SAHA ANTAR

Published:
2021-08-24 05:33:27 BdST

বন্ধু ডাক্তার, রসায়নবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, পিএইচডি: তাদের জ্বীন-ভূত, তেল পড়া পানি পড়া


লেখক

 


রাজিক হাসান
লন্ডন থেকে
_____________________

আমার পরিচিত এক বন্ধু, ডাক্তার, এসিস্টেন্ট প্রফেসর, কার্ডিয়াক সার্জন, বিবর্তন তত্ত্ব বিশ্বাস করেন না, ধর্মগ্রন্থের আদম হাওয়া ও স্বর্গীয় উদ্যানের কাহিনী ভক্তি ভরে বিশ্বাস করেন, ডারউইনকে নিয়ে ঠাট্টা মস্করা করতেও তিনি ছাড়েন না। আরেক বন্ধু রসায়নে মাস্টার্স করছেন; তার অভিমত, পৃথিবী সূর্য্যের চারপাশে ঘুরছে এটা বিশ্বাস করা যাবে না। শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাশ করার জন্য পড়তে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, সোসিওলজিতে পিএইচডি, তিনি বিশ্বাস করেন তার স্ত্রীর উপর জ্বীনের আছর আছে, স্ত্রীর অস্বাভাবিক আচরণের জন্য মনোচিকিৎসকের কাছে না নিয়ে তিনি হুজুরের পানি পড়া, তেল পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।

সাধারণ মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই দেশের বেশির ভাগ ডাক্তারদের বিজ্ঞান চিন্তা একেবারে শূন্যের কোঠায়। কারণ মেডিকেল কলেজের পাঁচ বছরে শুধু মানব দেহের গঠন , কাজ, বিভিন্ন রোগব্যাধি , বিভিন্ন ঔষধ পত্র ,বিভিন্ন চিকিৎসা, সার্জারি এসবই পড়ানো হয়। এর বাইরে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়োলজি নিয়ে কোন আলোচনাই হয়না। বিবর্তন, আপেক্ষিকতা, কোয়ান্টাম ফিজিক্স এসব নিয়ে কোন কথাই হয়না। মানব শরীর আল্লাহর মহিমা খুঁজতে খুঁজতেই তাদের শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যায়। জীবনের গল্প বলতে "আদম হাওয়া ও স্বর্গের উদ্যান" গল্পটি থাকে তাদের মজ্জার গভীরে।

আমাদের কিন্তু আরেকটা জীবনের গল্প আছে। আফ্রিকাতে এক ধরনের কুমির পাওয়া যায়, নাম নীল নদের কুমির। ইংরেজিতে বলে Nile Crocodile। এই কুমিরদের দাঁতের ফাঁকগুলো একটু বেখাপ্পা ধরনের। খানাপিনার পরে দাঁতের ফাঁকে অনেক মাংস লেগে থাকে। এই মাংস পঁচে গিয়ে ওদের দাঁতে ইনফেকশন হয়ে যায়। প্লাভার নামে এক ধরনের পাখি আছে, দেখতে কিছুটা চড়ুই পাখির মত। দাঁতের মধ্যে মাংস আটকে গেলে কুমিরগুলো বিশাল একটা হা করে, আর এই প্লাভার গিয়ে কুমিরের মুখের মধ্যে ঢুঁকে পরে। তারপর দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা মাংস দিয়ে এক ধরনের ভুরিভোজ করে নেয়। আর এতে কুমিরগুলোও ইনফেকশনের হাত থেকে বেঁচে যায়। কুমিরের দাঁতের মাংসের টুকরো পাখিটা খেয়ে নিলে দুই পক্ষেরই লাভ। এই ধরনের সম্পর্ককে জীব বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন- সিমবায়োসিস। আমাদের জীবনের গল্পটাও একটা সিমবায়োসিসের গল্প।

এই পৃথিবীতে প্রাণ বা কোষ মূলত দুই ধরনের হয়। একটা হলো সরল প্রাণ, এদের বলা হয় প্রোক্যারিওট, অন্যটা হলো জটিল প্রাণ, ইউক্যারিওট। কোষই মূলত প্রাণ। এই পৃথিবীতে প্রথম দেড় থেকে দুই বিলিয়ন বছর ছিল এককোষী ব্যাকটেরিয়াদের রাজত্ব। তারপর দেড় দুই বিলিয়ন বছরে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ধরনের বিচিত্র সব বহুকোষী জীবের। তাহলে প্রথম দেড় দুই বিলিয়ন বছরের ইতিহাসটা কেন এত একঘেয়ে? কেন বহুকোষী জীবের আবির্ভাব ঘটতে এত সময় লাগলো? আর এই বিশেষ সময়টাতে কি এমন ঘটলো যে এককোষী জীব থেকে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির বহুকোষী জীবের জন্ম হলো?

এই বিশেষ সময়টাতে দুইটি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে তৈরি হয়েছিল একটি সিমবায়োসিসের সম্পর্ক। সেই প্রেমের সম্পর্কই বদলে দিয়েছিল এই পৃথিবীর প্রাণের ইতিহাস। আমাদের এই গল্পটা মূলত সেই প্রেম কাহিনী। আবার অন্যদিক থেকে চিন্তা করলে এটা একটা দাসত্বের গল্পও বটে।

আমাদের শরীর তৈরি হয়েছে ৩৭.২ ট্রিলিয়ন ইউক্যারিওটিক কোষ দিয়ে। এই কোষেগুলোর মধ্যে যে মাইট্রোকন্ড্রিয়া রয়েছে তা আজ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে ছিল স্বাধীন ব্যাকটেরিয়া।

আমাদের দেহে এখন যে মাইটোকন্ডিয়ারা আছে, তারা স্বাধীন ভাবে বংশ বৃদ্ধি করে। কোষ বিভাজনের উপর তারা নির্ভর নয় । কিন্তু এই দীর্ঘ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কটা একটা ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গেছে। আমরা এখন যেমন আর মাইট্রকন্ডিয়াদের ছেড়ে বাঁচতে পারব না, তেমনি তারাও আর আমাদের কোষ ছাড়া বাচতে পারবে না। বংশ বিস্তার স্বাধীনভাবে করলেও মাইট্রোকন্ডিয়াদের অনেকগুলো প্রোটিন তৈরি হয় খুব অদ্ভুতভাবে। এসব প্রোটিনের কিছু অংশের কোড রয়েছে তাদের নিজেদের জিনোমে, আর কিছু অংশ রয়েছে নিউক্লিয়াসে থাকা জিনোমে। অর্থাৎ মাইট্রোকন্ডিয়ারা এখন আর কোষের বাইরে বাঁচতে পারবে না।

এক ধরনের অনেকগুলো ইউক্যারিওটিক ব্যাকটেরিয়া মিলে এমন একটি কলোনি তৈরি করে, যে কলোনিটা সবাই মিলে একটি জীবের মত আচরন করে। আমরা বহুকোষী জীবেরাও কিন্তু তাই করি। আমাদের দেহের ট্রিলিয়ন ট্রিলিওন কোষ একত্রে মিলে ব্যক্তি মানুষকে ‘একটি জীব’ হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছে। এদের প্রতিটা আলাদা কোষই মূলত আলাদা আলাদা জীবন।

শরীরের লিভার থেকে কিছু কোষ কেটে নিয়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান দিয়ে কালচার করেন, তাহলে সেখানেও কোষগুলো দিব্যি বেঁচে থাকবে, এমনকি বংশবৃদ্ধিও করবে। তবে দেহের মধ্যে এরা সবাই একটি মিলে বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করছে। কিন্তু বহুকোষী জীবের দেহে কোষগুলো যেভাবে নিজেদের স্বাধীন সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে যেভাবে কাজ করে, এর জন্য অনেক ত্যাগ করতে হয়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক কোষকে সুইসাইড পর্যন্ত করতে হয়। অর্থাৎ দেহ নির্দেশ দিলে কিছু কোষকে বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদেরকে মেরে ফেলতে হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় অ্যাপোপটোসিস (Apoptosis)।

নিজেদের স্বাধীন সত্ত্বা ভুলে কোটি কোটি কোষ মিলে একটি জীবন হিসেবে কাজ করার জন্য এই অ্যাপোপটোসিস খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু যখন কোন কোষ আর এভাবে পরের চাকরি করতে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তখনই শুরু হয় সমস্যা। কোষগুলো তখন নিজেদের মত স্বাধীনভাবে বাঁচতে শুরু করে, স্বাধীনভাবে বংশ বিস্তার করে। শরীরে যখন এই ধরনের ঘটনা ঘটবে তখন ডাক্তার বলবে যে- আপনার ক্যান্সার হয়েছে। এজন্যই পাঠ্য বইতে লেখা হয়- ক্যান্সার হলো এক ধরনের অনিয়ন্ত্রত কোষ বৃদ্ধি।

সে যাই হোক, বিজ্ঞানীরা প্রথমে ভেবেছিলেন এ্যাপোপটোসিসের নির্দেশ দেওয়া হয় নিউক্লিয়াসে থাকা DNA থেকে। কিন্তু কয়েক বছর গবেষণার পর জানা যায় এই নির্দেশটা আসে মাইট্রোকন্ডিয়ার DNA থেকে। এজন্যই মূলধারার বিজ্ঞানীরা বলেন যে- মাইট্রোকন্ড্রিয়া ছাড়া বহুকোষী জীব সম্ভব না। এই যে বিলিয়ন বিলিয়ন কোষ একটি একক জীব হিসেবে কাজ করছে তার মূলেই সম্ভবত রয়েছে মাইট্রোকন্ডিয়ারা। এখনো পর্যন্ত এমন কোন বহুকোষী জীব পাওয়া যায়নি যাদের কোন মাইট্রোকন্ড্রিয়া নেই, বা কোন এক সময় মাইট্রোকন্ডিয়া ছিল না।

শুধু এই দেহকোষের সুইসাইডই নয়, পৃথিবীতে যে দুইটি আলাদা সেক্স রয়েছে তার পেছনেও মূল কারিগর হিসেবে আছে এই মাইট্রোকন্ডিয়ারা।

জীবনের গল্প থাক, বরং "আদম-হাওয়া ও স্বর্গের উদ্যান" কাহিনী সম্পর্কে বলি এবার। পৃথিবীর আরো অন্যান্য পৌরাণিক গল্প-গাঁথার মত "আদম-হাওয়া ও স্বর্গের উদ্যান" কাহিনীটিও বহু প্রাচীন। চার হাজার বছর আগে কাহিনীটি ইহুদি মিথ হিসাবে প্রথম প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারকগণ আনুমানিক দু' হাজার বছর আগে একই কাহিনী নিজেদের ধর্মগ্রন্থে (বাইবেল, নিউ টেস্টামেন্ট) জুড়ে করে দেয়। যদিও যীশুখ্রিস্টের ভাষা ছিল আরামিক; স্বর্গের উদ্যান কাহিনীটি লেখা হয় গ্রিক ভাষাতে।

সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়ও স্বর্গের উদ্যান কাহিনীটি পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, প্রথম দম্পতি "আদম-হাওয়া" সমান মর্যাদা নিয়েই সৃষ্টি হয় তাদের দেবীর হাতে। পরবর্তীতে পুরুষতন্ত্র কাহিনীটি সংগ্রহ করে, তখন তারা তাদের প্রয়োজন মত কিছু সংশোধন করে নেয়। সেখানে স্ত্রীলোককে শুধু দূর্বল হিসাবেই নয়, দেখানো হয় সমস্ত মানবজাতির পতনের অপরাধী হিসাবে।

যদিও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে "স্বর্গের উদ্যান" কাহিনীটির প্রেক্ষাপট হচ্ছে স্বর্গ। বাস্তবিক অর্থে না হলেও রূপক অর্থে। খ্রিষ্ট ধর্ম অনুসারে ঈশ্বরের অবাধ্যতাই আদম আর হাওয়ার ‘প্রকৃত স্খলন’ বা ‘পাপ’ এবং স্বর্গ থেকে তাদের বিতাড়িত হওয়ার প্রকৃত কারণ। সঙ্গত কারণেই এর সাথে যুক্ত হয়েছে সেই প্রক্রিয়া, যাকে আমরা যৌনতা হিসেবে বুঝি, যা মানবজাতির পুনরুৎপাদনে অত্যাবশ্যক।

প্রকৃত স্খলন বা পাপ এবং স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হওয়া ছাড়া 'ত্রানকর্তা' বা রক্ষা কর্তা বা ঈশ্বরের পুত্র কিংম্বা খৃষ্ট ধর্ম, কোনোটারই যে প্রয়োজন পড়তো না, তা মানছেন স্বয়ং খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীরাই। যেমন বলা যায় ফাদার সেন্ট পিটার এর কথা, "এই বিশ্বাসের অধ্যায়/স্তোত্রটি তুলে নেয়া হলে, কোনো প্রকৃত পাপের অস্তিত্বই থাকতো না। তখন মহান যিশুর প্রতিশ্রুতিগুলোও অপ্রয়োজনীয় আর খেলো হয়ে যেত। সাথে আমাদের ধর্মের মুখ্য শক্তিগুলোও যেত বিনষ্ট হয়ে।"

খৃষ্টধর্মের কট্টর অনুসারী এবং প্রচারকরা একই কারণে বিবর্তনের তত্ত্বকে একদমই মানতে চায় না। কারণ বিবর্তন তত্ত্ব আদিপাপের তত্ত্বটিকে এক ফুৎকারে অলীক কাহিনী হিসেবে উড়িয়ে দেয়। আমেরিকান এপিস্কোপাল চার্চ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিবর্তন বাদের উপর কোর্টের , ‘ এই অনুসিদ্ধান্ত (বিবর্তন তত্ত্ব) যদি সঠিক প্রমাণিত হয়, তাহলে বাইবেল একেবারেই একটা রদ্দি গল্প হিসাবে পরিণত হবে। আর সেই সাথে তা এমনই একখানা গল্প হবে, যা প্রায় দু হাজার বছর ধরে খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীদের একটা দানবীয় মিথ্যের দ্বারা প্রতারিত করে আসছে।"

২০১২ সালে লন্ডনের একটি পত্রিকা পড়ে বিস্মিত ও উৎফুল্ল দুইই হয়েছিলাম আমি; ব্রিটিশ স্কুলে বাইবেলের ক্রিয়েশন স্টোরি অর্থাৎ "স্বর্গীয় উদ্যান কাহিনীটি" পড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের মতে ছাত্ররা বাইবেল ও বিজ্ঞান একসাথে পড়লে দ্বিধায় পড়ে যাবে। তারা না হবে ধার্মিক না হবে বিজ্ঞানী; ছাত্রের মনোজগৎ বিকাশ ব্যাহত হবে। তাই ব্রিটিশরা আইন করে বাইবেলের এই অধ্যায়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

সম্প্রতি ব্রিটিশ ইন্ডিপেন্ডেন্স নিউজ পেপারে একটি নিউজটি দেখে আবার বিস্মিত হলাম আমি। সেখানে স্পষ্টভাবে লিখেছে; পোপ ফ্রান্সিসের মতে বিবর্তনের বাইরে মানুষ সৃষ্টির অন্য কোন তত্ত্বই প্রমাণিত না, তাই পোপ ফ্রান্সিস সৃস্টিতত্ব ও বিবর্তনবাদ মেনে নিয়েছেন বাস্তব সত্য হিসেবে।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়