ডেস্ক

Published:
2021-08-14 14:47:56 BdST

হার্বিভোরাস, কার্নিভোরাস ও ওমনিভোরাস


 

ডা. মোরশেদ হাসান
বিশিষ্ট চিকিৎসক ও কথাশিল্পী

 

লিমন ভাই, মানুষ হয়ে মাংস খাওয়া কি নিষেধ?
- কেন? নিষেধ হবে কেন নীলা?
: কেন তুমি কি দিন-দুনিয়ার খবর রাখো না। দেশে পশু-প্রেমীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে কোরবানির ঈদ এলেই এদের ঊনপঞ্চাশ পবন দেখা দেয়।
- হা হা হা। কী করবি বল। চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে—শুনিসনি? ঠিক তেমনি জ্ঞান যদি না থাকে সখী ফেসবুকে পশুপ্রেম দেখিয়ে কী হবে! চিল্লাইয়া কি মার্কেট পাওন যায়?
: না।

- শোন, যারা এসব ফাও কথা নিয়ে থাকে এদের জ্ঞানের গভীরতা কম। আগে তো বুঝতে হবে প্রাণীদের মধ্যে কারা তৃণভোজী (Harbivorus), কারা মাংসাশী (Carnivorus) ও সর্বভূক (Omnivorus)।
: কারা কোনটি লিমন ভাই?
- মানুষ শাক-সব্জি থেকে মাছ-মাংস সব খেতে পারে। গোরু-ছাগল এরা তৃণভোজী, আবার বাঘ-সিংহ শুধু মাংসাশী।
: মানুষ সব খাবার খেতে পারে?
- হ্যাঁ, মানুষের দাঁত, জিহ্বা, পৌষ্টিকনালী এবং হজমের সহায়ক ডাইজেসটিভ জ্যুসগুলোর জন্য সব ধরনের খাবার খেতে পারে। মানুষের দাঁতের গঠন জানতে হবে। দাঁত কয়টি বল?
: বত্রিশটি।

- ওপরের পাটিতে থাকে ষোলটি, নিচের পাটিতেও তা-ই। নিচের পাটিতে মাঝখানের চারটি দাঁত হল Incisor বা কর্তন দাঁত। এর সংলগ্ন দুপাশে একটি করে দুটি থাকে Canine বা ছেদন দাঁত। এরপরে দুটি করে দুপাশে চারটি Premolar teeth বা পেষণ দাঁত। আর শেষে দুপাশে তিনটি করে ছয়টি থাকে Molar Teeth বা পরিপূর্ণ পেষণ দাঁত।
: কোন দাঁতের কী কাজ বলো আমাকে?
- নাম দিয়ে যায় চেনা। কর্তন দাঁত দিয়ে খাবার কাটা হয়। তুই একটি মিষ্টি হাতে নিয়ে সামনের ইনসিসর বা কর্তন দাঁত দিয়ে টুকটুক করে কেটে খাস। আবার শক্ত মাংস ছেঁড়ার জন্য ক্যানাইন বা ছেদন দাঁত ব্যবহার করিস।
: ঠিক তো, জামায় বোতাম লাগানোর পর সুতা ছেঁড়ার জন্য সুচালো দাঁত ব্যবহার করি।

- হ্যাঁ, এজন্যই তো এর নাম ছেদন দাঁত। এরপরে প্রিমোলার ও মোলার দাঁত থাকে, এদের পেষণ বা চর্বদন্ত বলে। এদের দ্বারা খাবার পিষে ও চিবিয়ে নরম করা হয়। এই সবরকম দাঁত থাকার জন্য মানুষ মাংসও খেতে পারে আবার ফল-মূল, শাক-সবজিও খেতে পারে। এ সব ধরনের খাবার খাওয়ার সিস্টেম মহান আল্লাহপাকই করে দিয়েছেন।
: আচ্ছা!

- আবার দেখ, বাঘ-সিংহ এদের বেশিরভাগ দাঁতই হল বড়ো বড়ো ক্যানাইন বা ছেদন দন্ত। সামনে আছে ইনসিসর বা কর্তন দাঁত। এদের দাঁতের গঠন ও পৌষ্টিক নালীর গঠন এমন এরা শুধু মাংস খেতে পারবে। ঘাস-লতা-পাতা খেতে পারবে না। বাঘ ছেদন দাঁত দ্বারা শিকার কামড়ে ধরে পরে কর্তন দাঁত দ্বারা মাংস টুকরো টুকরো করে গিলে খায়। মানুষের মতো চিবিয়ে খায় না।
: আচ্ছা পৌষ্টিক বা পরিপাকনালীর বৈশিষ্ট্য কী?

- বাঘ যেহেতু চিবিয়ে খায় না, সেজন্য মাংস হজমের মেকানিজম রয়েছে তার পরিপাকনালীতে। বাঘের মুখের লালারস হচ্ছে এসিডিক। আবার পাকস্থলীতে রয়েছে শক্তিশালী হাইড্রোক্লোরিক এসিড (HCl) যা মানুষের স্টোমাকের চেয়ে বিশ গুণ বেশি শক্তিশালী। আবার বাঘের পরিপাকনালী তার শারীরিক দৈর্ঘ্যের মাত্র তিনগুণ বড়ো। এসবের ফলে বাঘের পেটে মাংস দ্রুত হজম হয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।
: আচ্ছা গোরু, ছাগল, হরিণ কেন শুধু ঘাস-লতা-পাতা খায়?
- এদের পেষণ দাঁত দিয়ে এরা শুধু চিবিয়ে খেতে পারে। কোনো ক্যানাইন বা ছেদন দাঁত নেই যে মাংস ছিঁড়ে খাবে।

হার্বিভোরাস, কার্নিভোরাস ও ওমনিভোরাস
(২য় পর্ব)
-----------------------------------------------
এবার মানুষের কথা বলো লিমন ভাই?
- মানুষের সব রকম দাঁত আছে সেটা তো বলেছি তোকে নীলা। এছাড়া মুখের লালারসে আছে টায়ালিন এনজাইম। এটি ক্ষারধর্মী। মুখ থেকেই হজম শুরু হয়। পাকস্থলীতে ডাইজেস্টের জন্য আছে হাইড্রোক্লোরিক এসিড, পেপসিন ও রেনিন। লিভার ও গল-ব্লাডার থেকে আসে বাইল।
: আচ্ছা।
- এছাড়া প্যানক্রিয়াস ও ক্ষুদ্রান্তে আছে হজমের সহায়ক এনজাইম। ফলে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাবার সুন্দরভাবে পরিপাক হয়ে যায়। এছাড়া বাঘের পৌষ্টিক নালীর চেয়ে মানুষের পৌষ্টিক নালী অনেক বড়ো। মানুষের শরীরের দৈর্ঘ্যের প্রায় দশ/বারো গুণ বড়ো। এর ফলে শাক-সবজি-মাছ-মাংস সবকিছু সময় নিয়ে সুন্দরভাবে পরিপাক হয়ে যাচ্ছে।

: আচ্ছা। এই তবে ব্যাপার। তবে পশুপ্রেমিকরা হঠাৎ এত বেতাল হয়ে যায় কেন?
- এদের স্বভাবই হচ্ছে বেতাল হয়ে যাওয়া। মুসলমানরা কোরবানির ঈদে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হালাল গবাদি পশু কোরবানি দেয়। বনের প্রাণী যেসব বিপদাপন্ন এর একটিও তারা খায় না। বস্তুত সেসবের বেশিরভাগ হালালও নয়। তুই কখনও শুনবি না কেউ হরিণ কোরবানি দিয়েছে। গোরু, ছাগল, ভেড়া, বকরি, উট এসব সব গবাদি পশু এবং হালাল। গবাদি মানে বুঝিস তো।
: গৃহপালিত পশু।
- হ্যাঁ, এদের পালাই হয় গৃহকর্ম, চাষবাস এবং সবশেষে জবাই করে খাওয়ার জন্য। সারা বিশ্বেই মানুষ এদের খায়। হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের মতে শুধু ম্যাকডোনাল্ডসেই প্রতিদিন প্রায় ৬৭ হাজার গোরু জবাই হয়।
: আচ্ছা, ভারতে কি গোরু খায় না?
- ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গোরু উৎপাদনকারী দেশ। ফলে গোমাংস রপ্তানিতেও ভারত বিশ্বে টপ অবস্থানে আছে।

: আচ্ছা, লিমন ভাই, ধরো সারা বিশ্বের মানুষ গোরু খাওয়া বাদ দিল, তবে কী হবে?
- মানুষ প্রাণীজ প্রোটিনের প্রধান উৎস থেকে বঞ্চিত হবে। আর গোরুরা ধর্মের ষাঁড়ের মতো বাড়তে থাকবে। এদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়বে। মানুষের বসবাস ও চাষাবাদ যোগ্য ভূমি হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। এরা ঘাস তো খেয়ে শেষ করবেই, এরপর মানুষের ফসলের জমি সাবাড় করে দেবে। মানুষের খাদ্যাভাব দেখা দেবে। আর মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখবে। অনেকসময় অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য কিছু দেশে কিছু প্রাণী এত বেড়ে যায় যে সেদেশের সরকারি লোক এদের গুলি করে মেরে ফেলতে বাধ্য হয়।
: আচ্ছা।
- শোন, বাঘ হরিণ মেরে খাবেই। বাঘের হরিণ মারার সময় হরিণের জন্য শোক করা হল কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দেওয়া। তবে বাঘ খাবে কী? একেই বলে Echo system, এই ইকো সিস্টেমের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারলে পরিবেশের ভারসাম্যে মারাত্মক তারতম্য দেখা দেবে। বুঝেছিস, নীলা।
: বুঝলাম।

- বুঝেছিস। কেমন পরিবেশটা এখন সুন্দর না? আমি কি কোনো খারাপ কথা বলেছি, কাউকে বকা দিয়েছি? তারপর দেখবি একদল এ স্ট্যাটাস পড়ে বলবে আমি ভালা না। আমিও তো বলি আমি ভালা না, ভালা লইয়াই থাকো।
: চুপ করবে তুমি।
- আমি তো চুপই থাকি, কিন্তু ওরা তো চুপি করে না।
: চুপ করবে এবার।
- করলে তো ভালো। তবে কাজ আছে যে এখন। চলি। ঈদ মোবারক, নীলা।
: ঈদ মোবারক, লিমন ভাই।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়