ডেস্ক

Published:
2021-07-17 15:29:22 BdST

বডিশেমিং এবং হৃদয় ভাঙার গল্প


লেখক ---

বাদল সৈয়দ
__________________

বডিশেমিং এবং হৃদয় -মন্দির ভাঙার গল্প।

১. ২০১৮ সাল।
অনেকদিন পর বন্ধুটির সাথে দেখা। সে 'এই বাদল' বলে ডাক না দিলে বুঝতেই পারতাম না যে, আমি কলেজ জীবনের সেরা সুন্দরীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি!
ত্রিশ বছরে তার ওজন বেড়েছে অনেক গুণ। স্থূলতা  যৌবনের সৌন্দর্য অনেকাংশেই কেড়ে নিয়েছে।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, তুমি রূপা না?
'হ্যাঁ, আমি রূপা, চলো কফি খেতে যাই।'
তার ব্যবহারে দীর্ঘ বিচ্ছেদের কোনো চিহ্ন নেই।
এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে কফি খেতে খেতে গল্প হলো, তারপর তার ফ্লাইটের ডাক এলো। ও যাবে সৈয়দপুর, আমি চট্টগ্রাম।
যাওয়ার জন্য সে উঠে দাঁড়িয়েছে, আমি তাকে এগিয়ে দিচ্ছি। বাইরে অপেক্ষামান বাসের জন্য গেইটের বাইরে পা রাখার আগ মুহূর্তে সে থমকে দাঁড়ালো, তারপর বললো, 'বাদল, তোমাকে একটু আলাদা ধন্যবাদ দিতে চাই।'
অবাক হয়ে বললাম, কেন?
'কারণ যার সাথেই আমার দেখা হয় সে-ই বলে, 'আরে তুমি এত মোটা হলে কী করে? আগে কত সুন্দর ছিলে!
যতবার কথাটা শুনি আমার কান্না পায়। তুমি এটা বলোনি, তাই ধন্যবাদ। আচ্ছা বলো তো, মোটা হওয়াটা কী অপরাধ? বয়সের কারণে সৌন্দর্য হারানো কি অপরাধ?'
আমি আমার ছোটোবেলার বন্ধুর চোখে জল দেখতে পেলাম।

এই যে, 'আরে তুমি এত মোটা কীভাবে হলে?' এটা বলাটাই 'বডিশেমিং'।
কারো শরীর নিয়ে লজ্জা দেওয়াটাই বডিশেমিং।
এটা খুব বাজে নিষ্ঠুরতা।

২. ১৯৮৫ সাল।
কলেজে পড়ি।
তখন মাথায় কবিতা ভিড় করেছে। সারাদিন ওটা নিয়েই লেগে আছি। আমার সাথে জুটেছে খোকন। দুজনের খুব শখ 'কবি' হবো।
'কবিতা' শেখার জন্যই চট্টগ্রামের একজন সিনিয়র কবিকে গুরু মানলাম। তিনি আবার বিরাট ছন্নছাড়া মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কিন্তু ক্লাশের গুল্লি মেরে কবিতা আর বিড়ি নিয়ে শহরের চিপাচুপায় বসে থাকেন। মাঝে মাঝে শুয়েও থাকেন।
আমরাও তাঁর পাশে বসে থাকি,পারলে শুয়েও থাকি।
আমাদের কাজ ছিলো প্রতিদিন কবিগুরুর বাসায় গিয়ে তাঁকে ঘুম থেকে জাগানো। তারপর তাঁকে নিয়ে বেরিয়ে পড়া।
একদিন তাঁর বাসায় গিয়ে বিশাল বিপদে পড়লাম।
দরজা খুললেন তাঁর বাবা।
রয়েল বেংগল টাইগার!
এ 'টাইগার' পুত্রের উপর এত বিরক্ত যে, তার গোস্ত কেবল পুত্রমায়ায় খচখচ করে খেতে পারছেন না, নইলে অনেক আগেই তা গলাধঃকরণ করতেন।
পুত্রের মাংস ভক্ষণে অক্ষম ব্যাঘ্র অবশেষে বিকল্প হিসেবে পেলেন তাঁর দুই সাগরেদকে।
শুরুই করলেন এভাবে-
'তোমরা ----- হারামজাদার বন্ধু?'
তাঁর চেহারা থেকে আগুন বের হচ্ছে।
আমরা ঘনঘন মাথা নেড়ে করে বললাম, না, না, উনি আমাদের বড়োভাই--আমরা--- আমরা----
আমাদের থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, বড়োভাই! নাকি ওস্তাদ? চোরের ওস্তাদ ডাকাইত?
আমরা কম্পমান অবস্থায় মাথা নিচু করে থাকি।
এবারের প্রশ্ন, মেট্রিকে কবার ফেইল মারছো?
আমরা দুজনেই একসাথে বলে উঠি, ফেল করি নাই,এক চান্সে পাশ করছি।
ও! এক চান্সে পাশ! থার্ড ডিভিশন?
এবার খোকন উত্তর দিলো, না,ভালো পাশ করছি। তারপর আমাকে দেখিয়ে বললো, ওর নাম পেপারে উঠছে, খুব ভালো রেজাল্ট---
এ কথাতেই আমার বারোটা বাজলো। তাঁর সব রাগ আমার দিকে মোড় নিলো।
ভালো রেজাল্ট করছো? নকলের জোরে?
এবার আমার একটু গায়ে লাগলো। কী বলেন উনি! এ রেজাল্টের জন্য কদিন আগে ঢাকায় গিয়ে মিনিস্টার সাহেবের কাছ থেকে পুরস্কার নিয়ে এসেছি, আর উনি বলেন কিনা নকল করে পাশ করেছি!
কিছুটা ক্ষিপ্ত গলায় বললাম, নকল করে এ রেজাল্ট করা যায় না।
ও, আচ্ছা, বলতে বলতে তিনি এক পা চেয়ারে তুলে দিলেন। তারপর সে পা নাচাতে নাচাতে বললেন,গাঁজা খাও! ওস্তাদের মতো?
আমি বললাম, জি, না।
ডেইলি কলেজ যাও?
যাই।
গোসল করো?
জি, করি।
আমার উত্তরগুলো তাঁকে খুব হতাশ করলো। ধরার কোনো কায়দা পাচ্ছেন না। তিনি নীরবে কিছুক্ষণ চেয়ারে রাখা পা নাচালেন।
তারপর তীব্র শ্লেষ নিয়ে বললেন, 'তুমি এত কালা কেন?'
ঘরে বোমা পড়লেও এত চমকাতাম না!
কেউ পেটে চাকু বসিয়ে দিলেও এতো কষ্ট পেতাম না!
এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। শুধু মাথা নিচু করে পায়ের আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছি। খোকনও দেখি অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় আমার দিকে তাকাচ্ছে না।
বয়স্ক মানুষটির কন্ঠে এখন তীব্র স্যাডিস্টিক সুখ। ঘরের নির্জনতা ভেঙ্গে তিনি ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ভাগো, যাও, ভাগো----

এটাও একধরনের বডিশেমিং।
কারো শারিরীক সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলা।

আমরা বুঝে বা না বুঝে প্রায়ই এটা করি।
মোটা বন্ধুকে 'মটু' বলে খেপাই।
কালো বন্ধুর নামের আগে 'কালাইয়া' শব্দটি জুড়ে দেই। যে একটু খুড়িয়ে হাঁটে তাকে ডাকি 'লেংগাইয়া'।
সবচে কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করেন বিজ্ঞাপন নির্মাতারা। এরা স্থূল, শুকনো, কালো মানুষদের কৌতুকের বিষয়বস্তু  বানিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করেন।
বিজ্ঞাপনের মতো 'স্পনসরড' বডিশেমিং আর কিছু নেই।
আমরা বলেই খালাস। একবারও ভাবি না যে, নিরীহ কৌতুকের ছলে আসলে একটা মানুষকে আমরা কতটা কষ্ট দিচ্ছি।
বড়োদের কাছ থেকে এটা শিখছে বাচ্চারা। কত শত বাচ্চা যে বডিশেমিংয়ের কারণে স্কুলে যেতে চায় না তার হিসাব আমরা রাখি না। কীভাবে যে তাদের আত্মা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তা আমরা বুঝি না।
আবার বড়োরাও দেখি, বাচ্চাদের শরীর নিয়ে মজা করেন, 'এই খোকা তুমি এত মোটা কেন? আরেকটু হলে তো সুমো কুস্তিগীর হয়ে যাবে।'
এধরনের একটি বাক্যই বাচ্চাটির সব আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, আর কিছু লাগবে না।

এভাবে ছেলেবুড়ো আমরা সবাই নির্বিকারভাবে এ অন্যায়টি করে চলেছি।

আমাদের বুঝতে হবে,  কারো স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা যায় না, গায়ের রঙ নিয়ে বলা যায় না, শারিরীক অক্ষমতা নিয়ে বলা যায় না।
এটা কেবল অভদ্রতা নয়, এটা অন্যায়। ভয়ংকর অন্যায়।

যার সাথে এটা করা হয় সে কখনো তা ভুলে না।
তার অব্যক্ত বেদনাকে বিলীন করার শক্তি প্রকৃতির নেই। এই একটা ব্যাপার, যেখানে 'টাইম ইজ দ্যা বেস্ট হিলার' কথাটা খাটে না।
দিন যায়, কিন্তু কষ্টটা ঠিকই থেকে যায়।
যেমন, আমাকে যিনি কালো বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন, কয়েকবছর পর তিনি এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু ক্ষতটা আমার বুক থেকে এখনো মিলিয়ে যায়নি। যাবেও না।
এগুলো মিলিয়ে যায় না।

বুঝে বা না বুঝে বডিশেমিংয়ের মাধ্যমে আমরা যে প্রতিনিয়ত মানুষের হৃদয়-মন্দির ভাঙছি- আসুন তার অবসান ঘটাই।
সে 'নো' টু বডিশেমিং।
@c
#badalsyed
(রূপা তার আসল নাম নয়।)

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়