Dr.Liakat Ali

Published:
2021-09-25 17:11:39 BdST

খাদক


 

ডা.সুকুমার সুর রায়

সুলেখক 
______
বাজার থেকে ইলিশ মাছ কেনা হয়েছিলো। জেলেদের ভাষ্য অনুযায়ী বরিশালের ইলিশ।
স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় ইলিশ।
রান্না হয়েছিলো ইলিশ মাছের কারি। অভাবনীয় ভাবে কাঁচা কলা দিয়ে রান্না হয়েছিলো।
ইলিশ মাছে সব তরকারিই ম্যাচ করে । এটা সব্জির গুনে নয় ইলিশের গুনে। ইলিশের তেল সব সব্জিকে এমনভাবে মজিয়ে দেয় যে কোন কোন সময় মনে হয় মাছ নয় সবজিই অনেক বেশি স্বাদের। ইলিশ মাছ বিভিন্নভাবেই খাওয়া যেতে পারে। সর্ষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ, ইলিশের পাতুরি,ইলিশের দোপেঁয়াজু,এমনকি শুধুই ভাঁপা ইলিশ।
কাঁচাকলা দিয়ে ইলিশ এই প্রথম। সামান্য ঝোলে কাঁচাকলার ফালি দেখে মনে হয়নি যে এত্তো সুস্বাদু হয়েছে। ইলিশের তেল ঝোলে মাখা সামান্য ভাত মুখে দিয়ে কাঁচাকলার একটি টুকরো চালান করে দিতেই মুখের মধ্যে আলগোছে গলে গিয়ে এক স্বর্গীয় পরিতৃপ্তি মুহুর্তের মধ্যে মস্তিষ্কের কোষে কোষে পৌছে গেলো। তার সাথে ইলিশের পেটি থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া এক টুকরো নরম পেলব তেল চুক চুকে মাছ মুখের ভিতর ছেড়ে দিতেই অব্যক্ত আস্বাদ যেন এক অপার্থিব অনুভূতি মস্তিষ্কের কোষে কোষে সৈকতের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে লাগলো।
এই যে স্বাদের ইলিশ তার আবার কত রকমফের। সমুদ্রের ইলিশ, মোহনার ইলিশ, মেঘনার ইলিশ, পদ্মার ইলিশ, বরিশাল অঞ্চলের ইলিশ, চট্টগ্রাম কক্সবাজার এলাকার ইলিশ। আবার ছোট ইলিশ, বড় ইলিশ, ডিম ছাড়া ইলিশ, বড় ডিমওয়ালা ইলিশ, ছোট ডিমওয়ালা ( ডেকি) ইলিশ ইত্যাদি। সম্ভবত ডেকি ইলিশের স্বাদ সবচাইতে বেশি।

এই সুস্বাদু ইলিশ খাওয়ার সময় আমাদের একবারও কি মনে হয় যে এই ইলিশেরা জীবন্ত প্রানি ছিলো? এরা ঝাঁক বেঁধে সামাজিক প্রানির মতো গভীর সমুদ্রে বসবাস করতো? এরা ডিম ছাড়ার তাগিদে সমুদ্র থেকে নদীর মোহনায় আসে, তারপর স্রোত উজিয়ে যাযাবরের মতো নদীতে আসতে চায় বংশ বিস্তারের তাগিদে!
এরাও বিপদ আপদ বোঝে! এরাও নদীর দুষন, মানুষের অত্যাচার টের পেয়ে গভীর সমুদ্র থেকে মেঘনার মোহনার দিকে না এসে মায়ানমারের সমুদ্রের দিকে গিয়ে ইরাবতী নদীর মোহনার দিকে যেতে চায়?
তারপরেও শেষ রক্ষা হয়না। গভীর সমুদ্রে ট্রলারে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে রুপালি ইলিশ। শুনে আমরা খুশি হই। আমাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। আমাদের রসনার পরিতৃপ্তি ঘটে।

আমরা আবার অভয়ারণ্য তৈরি করার চেষ্টা করি। কখন কোন আমাবস্যা পুর্নিমায় তারা মোহনার দিকে আসবে সেই হিসেব নিকেশ করে আমরা কিছু সময় মাছ ধরা, বিপনন নিষিদ্ধ করে রাখি যাতে সময়মতো বড় বড় ইলিশ ধরা সম্ভব হয়।
এই সব কিছুই আমাদের খাবারের জন্য। কারন আমরা খাদক। আমরা সর্বভুক। গর্ভবতী ইলিশের প্রতি মায়া মমতা দরদ দেখানো আমাদের সংবিধানে থাকার কথা নয়।আমরা সৃষ্টির সেরা জীব।

জীব জগতের এটাই নিয়ম। মানুষ জীব জগতের বাইরে নয়।
প্রকৃতির দিকে তাকালে এক অবিশ্বাস্য খাদ্য ও খাদকের চিত্র দেখা যায়।
রাক্ষুসে মাছ ছোট ছোট মাছেদের শিকার করে।
জলের কুমির ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন ওঁৎ পেতে বসে থাকে। কায়দামত সময়ে জলজ কিংবা স্থলজ যে কোন প্রানি (হতে পারে সেটা গরু ছাগল হরিন কিংবা মানুষ) তার এম্বুশের কাছাকাছি হতেই বিপুল বিক্রমে প্রচন্ড চোয়ালের থাবায় সাবাড় করে। নিশ্চয়ই কুমির তখন ইলিশের স্বাদের মতই অনির্বচনীয় স্বাদে তা খেয়ে ফেলে।
সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে একটি হরিনের কথা ধরা যাক। হরিনেরা দলবদ্ধ ভাবে বাস করে। প্রতি মুহূর্তে তাদের চোখ কান খাড়া থাকে। ভীত সন্ত্রস্ত সদা চঞ্চল একটি হরিন যখন হঠাৎ কোন কারনে দলছুট হয় তখনই সে আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের টার্গেটে পরিনত হয়।
বাঘ টার্গেট নিশানা করে ছুটতে থাকে। হরিনও টের পেয়ে প্রান বাঁচাতে পরিমরি করে ছুটতে থাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। হরিনের জীবন বাঁচানোর দৌড়, বাঘের খাবার ও জীবনের তাগিদের দৌড়ের কাছে হার মেনে যায়।

একটি জঙ্গলে একটি ইঁদুর ভীরু পায়ে এদিক ওদিক পায়চারি করে খাবারের সন্ধানে। সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়না তার অতি নিকটেই ফাঁদ পেতে অপেক্ষায় আছে একটি ভয়ংকর সরীসৃপ। মুহুর্তের ব্যবধানে সে সরীসৃপের খাবারে পরিনত হয়। আস্ত ইঁদুরটিকে মাথার দিক থেকে আস্তে আস্তে পুর্নাঙ্গ গিলে ফেলে সাপটি। ওদিকে সেই জঙ্গলের উঁচু ডালে বসে থাকা একটি ঈগলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পড়ে যায় সাপটি! এক মুহূর্তে ছোঁ মেরে নিজের পায়ের নলিতে গেঁথে সাপটিকে মগডালে তুলে নিয়ে যায় ঈগল। তারপর ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে পরম তৃপ্তিতে খেয়ে নেয় আমাদের স্বাদের ইলিশ মাছ খাওয়ার মতো করে।
আরো ভয়ংকর ব্যাপার আছে। সিংহ হিংস্র টেরিটোরিয়াল প্রানি। তার নিজস্ব এলাকা আছে। এই রাজ্যে সে কাউকে ঢুকতে দেয় না। এমনকি তার নিজের পুরুষ বাচ্চাকেও সে মেরে ফেলতে পারে তার ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে।

রাজা সম্রাটদের সাথে কোন তফাৎ আছে কি? সম্রাট নিজের ভাইকে হত্যা করে বাপকে জেল বন্দী করে সিংহাসনে আরোহন করে।
আবার বিমূর্ত রাজ্য ও সাম্রাজ্যের সীমানা তৈরি করা হয়েছে। সেই সীমানা রক্ষার্থে কোন সৈনিক মারা গেলে তাকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। বীরের সম্মান দেওয়া হয়। অথচ জাতীয়তা একটি বিমূর্ত ধারণা। পৃথিবীতে অন্য প্রানিদের থেকে আলাদা একটা জাতিই বসবাস করে সে হলো মনুষ্য জাতি। গোটা পৃথিবীতেই মানুষের স্বাধীনভাবে বাস করার কথা। ক্ষেতের আইলের দরকার কী? সেই ক্ষেতের আইলের পাহাড়াদারের মৃত্যু হলো বীরোচিত শহীদের মৃত্যু! বড়ই হাস্যকর।

এটা আসলে হচ্ছেটা কী ?
সকলেই এক বাক্যে বলবে এটাই নিয়ম। এভাবে সবাই জীবন ধারণ করবে। প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।

অদ্ভুত বীভৎস বেঁচে থাকার লড়াই। একজনকে খেয়ে আরেকজন বেঁচে থাকবে। জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা কম হরিনের সংখ্যা বেশি। তাই কিছু সংখ্যক হরিনকে বাঘের পেটে যেতে হবে। তাতে সংখ্যায় অল্প বাঘ বেঁচে থাকলো আবার হরিনের সংখ্যাও ঠিক থাকলো। পরিবেশের (ইকোলজিকাল) ভারসাম্য বজায় থাকলো।

এইভাবেই ভাবতে আমরা অভ্যস্ত।
জঙ্গলের এই খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ককে আমরা ' খাদ্য শৃঙ্খল' বলে অভিহিত করে থাকি।
মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এই খাদ্য শৃঙ্খলের সকলের উপরের স্তরে আছে। সব ধরনের খাদ্য জোগাড় করা এখন মানুষের জন্য কোন ব্যাপার নয়। বরঞ্চ অন্য প্রানীর সাথে যেহেতু লড়াই বা যুদ্ধের আর প্রয়োজন হয়না তাই এখন মানুষ নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে মত্ত!
কারন খাদ্যের নিশ্চয়তা। শুধু নিজের জন্য নয়। তার বংশ পরম্পরায় চৌদ্দ গোষ্ঠীর জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান করা তার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

বহু আগে মানুষ যখন জঙ্গলে 'বন মানুষ' হিসেবে বসবাস করতো তখন এক গোত্রের মানুষ অন্য গোত্রের মানুষদের মওকা মতো ধরতে পারলে নাকি 'নরমাংসের ভোজ' হতো।

সেই নরমাংস ভোজ এখনো সমান তালে চলছে একটু অন্যভাবে।
মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়ে কলিঙ্গ যুদ্ধে প্রান গিয়েছিলো এক লক্ষ মানুষের।
মাত্র ৮ শো বছর আগে দুর্ধর্ষ মোঙ্গলরা শুধুমাত্র বাগদাদ নগরী ধুলার সাথে মিশিয়ে দিয়ে দশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলো।
মাত্র ৮০ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রান দিতে হয়েছে আট কোটি মানুষকে।
এসব কিছুই নিজেদের রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর জন্য অথবা তা বজায় রাখার জন্য। জঙ্গলের সিংহের মতই। আর এর সব কিছুর মুলে যে কারন তা হলো খাদ্যের সংস্থান বজায় রাখা।
এখন আর সরাসরি যুদ্ধ করার প্রয়োজন হয় না।
এখন আছে ধনতান্ত্রিক মুক্ত বাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যেখানে একজন মানুষের লক্ষ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়ার ব্যবস্থা আছে আবার আরেকজন ব্যাক্তির না খেয়ে থেকে রাস্তায় মরে পড়ে থাকার ব্যবস্থাও আছে।

এই কারনেই পি কে হালদার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ভেগে যেতে পারে। ডেস্টিনি, ই-ভ্যালি, এহসান গ্রুপ, মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে পারে সরীসৃপের ইঁদুর গেলার মতো।

এই হলো খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক।
আমরা কুমিরের মতো ভয়ানক খাদক।
আমাদের দেহটি বিভৎস রকমের কদর্যতায় পরিপূর্ণ। মুখ থেকে পায়ুপথ ২৮ ফুট জায়গা শুধুই খাদ্যের জন্য। খাদ্য গ্রহণ, হজম, বিপাক, পরিবহন সব কিছুর জন্য যত রকমের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি দরকার তা ঠাসাঠাসি করে সাজানো আছে আমাদের বুক ও পেটের মধ্যে।
একটি গরু সারাদিন ঘাস খায়, যেটুকু সময় শুয়ে থাকে তার বেশিরভাগ সময় জাবর কাটতে থাকে।
মানুষ কী তার চেয়ে উন্নত? সারাদিনমান টাকার( ঘাস) ধান্ধায় ব্যস্ত । বাকি সময়টুকু খায় আর খায়। আরেকটি কাজ করে তা হলো বংশবৃদ্ধি করা।
শুধুমাত্র পেটের জন্যই নাকি দুনিয়া!
ভালো কিছু, মহৎ কিছু, দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায় তার?

এ থেকে পরিত্রাণের কী কোন উপায় আছে?
না, একদম নেই । যতক্ষন আমরা খাদক হিসেবে বেঁচে থাকবো ততক্ষণ আমাদের খাদ্য দরকার হবে। যতক্ষন আমাদের খাদ্য দরকার হবে ততক্ষন আমাদের ভয়ানক খাওয়া দাওয়া চলতে থাকবে। যতদিন খাওয়া দাওয়া চলতে থাকবে ততদিন ভয়ংকর হত্যা, যুদ্ধ, হানাহানি, রাহাজানি, ধোঁকাবাজি চলতেই থাকবে। কোন নৈতিকতা, আদর্শ, ধর্মের অমিয়বানী এই জঘন্য খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ককে নিবৃত্ত করতে পারবে বলে মনে হয় না।
একটাই বিকল্প হতে পারে খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা। এটা কি সম্ভব?
কেন সম্ভব নয়?
গাছেরা তো খাদ্য খায় না। বরং তারা খাদ্য তৈরি করে। খুব সিম্পল স্বালোক সংশ্লেষন প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করে।
প্রানিদের পেটের ভিতরে এক গাদা নাড়িভুঁড়ির বদলে যদি সূক্ষ্ম এমন কিছু যন্ত্রপাতি থাকতো যাতে করে সূর্যের আলো ও বাতাসের অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বনডাইঅক্সাইড, জলীয়বাষ্প, আরো কিছু ট্রেস এলিমেন্টস এবং জল ব্যবহার করে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ, এমাইনো এসিড, ফ্যাটি এসিড ইত্যাদি অটোমেটিক্যালি তৈরি হয়ে যেতো তাহলে সব ল্যাঠা চুকে যেতো।
অনেকেই বলতে পারেন তা হলেতো চর্ব, চোষ্য, লেহ্য,পেয়ো, নানারকমের খাবারের যে আস্বাদন করা হয় তার কী হতো? আরে বাবা ভিতরে বাতাস টেনে নেওয়ার সময় একইরকম সুখানুভূতি কাজ করলেইতো হলো।
খাওয়া নেই। খাবার জোগাড় করার চিন্তা নেই। পৃথিবীতে খাদ্য ও খাদক নেই। তাই কোন হানাহানি নেই, রক্তপাত নেই,যুদ্ধবিগ্রহ নেই, মাল্টিমিলিওনিয়ার হওয়ার প্রতিযোগিতা নেই। আহা! শান্তির পৃথিবী।।

সুকুমার সুর রায়।।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়