ডেস্ক

Published:
2021-08-11 21:36:36 BdST

মনু, নুহ নবী, মনুহ, লবন, লাবণ্য এবং অন্যান্য কথা


 

ডা. মোরশেদ হাসান
_______________

পৃথিবীর প্রথম মানব আদমের দশম অধস্তন পুরুষ হলেন নুহ নবি। হিন্দু পুরাণ মতে ব্রহ্মের মানসপুত্র হল মনু। সত্যযুগে বিষ্ণুর প্রথম অবতার মৎস্য অবতারের সময় মনুর আবির্ভাব হয়। আর এই মনুই ব্রহ্মের চতুর্দশ মনুর প্রথম মনু।

অনেকে একটি বিস্ময়কর সাদৃশ্য কল্পনা করে নেন। আমরা গল্পের আকারে বিষয়টি পাঠ করতে পারি।
নুহ যাঁকে বাইবেলে নোয়া (NOAH) বলা হয় তাঁকে আর মনুকে একই মানুষ বলে অভিহিত করেন অনেকে। দুজনের সময়ই মহাপ্লাবন হয়। নুহ নবির সময়ের মহাপ্লাবনের কথা আমরা জানি।
পুরাণ মতে মনুর সময়ও মহাপ্লাবন হয়। মনুও এক বিশাল নৌকা তৈরি করেন এবং প্রাণিকুলের সমস্ত প্রাণীকে জোড়ায় জোড়ায় নৌকায় তোলেন। অতিরিক্ত ভারে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলে বিষ্ণু মৎস্যরূপ ধারণ করে নিজের পৃষ্ঠদেশ দিয়ে ভার প্রয়োগে নৌকা উত্তোলন করে রাখেন। মনুর বংশধররাই মনুষ্যজাতি। মনুকে মানব জাতির আদি মানুষ বলা হয়। মনু যে নিয়মকানুন বা সংহিতা রচনা করেন তার নাম মনুসংহিতা।

নুহ নবির সময়ও মানুষ আল্লাহকে ভুলে পাপাচারে লিপ্ত হয়। বারংবার শোধরানোর চেষ্টা করার পরও যখন পাপাচারে লিপ্ত মানুষেরা বিশ্বাসের পথে ফিরে এল না তখন তাদের ওপর আল্লাহর গজব নাযিল হয়। মহাপ্লাবন আসে। নুহ নবি প্রকাণ্ড এক নৌকা বানান, সেখানে বিশ্বাসী কিছু নরনারী স্থান পায়, আর জগতের সকল প্রাণীর জোড়া জোড়া নৌকায় তোলা হয়। নুহ নবির চার ছেলে ছিল। হাম, সাম, ইয়াফেস ও কেনান। কেনান বিশ্বাস না আনায় প্লাবনে ডুবে মারা যায়। নুহর বংশধর হতেই মানবজাতির অগ্রযাত্রা আবার শুরু হয়। হামের বংশধররা ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকা ও ভারতে (আফ্রিকায় নিগ্রো ও ভারতে অস্ট্রিক গোষ্ঠী), সামের বংশ সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য (সেমেটিক জাতি) এবং ইয়াফেসের বংশধরেরা মধ্য এশিয়ায় (ককেশীয়) ছড়িয়ে পড়ে।

মনু শব্দটি আরবিতে উচ্চারিত হয় মনুহ ( সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের "যার যা ধর্ম")। কালক্রমে শব্দটি থেকে মিম বর্ণটি লোপ পেয়ে হয়ে যায় নুহ। নুহর ছেলে ইয়াফেস ইংরেজিতে হয় জাফেথ বা জেফেথ। আরবি ইয়া বর্ণটি ইংরেজিতে জে (J) দ্বারা প্রতিবর্ণায়িত হয়। যেমন, ইসা (আ.) হয়ে যান জিসাস। আর জিসাস আমাদের বাংলায় হয়ে যায় যিশু। ইউসুফ (আ.) ইংরেজি উচ্চারণে হয়ে যান জোসেফ।

মনু থেকে বাংলায় হয় মানব। আবার ল্যাটিনে বলে ম্যান (Man)। মনু+ অ (ষ্ণ) = মানব।
মানব শব্দের ব হল অন্তঃস্থ ব। মনু+অ থেকে মানব হয় কী করে? লবণ হয় যেমন লো+অন থেকে। লবণের ব কিন্তু অন্তঃস্থ ব।
অন্তঃস্থ ব -এর উচ্চারণ এখন বাংলায় বর্গীয় ব -এর সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু হিন্দি ও অসমীয়া ভাষায় অন্তঃস্থ ব -এর উচ্চারণ ও বর্ণ রক্ষিত আছে। যেমন ভগওয়ান, বাংলায় ভগবান। বাংলায় স্বাগত (সু+আগত) বলে, আর হিন্দিতে উচ্চারণ দেখেন। হিন্দিতে স্বাগত বলায় স থেকে গ-তে যাওয়ার সময় উঅ উচ্চারণ হয়।
অন্তঃস্থ ব -এর সংস্কৃত উচ্চারণ হয় ওয়া বা উঅ।
যেমন বাংলায়, সু+অল্প (উ+অ=ব) = স্বল্প।
মনু + অ = ম্+অ+ন্+উ+অ = ম্+অ+ন্+(উ+অ =ব)= ম্+অ+ন্+ব= মানব। প্রত্যয় অ যোগ হওয়ায় নামপ্রকৃতির আদিস্বর বৃদ্ধি পাওয়ায় ম (ম্+অ) হয়েছে মা (ম্+আ)।

আবার লবণের (লো+অন=লবণ) সঙ্গে য প্রত্যয় যোগ হওয়ায় হয়েছে লাবণ্য (লবণ +য)।
আমরা বলি মুখে লাবণ্য বেড়েছে। লবণের সঙ্গে লাবণ্যের সম্পর্ক কী?
বাতাস যেমন জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে পারে যাকে আমরা আর্দ্রতা বলি, তেমনি লবণও (সোডিয়াম) জল ধরে রাখতে পারে। লবণ বেশি খেলে ব্লাড প্রেশার বাড়ে।
মুখ জলীয় বা ভেজা থাকলেই আমরা তারে বলি কমনীয় বা লাবণ্য। মুখের স্কিন ড্রাই থাকলে আমরা সুষম লাবণ্য বলি না। আর তখনই মুখে ভেজা ভাব আনতে ময়েশ্চারাইজার মাখতে হয়। এখানেই লবণের সঙ্গে লাবণ্য শব্দের অন্তরঙ্গ মাখামাখি। মেয়েদের নাম হয় লাবনি। শব্দের জগৎ বড়োই মধুর ও আশ্চর্যজনক।

ভালোবাসা মানব জগতের সার কথা। ভালোবাসা ছাড়া জগতে কে বাঁচিতে চায়! সেই ভালোবাসাও হতে হবে লবণের মতো। দরকারি। কিন্তু তা-ই বলে লবণের মতো ভালোবাসা! এ কেমন কথা হে!
কেন শোনেননি সেই যে রাজার ছোট মেয়ে বলেছিল, বাবা, আমি তোমাকে লবণের মতো ভালোবাসি। রাজা রাগ করেছিলেন। ফলও পেয়েছিলেন হাতেনাতে। লবণকে হিন্দিতে বলে নিমক। নিমকহারামি করতে কেই-বা চায় বলুন। চাননি আলি বাবা ও চল্লিশ ডাকাতের সর্দারও। আলিবাবার ঘরে খাবার খেতে বসে তিনি আলগা লবণ নেননি। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কিছু লবণ। আর যা-ই হোক নিমকহারামি করতে পারবেন না। তাতেই ধরা পড়েছিলেন বুদ্ধিমতী মর্জিনার কাছে। বৃটিশ সরকার লবণের ওপর কর বৃদ্ধি করলে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ পরিচালিত হয়েছিল লবণ সত্যাগ্রহ বা ডান্ডি পদযাত্রা। আর কত বলব!

লবণ মোটেই হেলাফেলার জিনিস নয়। শরীরে লবণ হতে হবে সুষম। লবণের উপরই বেঁচে রয়েছে প্রাণ। মাস শেষ হলে লবণ না পেলে কী অবস্থা হত ভেবে দেখুন তো। ওই তো বুঝলেন না, বাবু। মাস গেলে মাইনের (ফারসি মহিনা) কথা বলছি। ও, আপনারা তো আবার সাল্যারি না বললে বোঝেন না। স্যালারি (Salary) কথাটি কোথা থেকে এল? পৃথিবীতে যখন মুদ্রা আবিষ্কার হয়নি তখন কোথাও পালক, কোথাও খাবার, প্রাণী, আবার কোথাও কড়ি দিয়ে পণ্য বিনিময় করা হত। ইথিওপিয়া ও রোমে অনেক শতাব্দী পর্যন্ত লবণ মুদ্রার প্রচলন ছিল। রোমের সৈন্যদের বেতনের কিছু অংশ দেওয়া হত লবণ দিয়ে। লবণ তখন দুষ্প্রাপ্য ও মহার্ঘ ছিল। সেখান থেকেই, Salt থেকে এল Salarium, Salary, Soldier (Sol dare) এবং Salad শব্দসমূহ। জীবন বাঁচানোর জন্য হাসপাতালের শয্যায় শায়িত রোগীর শিয়রের পাশে ঝোলানো হয় যে স্যালাইন ব্যাগ, সেই Salaine, Salinity শব্দও এসেছে Salt থেকেই।
সুতরাং নুন খাই যার গুণ গাই তার।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়