SAHA ANTAR

Published:
2021-08-29 14:34:04 BdST

নজরুলের রান্না ও শিবরামের সজিভ ভক্তি


 


রাজিক হাসান
__________________

কাজী নজরুল ইসলাম ও শিবরাম চক্রবর্তী তারা পরস্পরের সমসাময়িক এবং বন্ধুও ছিলেন দু' জনে। দু’ জনের জীবনে মিলও অনেক। বিশেষ করে তাঁদের জীবনের বাস্তব সংগ্রাম মুখরতায় ছিল দারুন মিল। তাঁদের দুজনেরই অবস্থান ছিল তৎকালীন কোলকাতার অভিজাত সাহিত্যিক চক্রের কিছুটা বাইরে। ইংরেজ আমলে দু' জনেই জেল খেটেছেন। এমন কি থেকেছেন একই কারাগারে। দুজনের মৃত্যুর দিনও প্রায় একই মিল। নজরুল ২৯ অগাস্ট ১৯৭৬; শিবরাম ২৮ অগাস্ট ১৯৮০।

কেমন মানুষ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম; সেই সম্পর্কে শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর আত্মজীবনী মূলক বইয়ে লিখেছেন;

“কি রকম সঙ্গীতমত্ত মানুষ ছিল সে জানেন তো! কাজীর ব্যক্তিত্ব শতধা বিকীর্ণ, সহস্ররূপে বিচ্ছুরিত, অজস্র ধারায় উচ্ছল। যেমন তার শিল্পীসত্তা, বিপ্লবীসত্তা, সাধকসত্তা, তেমনি তার প্রেমিক-সত্তা, আর সব ছাপিয়ে ছিল তার পুরুষসত্তা। সবগুলোই সমান সত্য। তার কোনো ব্যক্তিরূপকে বাদ দিয়েই কাজী নয়, সব মিলিয়ে মিশিয়েই নজরুল। আমার তো মনে হয়, বাংলার মাটিতে শ্রীচৈতন্যদেবের পর সুভাষচন্দ্র আর নজরুল এক আবির্ভাব। মানুষের গড্ডালিকা প্রবাহে এক ফেনোমেনা।” ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’(নবপত্র প্রকাশন,কলিকাতা; পৃঃ ১৪০)

শিবরাম চক্রবর্তী তখন যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক হয়ে ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখা ছাপিয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে স্থান করে নিয়েছেন। হঠাৎ তার বহরমপুর জেলে বদলি হবার নির্দেশ এলো। শিবরাম শুনেছিলেন বহরমপুর জেল হল পাগলদের জন্যে। তাই জেলারকে ডেকে বললেন, স্যার, আমি কি তবে পুরো পাগল হয়ে গেছি। জেলার শুনে বললেন, না না তা কেন, ওখানেও সব বিশেষ রাজবন্দী্রাই থাকে। কাজী নজরুল ইসলা্মও এখন ওখানেই বন্দী আছেন।

জেলারের কথা শুনে শিবরাম আনন্দে আত্মহারা। ওই সময় বিপ্লবীদের কাছে মস্ত এক আনন্দের বিষয় ছিল, জেলে কাজী নজরুলের সঙ্গ পাওয়া।

সেখানে যাবার সাথে সাথেই কাজী সাহেবের অভ্যর্থনা, “লে হালুয়া, দে গরুর গা ধুইয়ে”। প্রথম আপ্যয়নেই শিবরামের দিলখুশ। আর তার পরেরদিনই বুঝে গেলেন, সারা জেলখানাতেই কাজীর রাজত্ব। সারাদিন গান, কবিতা, হৈ-হুল্লোড় আর আড্ডায় কাজীসাহেব মাতিয়ে রাখেন সবাইকে।

প্রকান্ড একটা হলঘরে অনেকগুলো লোহার খাট পড়েছিল পাশাপাশি। তারই দুটোর ওপর জেলের আপিস থেকে পাওয়া আমাদের দুখানা করে কম্বল বিস্তৃত হল। খট্টাঙ্গের সেই কম্বলবিস্তারে সাষ্টাঙ্গে আমি সবিস্তার হতে যাচ্ছি, বাধা দিলেন কাজী নজরুল।

‘আরে, এখনই শোবে কি হে ?’
‘তার মানে ? খাওয়ার পরেই শোয়া - এই তো জানি । খাই আর শুই - কাজ তো এই দুই - - -’
‘এখন আমাদের গান, আবৃত্তি, হৈ-হল্লা কতো কী হবে - - - ’
‘হোক না ! তার শ্রোতাও চাই তো ? আমিই সেই শ্রোতা। শুয়ে শুয়ে শুনব এখন। আমি তো আর গায়ক ও আবৃত্তিকারের পার্ট নিতে পারব না ভাই!’

"শুধু নিজের গান নয়, একের পর এক রবীন্দ্রসংগীতও গাইতেন নজরুল। এমন কি রবি ঠাকুরের গানের প্যারোডিও করতেন। যেমন, ‘তোমারই গেহে পালিছ স্নেহে’র তিনি প্যারোডি করেছিলেন, ‘তোমারই জেলে পালিত স্নেহে, তুমি ধন্য ধন্য হে’।"

"কোনো বিধিনিয়মের নিয়ম দিয়েই তাকে ধরা যায় না, মাপা যায় না, ব্যাখ্যা করা যায় না। সেই অভিব্যক্তির আখ্যান হতে পারে, কিন্তু ব্যাখ্যান নেই। এমন পরমাশ্চর্য বুঝি এর আগে দেখা গেছল সেই নবদ্বীপেই - বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতাকে যা মাতিয়েছিল আরেকবার। অপর দৃষ্টান্ত দ্বাপরের - বৃন্দাবনের মেয়েপুরুষকে পাগল করে তুলবার সেই।"

"দ্রষ্টব্যই নয় কেবল কাজী, শ্রোতব্যও বলতে হয়। সুরের তালে অহরহ তার আনাগোনা। নিজেও সে যেমন মাতোয়ারা, তেমনি গানে গানে মাতিয়ে রাখত আমাদের সবাইকে। নিজের গানের চেয়েও বেশি গাইতেন তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত।"

নজরুলের জেলে যাওয়ার মূল কারণ ছিল ধূমকেতু পত্রিকা। ধূমকেতু পত্রিকা সম্পর্কে শিবরাম লিখেছেন; ‘দারুন। বিশ পঁচিশ হাজার কপি বিকিয়ে যেত বাজারে পড়তে না পড়তেই। সময়ের মতন কাগজটাও ছিল গরম। সে সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ঐ ধূমকেতু - সবার চেয়ে বেশি চাহিদা ছিল তার। তাছাড়া, বারীনদা নলিনীদাদের বিজলী,উপেনদার আত্নশক্তি, আর ‘শঙ্খ’বলেও একটা যেন কাগজ বেরুত তখন,কাদের জানি না। সমসাময়িক সাপ্তাহিক সব। সাপ্তাহিক পত্রের যেন জোয়ার এসেছিল সে-সময়টায়।’

যুগান্তর পত্রিকার কারণে জেলে যেতে হয়েছিল শিবরাম চক্রবর্তীকে। ‘যদিও ধূমকেতুর সঙ্গে যুগান্তর পত্রিকার তফাৎ ছিল বেশ। এই বিষয়ে শিবরাম লিখেছেন; ‘নজরুলের লেখায় খোলাখুলি রাজদ্রোহের কথা থাকত। বিপ্লবের প্রেরনায় ভরা। তবে কবি তো সে, উপমা-ইঙ্গিতের আড়ালে তার বক্তব্যটা প্রকাশ পেত স্বভাবতই। আইনের প্যাঁচে তার নাগাল পাওয়া সহজ ছিল না। যেমন ধরুন না - ধূমকেতুতে বেরুনো ‘দুঃশাসনের রক্ত চাই’ বলে বিখ্যাত কবিতাটা। বলরে বন্য হিংস্র বীর/ দুঃশাসনের চাই রুধির/ চাই রুধির রক্ত চাই/ ঘোষো দিকে দিকে এই কথাই/ দুঃশাসনের রক্ত চাই/ দুঃশাসনের রক্ত চাই/ ওরে, এ যে সেই দুঃশাসন/ দিলো শত বীরে নির্বাসন/ কচি শিশু বেঁধে বেত্রাঘাত/ করেছে রে এই ক্রুর স্যাঙাৎ/ মা বোনেদের হরেছে লাজ/ দিনের আলোকে এই পিশাচ/ বুক ফেটে চোখে জল আসে/ তারে ক্ষমা করা ভীরুতা সে/ হিংসাশী মোরা মাংসাশী/ ভন্ডামি ভালো বাসাবাসি। এমনি পড়লে মনে হবে যে মহাভারতের উল্লেখ-কাহিণী, কিন্তু আসল অর্থটা কী,পাঠকের তা বোঝার কিছু বাকী থাকবে না। বাংলার উদ্ধত যৌবন তখন কাজীর কবিতায় উম্মত্ত হয়েছিল। কিন্তু এহেন অর্থের দ্বিত্ব থাকা সত্বেও সরকারের দ্বিধা বেশিদিন থাকেনি। আইনের পাকে অচিরেই পড়তে হয়েছিল নজরুলকে। জেল হয়েছিল দু’বছরের জন্য। কারাবরণের আগে আদালতে তার আত্নসমর্থনে যে কবুলতি সে দেয়, সেই ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ অবিস্মরণীয় এক দলিল।’

শিবরাম নিজের যুগান্তরের প্রেরণাটাও ছিল নজরুলের ওই ধূমকেতু। শিবরাম লিখেছেন; ‘রাজদ্রোহ নয় ঠিক। সমাজদ্রোহ বলা হয়ত যায়। আমাদের কালের সমাজ-ব্যবস্থায় যে সব অবিচার অনাচার অত্যাচার মনে প্রচন্ড নাড়া দিত, তার বিরুদ্ধেই আমি কলম ধরেছিলাম। ইংরাজের শাসন আমায় তেমন পীড়িত করেনি,যাকে বলে Social Injustice সেই সব - যেমন অব্রাহ্মণদের ওপরে বামুনদের অত্যাচার, প্রজাদের ওপরে জমিদারের শোষণপেষণ - এই সবেই আমি বেশি অভিভূত হয়েছিলাম। সমাজবাদের ধুমধাড়াক্কা তখনো তেমনটা পড়েনি, সোভিয়েট মুল্লুকে সমাজতন্ত্র পত্তনের নামগন্ধ বাতাসে ভাসছিল, ঘুনাক্ষরের বার্তায় আসছিল - শুধু তারই সুদূর হাতছানি কাউকে কাউকে যেন কেমন উন্মনা করছে সে সময়।"

"প্রত্যাসন্ন যুগের সেই সম্ভাবনার আবছায়াতেই আমার সে সময়ের লেখা যত না। পরে সেই সব ভাব-ভাবনাই ফলাও করে প্রবন্ধাকারে আমি ফলিয়েছি তারানাথ রায় সম্পাদিত নবশক্তির পাতায় - যা পরে আমার মস্কো বনাম পন্ডিচেরি আর ফানুসফাটাই - এই দুই নিবন্ধ বইয়ে প্রকাশ পেয়েছে। কাজীকেও এই পথে আসতে হয়েছিল শেষপর্যন্ত - তার ‘সাম্যের গান’ কবিতায় যার পরাকাষ্ঠা দেখা যায় । তবে কাজী ছিল আসলে জন্মবিদ্রোহী - তার সেই সর্বপ্রথম কবিতার মতই কায়মনোবাক্যে সর্বদাই বিদ্রোহী সে। এমন কি তার ফাউন্টেন পেনের কালিও ছিল লাল। ‘ রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা/ তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা –’ তার কোন কবিতার কোথায় যেন আছে না ?’”

“তার ওপরে সেদিন কাজী সঙ্গী আবার ! কাজী যেখানে আনন্দ সেখানে - জীবন যেন তরল পানীয়ের মতই শত ধারায় উচ্ছল-উচ্ছসি!"

শিবরাম চক্রবর্তীর নজরুলের প্রতি গদগদ হবার অনেক কারণের অন্যতম কারণ ছিল, নজরুলের হাতের রান্না। জেলখানার রাজবন্দীদের জন্য খানাদানা নিজের হাতে রান্না করতেন নজরুল। অল্প বয়সে কোথায় যেন বাবুর্চির করেছিলেন বেশ কিছুকাল। সেখান থেকেই মোগলাই খানা বানানো শিখেছিলেন আর জেলে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে সে সব রান্না করতেন। সে এক এলাহি ব্যাপার। কী অপূর্ব সে সব রান্নার স্বাদ।

শিবরামের নিজের ভাষায়, “মনে পড়লে এখনও জিভে জল সরে। নিজেকে সজিভ মনে করি। আর জেলখানার সেই খানা...আহা, আমি তো বহরমপুর জেলে যাওয়ার আগে টিঙটিঙে রোগা ছিলাম। তারপর দুইবেলা কাজীর খানা খেয়ে এমন মোগলাই চেহারা নিয়ে বেরলাম যে আর রোগা হলাম না। জেলখানায় আর জেলের খানায় গড়া এই চেহারা এতটুকু টসকায়নি”।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়