SAHA ANTAR
Published:2021-05-24 14:08:30 BdST
চলে এসেছে বোধহয় জনগণের বাঁশডলা খাবার দিন
অন্তর সাহা র ভূমিকা
_____________
এপার বাংলা, ওপার বাংলা। সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির কুৎসিত ঘৃণা ভরা চেহারা একই রকম।
বাংলাদেশে ড. আনিসুজ্জামান এর মত মহত্তম ব্যাক্তিকে ঘিরেও তাঁর মহাপ্রয়াণেও গুজব গজবীরা আলবদর উৎসবে মাতে; ওপার বাংলা সেই কুৎসিত চক্র জন্ম নিচ্ছে, তা নিয়ে লিখেছেন
দেবব্রত তরফদার
_____________
কিছুদিন আগে কবি শঙ্খ ঘোষের মহাপ্রয়াণে দেশবাসী শোকস্তব্ধ। অনেকেই তাদের নিজেদের মতো করে শোক জ্ঞাপন করেছেন এই সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখিতভাবে। আমরা প্রত্যেকেই জানি যে এই সোশ্যাল মিডিয়া একটি আজব জায়গা। হয়তো দেখা গেল যে, এমন মানুষ রয়েছেন যিনি শঙ্খ ঘোষের একটি লেখাও পড়েননি অথচ তাঁর সম্পর্কে একটি শোকগাথা লিখে ফেললেন এবং যথারীতি লাইক কমেন্ট ইত্যাদির স্রোত বয়ে গেল। তা ভালো, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের যেহেতু অধিকার রয়েছে তাই ক্ষতিকারক কিছু প্রকাশ না করলে পার অসুবিধা কোথায়।
আসল ব্যাপারটা অবশ্য তা নয়। এমন কিছু পোষ্ট দেখা যায় যাতে আমাদের মত সাধারন মানুষ শুধু ভীত নন আতঙ্কিতও বটে। যেমন ফেসবুক বন্ধু ভবেশ দাস এর দেওয়ালে শঙ্খ ঘোষের মৃত্যুর সংবাদে পাঠপ্রতিক্রিয়ার একটি স্ক্রিনশট কেউ শেয়ার করেছিলেন। তাতে দেখলাম দুজন কেন্দ্রীয় শাসকদলের যুব মোর্চার কলকাতার কোন আঞ্চলিক শাখার পদাধিকারী বক্তব্য ছিল , " আরেকটি ভাম মরলো।" , বা
" দেশদ্রোহিটা মরেছে ভালো হয়েছে আমাদের নিয়ে বহুৎ #### ( প্রকাশের অযোগ্য ) করতো মালটা।" অথবা ," ওই শালা পাকিস্তানের সমর্থক।"
এইসব পাঠপ্রতিক্রিয়া আতঙ্কিত হয়েছি কিন্তু অবাক হইনি। কেননা অতীতে চোখের সামনেই দেখেছি , অনুব্রত মণ্ডল একসময় শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে কুমন্তব্য করেছিল। একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সেই লেখা নিয়ে সঙ্গত করেছে আমাদের পাড়ার এক ভাই যার শিক্ষাগত যোগ্যতা টু ফেল। আর চেনা পরিচিত একজন আছেন কেন্দ্রীয় শাসকদলের এলাকার যুব মোর্চার বিশেষ পদাধিকারী। এর বক্তব্য , যে তাদের দলের সমর্থক নয় সে পাকিস্তানপন্থি অথবা পাকিস্তানের চর। এ কথাবার্তায় বুঝেছি এই অশিক্ষিত , আহাম্মক দামাট শ্রেণী বিশেষ কোনো একটি গাইডলাইন দ্বারা পরিচালিত হয়। কেননা বর্তমানে দেখছি এরা প্রতিটি বিষয়ে একটি মতামত দেবার চেষ্টা করে, তা যতই অবাস্তব হোক না কেন। অবশ্য সবকথা গিয়ে শেষ হয় হিন্দুত্বে।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। শঙ্খ ঘোষের কবিতা তো দূরস্ত। কবিতার ধার কাছ দিয়ে কোনদিন যায়নি এরা কখনো। কৌতূহলে অবশ্য এরা হাম্বা হাম্বা কবিতা পড়তে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো এরা কারা?
দেখা গেছে এদের অনেকের উত্থান এমন পরিবার থেকে যাদের আগের প্রজন্ম বাম সমর্থক ছিলেন বা এখনো রয়েছেন। এখন সুকৌশলে ক্ষতিকর বিদ্বেষের মনোভাব প্রবেশ করানো হচ্ছে উভয় ধর্মের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। দেশাত্মবোধ , জাতী প্রীতি বা ধর্ম প্রীতি না থাকা সত্বেও পরস্পরের মধ্যে তীব্র বিদ্বেষ কেন ? কোন একটি শ্রেণী তাদের নোংরা রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই অন্ধ রোবট শ্রেণীর সৃষ্টি করে চলেছে।
দীর্ঘ সময় ধরে এই রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গেল। রাজ্যবাসীকে প্রাণ দিয়ে তার গুনাগার দিতে হচ্ছে। এ নিয়ে হাজারো চর্চা হয়েছে তাই লেবু কচলাতে আর ইচ্ছে করছে না।
আমার পেশা অনুযায়ী আঠেরো থেকে তিরিশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা আমার ছাত্র-ছাত্রী। যাদের সঙ্গে সরাসরি আমার ভাবের আদান-প্রদান ঘটে প্রতিনিয়ত। আমি এমন একজন মানুষ যে কখনো কোন বেড়া বা আড়াল আবডাল রাখেনি ছোটদের সঙ্গে তা ছাত্র, আত্মীয় প্রতিবেশী যেই হোক না কেন। সঠিক রং নির্দেশ করা আমার শিশু বয়সের অভ্যাস। এই কারণে আমি অনেক মানুষের অপ্রিয় হলেও ওই একই কারণে তারা সামনাসামনি কিছু বলতে সংকোচ বোধ করে। খোলামেলা সম্পর্ক রাখার কারণে চিরকালই ছোটদের খুব কাছের মানুষ ছিলাম। হালে হয়তো সবার কাছে সেটা থাকতে পারছি না। এদের একটি অংশ এখন সমস্ত কিছু বিচার করে রাজনৈতিক মতাদর্শের নিরিখে। সম্পর্কের ব্যাপারটাঝ বাদ নেই এর থেকে। তুমি আমাদের সমর্থক নও মানে তুমি শ্রেণীশত্রু। আগে পছন্দ না হলেও সামনে বলেনি, যেটা এখন অনেকের কণ্ঠস্বরে ধরা পড়ছে।
প্রতিটি নির্বাচনের আগে নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা হয়, এবছরও যেমন হয়েছে। অনেকের প্রশ্ন থাকে," স্যার ভোটটা কোথায় পড়বে ?" যারা দামাট বা নির্বোধ এবং দলদাস তাদের বাদ দিয়ে প্রশ্ন রেখেছিলাম," বল কাকে ভোট দেবো এবং কেন দেব ?"
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক ছাত্রী একদিন বলল, "স্যার ভারতবর্ষ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র হলেও এ কি ধরনের গণতন্ত্র ?"
" তার মানে ?" আমি এবার একটু কৌতুহলী বোধহয়।
মেধাবী মেয়েটি বলে ," দেশের জনসংখ্যার অতি সামান্য একটি অংশের ভোট পেয়ে কোনো রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে।" এই বলে গত লোকসভা নির্বাচনের একটি স্ট্যাটিসটিকস বুঝিয়ে দেয়। সবাই বুঝতে পারে কেননা অংক কোনদিন মিথ্যে কথা বলে না।
মেয়েটি এর সঙ্গে সংযোজন করে, "গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধি জায়গায় গিয়ে মহারাজাধিরাজ বনে যায়। দু-একজন অশিক্ষিত মানুষ গণতন্ত্রের বলে বলিয়ান হয়ে কোটি কোটি মানুষের নিয়ন্ত্রক হয়ে যায়। এর মানে, যা হল তা একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারিতার নামান্তর। এরা তো দেখি সংবিধান আইন, কানুন, কোর্ট কিছুই মানে না।
আমি বলি," সে কারণেই তো রাজনীতি এখন সবচেয়ে লাভজনক পেশা, সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এবং গ্ল্যামারের দুনিয়া। দেখিস না বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রথিতযশা মানুষও রাজনৈতিক ছায়ার তলায় আসার জন্য ব্যাকুল। কেউ কেউ দলদাস বটে কেননা এখানে এসে নিজস্বতা হারিয়েছে। " তারপর বলি,"ভোটাধিকার প্রয়োগ করা নাগরিক কর্তব্য। ভোটটা কাকে দিচ্ছিস এবার ?"
" কাউকে তো আলাদা দেখিনা তবে যেন একজন স্বৈরাচারী শাসক নির্বাচনে আমার কোন ভূমিকা না থাকে। জানি ঠিক বলছি না কিন্তু নিজের কাছে অন্তত পরিষ্কার থাকব।" তার কণ্ঠস্বরে অসহায়তা ফুটে ওঠে।
প্রতিটি নির্বাচনে এমন কিছু পরিচিত মানুষ থাকে যারা প্রথম ভোটদানের অধিকার লাভ করল। এবার এদের সঙ্গে আমার মেয়েও ছিল। প্রথম ভোট দানের একটা উত্তেজনা থাকে বৈকি। কিন্তু কোথায় তা এবার ? প্রার্থীদের চরিত্র এদের কাছে পরিষ্কার। চাকরি এবং সামগ্রিক বিষয় নিয়ে যা চলছে সে সম্পর্কে এরা ওয়াকিবহাল। সিস্টেম সম্পর্কে সম্পূর্ণ হতাশ। প্রথম ভোটদানের ক্ষেত্রে অনেকের আঙুল তাই NOTA র দিকে এগিয়েছে। গণতন্ত্রের নিরিখে এটি মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। কিন্তু সেসব নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। যাদের ভাবার কথা তাদের মূল লক্ষ্য হলো যেনতেন প্রকারেন জিততে হবে।
কণ্ঠরোধ ব্যাপারটা চিরকালীন হলেও আমাদের কম বয়সে খুব একটা উপলব্ধি করতে পারিনি। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময় আমরা শিশু ছিলাম। এখন অবশ্য এটির আমদানি হচ্ছে ভিন্নরূপে। গতবছর একটি ওয়ান লাইনারের কারণে শিক্ষকদের কাছ থেকে চরম খিস্তি খেয়েছিলাম। যদিও বক্তব্যটি তাদের উদ্দেশ্যে ছিলনা। ওই " ঠাকুর ঘরে কে রে" র মত ব্যাপারটি আরকি। পরের দিন একটি লেখায় শিক্ষকদের অধিকার সম্পর্কে একটি গাইডলাইনের উল্লেখ করায় অনেক শিক্ষকের কাছে সেটি গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। অনেকেই তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে আমায় সমর্থন করেছিলেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার খর্বতার উল্লেখ থাকায় পরদিন ফেসবুক থেকে পোস্টটি ডিলিট করা হয়। তারমানে আপনার উপর সর্বদা নজরদারি চলছে, সুযোগ পেলেই গলা চেপে ধরবে।
সবচাইতে দৃষ্টিকটু কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক অভিনেতা অর্থাৎ কলাকুশলী শ্রেণীর রাজনৈতিক আচরণ। সেলিব্রেটি হয়েও ক্ষমতার কাঙাল। কেউ উচ্ছিষ্টতেই সন্তুষ্ট আবার কেউবা নির্বাচন টিকিটের প্রত্যাশী। প্রয়োজনে অনবরত জার্সি বদল হচ্ছে, মুখে অবশ্য জনসেবার কথা। এই সমস্ত উচ্ছিষ্টভোগী দলদাস শ্রেণীর বাইরে আছেন কিছু মানুষ। হালে এইসব তরুণ-তরুণীরা একটি গান গাইবার কারণে কোন বাবাজি নাকি তাদের রগড়ে দেবার কথা বলেছেন। মানে আমাদের গুনকীর্তন করো নইলে রগড়ে দেব। অতীতে দুষ্ট প্রজাকে শাসন করার জন্য বাঁশডলা দেওয়া হত। যা অবস্থা দেখছি বাঁশডলা খাবার দিন আগতপ্রায়।
কলমে দেবব্রত তরফদার।
আপনার মতামত দিন: