SAHA ANTAR

Published:
2021-07-16 14:49:43 BdST

ইদ বিশেষ সক্রেটিস স্যার


লেখক এর ছবি 

 

ডা. সুকুমার সুর রায়
___________________________

সঙ্গত কারনেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক পরের বছর বাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার দুরের অজগ্রামের এক হাইস্কুল ' হরিনা বাগবাটি হাই স্কুলে' ক্লাস নাইনে ভর্তি হতে হলো।
ইংরেজি ক্লাসে যে স্যার প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি হলেন 'সক্রেটিস স্যার '!
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই স্যারের আসল নাম আর কিছুতেই স্মরণ করতে পারছি না। এর কারন সম্ভবত তাঁকে আমরা সবাই ' সক্রেটিস স্যার ' বলেই জানতাম তাই তার আসল নাম জানার কোন প্রয়োজন হয় নাই।
মাঝারি উচ্চতার মানুষ, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, মুখের গড়ন কিছুটা গোলাকৃতির, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, থুতনিতে ছাগলের মতো এক গাছা ছোট্ট দাড়ি, সাদা পাজামা পাঞ্জাবি এবং পায়ে চপ্পল পরিহিত ' সক্রেটিস স্যার ' যখন দার্শনিক সক্রেটিস সম্পর্কে আলোচনা করতেন তখন মনে হতো তিনিই স্বয়ং সক্রেটিস হয়ে আমাদের ক্লাস ভর্তি ছেলে মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
তিনি আমাদের পড়াতেন ইংরেজি পাঠ্য বইয়ে এইচ. বেলিস এর লেখা গল্প -- " ওয়াইজ মেন অফ দ্য ওল্ড "।

এই গল্পের শুরুটা ছিলো এইরকম--
" যিশু খ্রীষ্টের জন্মেরও শত শত বছর আগে বৃটেনের লোকেরা যখন অজ্ঞ ছিলো,অসভ্য ছিলো, বর্বর ছিলো,গুহায় বসবাস করতো, পশুর চামড়া পরিধান করতো ; সেই সময় গ্রীস দেশে এক আশ্চর্যজনক সভ্যতা বিকশিত হচ্ছিলো! "
যাইহোক, এই গল্পের মুল বক্তব্য ছিলো প্রাচীন কালের তিন জন মহান গ্রীক দার্শনিক যথাক্রমে ' সক্রেটিস ', 'প্লেটো', এবং ' এরিসস্টোটল' এর
সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা।
সক্রেটিস ছিলেন আড়াই হাজার বছর আগের মহান দার্শনিক গুরু। সেই যোগ্য গুরুর যোগ্যতম শিষ্য ছিলেন প্লেটো। আবার মহান প্লেটোর ছাত্র ছিলেন এরিস্টটল।
আর মহান এরিস্টটলের ছাত্র ছিলেন মহাবীর আলেক্সান্ডার।

আগেই বলেছি আমাদের সামনে যিনি দাঁড়িয়ে সক্রেটিসের কথা বলতেন তিনিই আমাদের কাছে 'সক্রেটিস স্যার' হয়ে উঠেছিলেন!
তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যেন আমরা দিব্য চোখে সক্রেটিসকে দেখতে পেতাম। 'সক্রেটিস স্যারের' অতি সাধারণ জীবন যাপন ও পোষাক আশাক দেখে সক্রেটিসের কথাই মনে পড়ে যেতো। কারন সক্রেটিস বলেছিলেন - " How many things I can do without " - অর্থাৎ '' কত কম জিনিস নিয়ে আমি চলতে পারি"! আমাদের 'সক্রেটিস স্যার' এই নীতিকথা তার জীবনে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন।

আমরা সবাই জানি যে সক্রেটিস ছিলেন একজন মহান জ্ঞানী ব্যাক্তি!
তিনি বলতেন যে, " আমি জানি যে, আসলে আমি কিছুই জানি না। "
"আমরা যে কিছু জানিনা এইটা স্বীকার করাই হচ্ছে কিছু জানার বা জ্ঞান অর্জন করার প্রথম শর্ত ।"
তিনি বলতেন যে, " নিজেকে জানো " ( know thyself)
তিনি আরো বলতেন যে, " পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটিই ভালো জিনিস আছে আর তাহলো '' জ্ঞান" এবং একটিই মন্দ জিনিস আছে আর তা হলো ''অজ্ঞতা"।

জ্ঞানের ও সত্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি মিথ্যার সাথে আপস করেন নাই। অন্যায়কে মেনে নিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেন নাই।
তিনি বলেছেন - " মৃত্যুর চেয়ে কঠিন হচ্ছে জীবন। কেননা দুঃখ, কষ্ট, বিপদ আপদ কেবল জীবনেই ভোগ করতে হয়, ' মৃত্যু' তা থেকে মুক্তি দেয়। "
তার দার্শনিক তত্বগুলি প্রচলিত প্রথাবিরোধী হওয়ায় এবং শাসকদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে বিচার বসানো হয়, তাঁকে হেমলক বিষ পানে হত্যার আদেশ দেওয়া হয়।
মৃত্যুকালে শিষ্যদের কান্না ও বিলাপের মাঝেও তিনি নির্বিকার ভাবে বলে যান - " আহাজারির কিছু নাই, বেঁচে থাকা ভালো, নাকি মরে যাওয়া ভালো, তাও আমরা জানিনা " ( I to dye, you to live, which is better only god knows)।

ইনিই সেই সক্রেটিস, যিনি মানব জাতিকে 'জ্ঞান' কী তা শিখিয়েছিলেন। জ্ঞান অর্জনের ইউনিক পন্থা সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন এবং সত্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে সাহসের সাথে মৃত্যুকে বরন করে নিয়ে মানুষের ইতিহাসে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছিলেন।

সক্রেটিস ৪৬৯ খ্রীস্টপূর্ব সময়কালে গ্রীসের এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ৩৯৯ খ্রীস্টপূর্ব তাঁকে হত্যা করা হয়।

এবার প্লেটোর কথায় আসা যাক।

মহান দার্শনিক প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের যোগ্যতম শিষ্য।
সক্রেটিস সম্ভবত লিখতে জানতেন না। তাই তিনি কিছু লিখে রেখে যাননি।
প্লেটো যদি তার মহান গুরু সক্রেটিসের কথা না লিখতেন তাহলে আমরা সক্রেটিসের কথা জানতেই পারতাম না।
প্লেটোই বিশ্বে প্রথম শিক্ষার জন্য একটি ' একাডেমি ' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এই একাডেমিতেই অনেক ছাত্রের মতো এরিস্টটলও একজন ছাত্র ছিলেন।

প্লেটো ৩৫ টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
এর মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ হলো " দ্য রিপাবলিক "।
রাস্ট্রের গঠন কেমন হবে তা তিনি এই গ্রন্থে ডায়ালগ আকারে বিস্তারিত লিখে রেখে গেছেন। তিনি আশা করেছিলেন যে রাস্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হবে সাম্যবাদী ব্যবস্থা এবং তিনি এটাও আশা করেছিলেন যে রাস্ট্রের শাসকেরা হবেন দার্শনিক।
প্লেটোর জন্ম ৪২৭ খ্রীস্টপূর্বে এবং মৃত্যু ৩৪৭ খ্রীস্টপূর্ব।

এবার এরিস্টটল সম্পর্কে দুই এক কথা বলা যাক।

এরিস্টটল ছিলেন এমন বিজ্ঞানী ও দার্শনিক যার প্রভাব পরবর্তী দুই হাজার বছর যাবত অটুট ছিলো। তাঁকে প্রানি বিজ্ঞানের জনক বলা হয়ে থাকে।
এরিস্টটলের জন্ম হয়েছিলো ৩৮৪ খ্রীস্টপূর্ব এবং মৃত্যু হয়েছিলো ৩২২ খ্রীস্টপূর্ব।

পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা,স্থাপত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, সঙ্গীত, ভাষাবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি, জ্ঞানের এমন কোন শাখা নাই যেখানে তার বিচরণ ছিলোনা।
তিনি মনে করতেন যে, বিশ্ব ব্রম্মান্ড -মাটি, জল, বাতাস ও আগুন এই ৪টি উপাদান দিয়ে গঠিত। তিনি এটাও মনে করতেন যে, বিশ্ব ব্রম্মান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আমাদের পৃথিবী ( Geocentric universe) এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই সকল গ্রহ নক্ষত্র ও সূর্য আবর্তিত হয়।

সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল কে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক বলে অভিহিত করা হয়।
সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, এঁরা আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীসের এথেন্স নগরীকে বিশ্বের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত করেছিলেন।

এথেন্সের এই তিন মহারথীর সময়কালেরও দুই তিন শত বছর আগে এথেন্স থেকে অনেক দূরে গ্রীসের পূর্ব প্রান্তে এজিয়ান সাগর তীরবর্তী প্রত্যন্ত, ' আইওনিয়া' অঞ্চলে নিভৃতচারী কয়েকজন দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর আবির্ভাব হয়েছিলো। যাঁদের কথা এই " ওয়াইজ মেন অফ দ্য ওল্ড " গল্পে স্থান পায় নাই। এনারা ছিলেন অনেকের স্বীকৃতির বাইরে, অজগ্রামের অবহেলিত অচ্ছ্যুত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী।

এনারা হলেন থ্যালিস, আনাক্সিমান্দার, আনাক্সামেনিস, হেরাক্লিতোস, পিথাগোরাস, পরমেনাইডিস,ফিলোলাউস,এরিস্টারকুস প্রমুখ দার্শনিক ও বিজ্ঞানী।
এনারাই আসলে প্রাচীন গ্রীক দর্শনের ভিত্তি রচনা করেছিলেন।
এনাদের সম্পর্কে পরবর্তী পর্বে বিস্তারিত আলোচনার আগে শুধু এইটুকু বলে রাখা ভালো যে, থ্যালিসই হচ্ছেন গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও দর্শন শাস্ত্রের জনক।

বর্তমান সামাজিক ও শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র দেখে "সক্রেটিস স্যারের" কথা বড় বেশি মনে পড়ে।।

- copyright সুকুমার সুর রায়।।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়