষে বিষপানে আত্মহনন। এসবই ' সামাজিক লিংগ' বৈষম্যের কারনে ঘটে থাকে।

সারা বিশ্বে সমস্ত সম্পদের মাত্র এক শতাংশের মালিক নারী! বাকি নিরানব্বই শতাংশের মালিক পুরুষ।
সমস্ত উৎপাদনশীল কাজের ৬৬% করে নারী, পুরুষ করে মাত্র ৩৪% কাজ।
আয়ের বেলায় উল্টা। নারী পায় সমস্ত আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ, পুরুষ পায় দশ ভাগের নয় ভাগ।

হিন্দু ধর্মীয় বিধানে একজন মেয়ে পৈত্রিক সম্পত্তি একেবারেই পান না, তিনি উত্তরাধিকারী নন।
ইসলামি বিধানে নারী পৈত্রিক সম্পত্তি পান, তবে পুত্র যা পান তার অর্ধেক ; তাও কাগজে কলমে, বাপ ভাইয়ের বাড়ি নাইওরী খেয়ে শোধ বাদ।

অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে মোটের উপরে পুরুষের চাইতে নারীর সংখ্যা কম।

উদাহরণ -- বাংলাদেশে মোট ভোটার সংখ্যা দশ কোটি একচল্লিশ লক্ষ।
পুরুষ ভোটার - পাঁচ কোটি পঁচিশ লক্ষ।
মহিলা ভোটার - পাঁচ কোটি ষোল লক্ষ।
মহিলা ভোটার কম - নয় লক্ষ।

আজ ১৪ জানুয়ারি ২০১৯ সাল।
আজকের তারিখে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্য -
- ষোল কোটি, উন আশি লক্ষ।
মোট পুরুষ -- আট কোটি উনপঞ্চাশ লক্ষ।
মোট মহিলা - আট কোটি উনত্রিশ লক্ষ।

দেশে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বিশ লক্ষ কম।

আপনারা কি জানেন কেন কম?

কারন তাদের মাতৃত্ব জনীত মৃত্যু হয়, তাদের অপুষ্টি জনীত মৃত্যু হয়, নারী নির্যাতনের কারনে মৃত্যু হয়, বউপেটানো জনীত কারনে মৃত্যু হয়, বিষ খাওয়া, ফাঁসি নেওয়া, আত্মহত্যা জনীত কারনে মৃত্যু হয়।

সমাজ, রাস্ট্র, ধর্ম, কেউই নারীর পক্ষে নয়।

ভারতের কেরালার মত শিক্ষিত রাজ্যের হিন্দু মন্দির ' 'শবরীমালা মন্দিরে ' ঋতুমতী নারীদের প্রবেশাধিকার ছিল না হাজার বছর যাবত। কারন দেবতার মন্দিরও পুরুষের পৈত্রিক সম্পত্তি।!
হাজার বছরের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে লড়াই করে, উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে পুলিশের সহায়তায় দুই জন নারী অতি সম্প্রতি এই মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন বটে, তারা বের হওয়ার সংগে সংগে মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয়, ধোয়া মোছা শুরু হয় মন্দির, কেননা নারীর প্রবেশের ফলে তা ' অপবিত্র ' হয়ে গেছে।!

সৌদি তরুণী - ' রাহাফ কুনুন ' মৃত্যুর হাত থেকে
নিজেকে বাঁচাতে দেশ ছেড়েছে, পরিবার ছেড়েছে,
অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় প্রার্থনা করেছে, ব্যাংককের সুবর্নভুমি বিমান বন্দরে নানান নাটকীয়তার পর জাতিসংঘের তত্বাবধানে অবশেষে সে কানাডার
নাগরিকত্ব পেয়েছে। তার পরেও কি মৃত্যু তার পিছু ছাড়বে!?

আমাদের দেশের একজন মওলানা নারীশিক্ষার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন।
সম্প্রতি তিনি মেয়েদেরকে স্কুল কলেজে না পাঠানোর জন্য বিশাল মাহফিলে ধর্মপ্রান মানুষের কাছ থেকে ওয়াদা নিয়েছেন।
স্কুলে পাঠালেও ক্লাশ ফোর ফাইভের বেশি না পড়াতে নসিহত করেছেন যাতে মেয়েটি শুধুমাত্র স্বামীর সম্পদের হিসাব নিকাশ রাখতে পারে এবং প্রয়োজনে স্বামীকে চিঠি লিখতে পারে।
আরেক সমস্যা -- নারীদের পুরুষ ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা হবে পর্দার লংঘন।!
সেক্ষেত্রে নারী ডাক্তার কোথায় পাওয়া যাবে?!
পাওয়া গেলেও সেতো হবে ' ফোর পাস ' ডাক্তার!

দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে হুজুর আবার নতু্ন বিবৃতি দিয়েছেন, তিনি বলেছেন -- ' মেয়েরা বিশ্ব বিদ্যালয়ে যেতে পারবে, তবে পর্দা করতে হবে।' এটা যুক্তি সঙ্গত কথা।

যে দেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্বেও সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষায় জেন্ডার বৈষম্য তুলে দিয়ে সারা বিশ্বে প্রথম হয়েছে!
যে দেশ নারীর ক্ষমতায়নে প্রথম হয়েছে!
যে দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে!
যে দেশে প্রাথমিক স্তরে নারী শিক্ষকের হার বেশি!
যে দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী!
যে দেশের বিরোধী দলের নেত্রী একজন নারী!
যে দেশের পার্লামেন্টের স্পীকার একজন নারী!
যে দেশের শিক্ষামন্ত্রী একজন নারী!

সেই দেশে 'সামাজিক লিঙ্গ ' বৈষম্য জেঁকে বসে থাকবে!?
নাকি -- " বিশ্বে যা কিছু কল্যাণকর ; অর্ধেক তার আনিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর " -- এই কাব্যাংশের বাস্তব প্রতিফলন হবে!

( একজন মহীয়সী নারী 'কমলা ভাসিন' এর সাথে পরিচয় হয়েছিলো। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত মার্জিত গুনি মহিলা। ২০ বছর আগে একদল চিকিৎসকের সাথে একসপ্তাহ ব্যাপী এই গুনি মহিলার বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিলো। 'জেন্ডার ইস্যু' বিষয়টি সম্পর্কে যেটুকু ধারণা অর্জন করতে পেরেছি তার জন্য এই গুনি ভদ্র মহিলার নিকট ঋণী। এই মহীয়সী নারী গতকাল ২৫ সেপ্টেম্বর ভোরে ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যু বরন করেছেন। তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।)

------ সুকুমার সুর রায়।

প্রয়াত কমলা ভাসিন ছিলেন একজন পাঞ্জাবী ভদ্রমহিলা।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়