SAHA ANTAR

Published:
2021-06-03 16:38:32 BdST

জীবনকালে নিন্দিত ও অবহেলিত, মৃত্যুর পরে বন্দিত



ডেস্ক
_____________________

জীবৎকালে নিন্দিত বা অবহেলিত, মৃত্যুর পরে বন্দিত বাঙালি মহাজনের সংখ্যা বড় একটা কম নয় । কিন্তু মৃত্যুর পরেও সমভাবে উপেক্ষিত, অনাদৃত, মহাজন বোধহয় একমাত্র কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ।

বস্তুত রথীন্দ্রনাথের জীবদ্দশা ও মরণোত্তর পর্ব অন্তরালেই থেকে গেছে । সময় বিচারে তাঁর নিজস্বতায় - যে কিছু দাবি ছিল, কিছু প্রাপ্য ছিল সেটা বাঙালি ভেবে দেখেনি কখনও ।

শিল্পী বংশে জন্মেও পিতার ইচ্ছায় হয়ে উঠলেন কৃষিবিজ্ঞানী । গড়ে তুললেন এক কৃষিখামার যা বিদেশী কৃষিখামার কে মনে করাতে পারে । কাজ অসমাপ্ত রেখেই ফিরে এলেন কবির ডাকে । শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর দায়িত্ব নিতে । তিনি বুঝেছিলেন, এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার দায় থেকে কবিকে মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তা, কবিকে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে নিমগ্ন রাখার প্রয়োজনীয়তা । দৈনিক আঠারো ঘন্টা পরিশ্রম দান করেছেন প্রতিষ্ঠানকে, হ্যাঁ দান করেছেন । উপাচার্য হবার আগে পর্যন্ত কোন পারিশ্রমিক নেননি বিশ্বভারতীর থেকে ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশবন্ধু রথীন্দ্রনাথকে ভারতীয় লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলীর সদস্য করতে চেয়েছিলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জিতিয়ে আনার প্রস্তাবে কবির সম্মতিও আদায় করেছিলেন । রথীন্দ্রনাথ প্রত্যাখান করেন, কালীমোহন ঘোষের অনুরোধে তাঁর বক্তব্য ছিল - " আমার সমস্ত শক্তি ও সময় বিশ্বভারতীর কাজে উৎসর্গ করতে আমি বদ্ধপরিকর । অন্য কাজে হাত লাগাবার মত উদ্বৃত্ত সময় তো আমার একেবারেই নেই । "

১৯১৮ থেকে ১৯৫৩ তিনি বিশ্বভারতীর সেবায় নিয়োজিত । দেশ স্বাধীন হবার পর বিশ্বভারতীকে সরকার দ্বারা অধিগ্রহণ করানোর জন্য আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে ১৯৫১ সালে সাফল্য আসে ।

রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারের টাকা শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের নামে গচ্ছিত রাখলেন পতিসর কৃষি ব্যাঙ্কে । বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সময় ১৯২১ পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর সমস্ত বই এর স্বত্ব দান করলেন বিশ্বভারতীকে । এ কি পুত্রের সম্মতি না নিয়েই করেছিলেন? নিশ্চয়ই নয়। হেমলতা দেবীর প্রতিবাদ যে, ' রথীকে এভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে কেন? ' - গ্রাহ্য হয়নি ।
এ কি সামান্য ত্যাগ? এ কি বিস্মৃত হবার মতো একটা অধ্যায় ?
" .... সেদিন ভোজের পাত্রে রাখ নি ভোগের আয়োজন,
ধনের প্রশ্রয় হতে আপনারে করেছ বঞ্চিত ।..... "
পিতার এই স্বীকৃতি টুকুই রথীন্দ্রনাথের মহান প্রাপ্তি ।

বিশ্বভারতীর সেবা ছিল তাঁর পিতৃসেবারই একটি মাধ্যম । নন্দিনী দেবী'র কথায় -" ...... নিজের কোন কাজ বা নিজের কোন কিছু নিয়ে বাবাকে কখনো কিছু বলতে কেউ শোনেন নি। দাদামশায়ের কাজই যেন ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র কর্তব্য । বাবা দাদামশায়কে সুখী করবার জন্য চিরকাল আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। দাদামশায়ের ইচ্ছা - অনিচ্ছা , ভাল লাগা - না লাগা , সুখ , দুঃখ , বেদনা - আমার বাবা যতটা বুঝতে পারতেন এমনটা আর কেউ পারত না ।..... "

রথীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন শিল্পী বংশে , শিল্পী মন নিয়ে । সুলেখক ছিলেন । ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই ছিল তাঁর অনায়াস বিচরণ ।
ছবি আঁকতেন চমৎকার । মূলত ফুল ও নিসর্গ দৃশ্যই ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়।
কাঠ নিয়ে নানাধরনের সুন্দর জিনিস তৈরী করতে পারতেন । চামড়ার ওপর রঙের ব্যবহার তিনিই শুরু করেন । বাটিকের ক্ষেত্রেও তাই । যা আজ সারা ভারতে বিস্তৃত ।
বহুমুখী প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সে প্রতিভাকে লালন করার - বিকশিত করার সুযোগ ও সময় কোনটাই পাননি তিনি ।
আমরা এসব মনে রাখিনি । মনে রাখিনি, পিতার ইচ্ছাকে মান্যতা দিতে গিয়ে এক্ষেত্রেও কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তিনি ।

যে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের তিনি প্রথম ছাত্র, যে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে টানা তিরিশ বছর প্রধান প্রশাসক, অধ্যাপনাও করেছেন পাশাপাশি, সরকারি অধিগ্রহণের পর প্রথম উপাচার্য হিসেবে দু’বছর । প্রশাসক হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি?
- হীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথায় - " ..... সর্বময় কর্তা হয়েও কর্তৃত্ব না করা একটা মস্ত বড়ো গুণ। রথীন্দ্রনাথের সেই গুণটি ছিল । বিশ্বভারতী ঠিক অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত নয় । এখানে বহু বিচিত্র কাজের সমাবেশ । একাডেমীক বিভাগ ছাড়াও আছে সঙ্গীত ভবন, কলা ভবন, গ্রাম-সংগঠন, ডেয়ারী ফার্ম, পোলট্রি ফার্ম ইত্যাদি । এছাড়া আছে বারো মাসে তেরো পার্বন।
রথীন্দ্রনাথের মস্ত বড়ো সুবিধা ছিল যে এর কোন ব্যাপারেই তিনি নিতান্ত আনাড়ি ছিলেন না, কোন কোন বিষয়ে তাঁকে বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারত, তথাপি কোন বিভাগের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন না। ........ ... এমন নীরবে, এত কম কথা বলে কোন মানুষকে আমি কাজ করতে দেখিনি। প্রকৃত পক্ষে তাঁর সহজাত সৌজন্য প্রবাদবাক্যে দাঁড়িয়েছিল ।..."

এই সৌজন্যবোধ সম্পর্কে পুলিনবিহারী সেনের লেখায় পাই -" .... কর্ম বা অন্য সূত্রে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে যাদের সামান্য পরিচয় ও ঘটেছিল আশা করি তাঁরা অন্তত একথা স্বীকার করবেন যে সৌজন্যে তাঁর সমতুল্য মানুষ বিরল দর্শন । আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে তাঁকে যারা জেনেছেন তাঁরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন লোকব্যবহারে তাঁর গভীর ধৈর্য । রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন মত পোষণ ও প্রকাশ করবার স্বাধীনতা সম্পূর্ণ না হলেও অনেকখানি অব্যাহত ছিল ।শান্তিনিকেতনের কর্মপরিচালনায় রথীন্দ্রনাথকে কখনও কখনও সহকর্মীদের কঠিন সমালোচনার ভাজন হতে হয়েছে; অনেক ক্ষেত্রে এ সকল সমালোচনার সংগত কারন ছিল; তাঁর মতের প্রতিকূলতা কাজে বা কথায় যাঁরা করেছেন তাঁরা ব্যক্তিগত কারনে তা করেননি, শান্তিনিকেতনের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষাবশতই তা করেছেন ।কঠিন সমালোচনার ফলে মনে যতই পীড়া বোধ করে থাকুন, বাক্যে বা ব্যাবহারে তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।ধৈর্য্য তাঁকে রক্ষা করতে হয়নি, ধৈর্য্য তাঁর সহজাত ভূষণ ছিল ।..... "
"...... রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি বারো বৎসর কাল বিশ্বভারতীর সর্বময় কর্তা ছিলেন । শান্তিনিকেতনের জীবন ধারাটি অব্যাহত এবং শান্তিনিকেতনের জীবনের লক্ষ্যটিকে তিনি অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিলেন বলেই কবি প্রয়াণের পরে এত বড় শূন্যতাও সেদিনকার শান্তিনিকেতন জীবনে ততখানি প্রকট হয়ে দেখা দেয়নি । কিন্তু রথীন্দ্রনাথ কার্যভার ত্যাগ করে যাবার অনতিকালের মধ্যেই শান্তিনিকেতনের জীবন এতখানি শ্রী হীন হয়।

আজকে প্রয়াণদিবসে শ্রদ্ধা জানাই ।

সংগৃহীত

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়