Razik hasan

Published:
2021-09-05 19:19:10 BdST

কর্নেল ব্রাউনের প্রশ্ন এবং বন্দী মির্জা গালিবের উত্তর


 

রাজিক হাসান
_________________

১৮৫৭ দিল্লী পতনের পর গৃহবন্দী হয়ে আছেন মির্জা গালিব। বলা হয়, মুঘলরা ভারতবর্ষকে দিয়েছে তিনটি উপহার - তাজমহল, উর্দুভাষা এবং মির্জা গালিব। ইংরেজ সেনা অফিসার কর্নেল ব্রাউনের সামনে হাজির করা হলো বন্দি গালিবকে। জেরা করার এক ফাঁকে প্রশ্ন করা হলো মির্জা গালিবকে, তিনি মুসলমান কিনা। লালকেল্লার সঙ্গে পূর্বের যোগাযোগের কারণে তাঁর ফাঁসি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এরকম জীবন-মরণ সমস্যার মাঝে জবাবে তিনি কর্নেল ব্রাউনকে উত্তর দিলেন, "মুসলমান, কিন্তু আধা।" জবাব শুনে কর্নেল ব্রাউনতো থ। সে আবার কেমন মুসলমান? গালিব হেসে বললেন, "শরাব পীতা হুঁ , লেকিন শুকুর নঁহী খাতা"।

১৯৫১ সালে পাঞ্জাবে পাকিস্তানের সুন্নী মুসলমানেরা আহমদিয়া-বিরোধী দাঙ্গায় ১০ হাজার আহমদিয়াকে হত্যা করে অমুসলিম ঘোষণা দিয়ে। এই পটভূমিতে হয়েছিল মুনীর কমিশন গঠিত। প্রশ্নমালার একটি প্রশ্ন ছিলঃ মুসলমানের সংজ্ঞা কী?

মুলত :- শীয়া, সুন্নি, আহমদিয়া, কাদিয়ানি, খারিজি, ওহাবী, ফাতেমী — এমন বহুঁধা বিভক্ত ইসলামে এখন সত্যিই বোঝা মুশকিল “ মুসলমান কে'।

Justice Munir had noted in his fact finding report that if the definition of all the sects of Muslims is correct then there is no any Muslim; implying that every school of thought of Muslims consider the other sect either not a valid muslim or not-a-muslim.

"মুসলমান কে?" বিচারপতি মুনীর কমিশন অনুসারে এই প্রশ্নের সদুত্তর মেলে নি আজও।

এবার একজন ধার্মিক মানুষের জীবন নিয়ে কিছু বলবো আমি। তিনি শুধু একজন ধার্মিকই নন, তিনি এই সময়ের শ্রেষ্ঠ একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। লাহোরের ফজল মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তেন তিনি। মসজিদের ঈমাম সাহেব লক্ষ্য করতেন তিনি খুতবার সময়টিতে প্রায়শই কি যেনো লিখছেন তাঁর একটা নোটবইয়ে। ঈমাম সাহেব পরে জেনেছিলেন, তিনি আসলে সেই নোট বুকে খুতবা থেকে পাওয়া ইসলামী বয়ান লিখতেন না, তিনি লিখতেন ফিজিক্স এর সম্ভাব্য এক্সপেরিমেন্টস গুলো যা তাঁর মাথায় আসতো, যেনো ভুলে না যান তাই লিখে রাখতেন।

তাঁর ঘরে সব সময় থাকতো একটি কুরআন, কয়েক হাজার গানের লং প্লে রেকর্ড আর তার চাইতেও বেশী সংখ্যক বই।

ধর্ম দিয়ে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা কে "ষ্টুপিড আইডিয়া" বলতেন তিনি। কেননা দুটি সম্পূর্ণ দুই মাত্রার বোঝাপড়ার বিষয়। একটি পদ্ধতিগত আরেকটি নিছক ব্যক্তি মানুষের। ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংঘাত নিয়ে চিন্তা করার চাইতেও তাঁকে পীড়িত করতো পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় একশো বছরেও কেনো একজন গনিতের পিএইচডি তৈরী করতে পারলোনা সেই অপমানজনক গ্লানি।

তিনি ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন - পারটিকল ফিজিক্স এর "ক্ল্যাসিক্যাল মাইন্ড"দের একজন। তিনি নোবেল পুরুস্কার জিতেছিলেন। তিনি তাঁর নোবেল পুরষ্কার টি দান করেছিলেন শিক্ষা খাতে। তাঁর সাথে আরও দুজন নোবেল পেয়েছিলেন তাঁদের একজন প্রফেসর ওয়েইনবারগ বলেছিলেন - "আমি কখনই তা করবোনা, আমারটা আমি রেখেছি ব্যাংকে"। ভারতে তাঁর অসুস্থ ও শয্যাগত শিক্ষকের হাতে নোবেল মেডেলটি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, গুরুজি এই নোবেল আসলে আপনার পাওনা, কেননা আপনিই আমাকে গনিত শিখিয়েছিলেন।

এই স্কলারের ব্যক্তি জীবন কে তছনছ করে দিয়েছে পাকিস্তানের সুন্নি মুসলমানেরা, জামাতে ইসলামী, জুলফিকার আলী ভুট্টো আর প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এর শাসনকাল। সংগঠিত ধর্ম কতটা অন্ধ, ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তার নজির হচ্ছে এই ধার্মিক মানুষটির পাকিস্তান ত্যাগ আর হাজার হাজার কাদিয়ানীদের উপরে নেমে আসা সুন্নী নিপীড়নের ইতিহাস। সুন্নী মুসলমানেরা তাঁর কবরের এফিটাফ থেকে "মুসলিম" শব্দটিকেও হাতুড়ী দিয়ে ভেঙ্গে মুছে দিয়েছে।

অন্যদিকে ব্যক্তি মানুষ কতো বিচিত্র ভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মোকাবিলা করে তার হাজারটা উদাহরনের একটি হচ্ছে এই মানুষটির পেশাদার জীবন।

কেইমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইন্ট জন হলের লম্বা করিডোরের মাঝে মুখোমুখি আছেন - কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ারথ ও এই মানুষটি, যাঁর নাম প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুস সালাম। সব কিছু ছাপিয়ে এটাই হয়ে থাকবে ইতিহাস।

না শুধু ছবি নয়, আরেকটি বিরাট প্রতিষ্ঠান সালামের "বিউটিফুল মাইন্ড" কে বয়ে নিয়ে যাবে ইতিহাসে, সেটা হচ্ছে ইতালীর ত্রিয়েস্ত শহরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইসিটিপি (ICTP)।

তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিলো অনগ্রসর দেশগুলোর পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রদের উন্নত বিশ্বের গবেষণার সাথে যুক্ত করা।

তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রধান উন্নত দেশ বলে দাবীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেইন এই প্রত্যেকটি দেশ এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলো। এদের কাছে এই প্রতিষ্ঠানটি ছিলো একটি "অপ্রয়োজনীয়" উদ্যোগ।

সাম্রাজ্যবাদ আর উপনিবেশিকতা কেবল দেশ দখল করেই হয়না, আরও অসংখ্য উপায়ে হয়। বোঝার জন্যে শুধু দরকার আমাদের বোধ আর কিছু তথ্য।

প্রফেসর সালাম নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরে সৌদি বাদশা প্রথমে তাকে অভিনন্দন জানান প্রথম মুসলিম হিসেবে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার জন্য। অথচ পাকিস্তানে তাকে ধিক্কার জানানো হলো অমুসলমান বলে।

মানুষ অমর হন তাঁর কাজ দিয়ে। ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে নয়। মানুষ "বিচার" করা উচিত তাঁর কাজ দিয়ে, ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে নয়। কেননা এই মানুষটি ও জিয়াউল হক দুজনেরই ধর্ম বিশ্বাস ইসলাম।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়