SAHA ANTAR
Published:2021-05-23 16:36:33 BdST
ফেসবুক সাহিত্য
দেবব্রত তরফদার
_______________________
এই ধরনের লেখা বোধহয় আগে
অনেকবার লেখা হয়েছে। তবুও মনে হয় প্রতিটি লেখায় বোধ হয় ধরন ধারণে আলাদা। পৃথিবীর বহু মানুষের জীবনের একটা অংশ দখল করে বসে আছে এই সোশ্যাল মিডিয়া। শুধু তাই নয় এই মিডিয়ার অস্তিত্ব না থাকলে বহু মানুষের অনেক প্রতিভা বোধহয় সুপ্ত অবস্থায় থেকে যেত। অদ্ভুত এই ভার্চুয়াল জগত। পরস্পরের প্রতি কিছু না জেনেও একাত্ম হওয়া যায়। আলাপের শুরুতে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আবার ধীরে ধীরে সম্পর্কের সূত্র ক্ষীণ হয়ে আসে। শেষের বাক্যটি অধমের নিজস্ব অভিজ্ঞতা। অন্যদের ক্ষেত্রে কি হয় সেটা তারা নিজেরাই বলতে পারবেন।
দশ বছরের ফেসবুক জীবনে প্রথমে ছিল শুধু খোঁজার পালা। হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খোঁজার মধ্যে ছিল উত্তেজনা। এরপর ফেসবুক ছবি ময়। নিজের ছবি বা নিজের তোলা ছবি। প্রথমে স্মার্ট ফোন ছিল না। ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপের নির্ভরতা কাটিয়ে যেই স্মার্টফোন বাজারে ঢুকলো তখন ছবির স্রোতে ভেসে গেল মানুষের জীবন। অবশ্য সুবিধা আছে, আনফলো করলে ছবিদাতাগণ টেরও পাবেন না। এর সঙ্গে ছিল ছবি ট্যাগের অত্যাচার।
যাই হোক সে সব অবস্থা কাটিয়ে ফেসবুক এখন বাঙালির সাহিত্যচর্চার পীঠস্থান। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে নদিয়া বইমেলার স্টল চালিয়েছি। সেখানে প্রতি বছরে শুধুই পরিচিত মুখ। নতুন পাঠক কোথায় ? তখন ধারণা হয়েছিল বাংলা ভাষা সাহিত্যের বোধ হয় শেষ সময়ে উপস্থিত। বর্তমানে দেখি পাঠক তেমন না বাড়লেও সাহিত্য সৃষ্টিকারীর স্রোত নায়াগ্রা জলপ্রপাত তুল্য। কাজেই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসালাম। নিজের জীবনপঞ্জি ফেসবুক দেওয়ালে গড়গড়ায় আর তার সঙ্গে পুরনো পরিচিতরা অবাক হন অধমের সাহিত্য প্রতিভায় ( য্যান আর একখ্যান শরৎচন্দ্র বা বিভূতিভূষণ এর উদয় হল ) আর ক্রমাগত নতুন বন্ধুর সংখ্যা বাড়ে। তবে এই সময়ে অনেক ঘনিষ্ঠজনের স্বীকারোক্তি ছিল যে পড়া থেকে দূরে সরে গেছেন বহুকাল আর ফেসবুক থেকে তাদের নতুন করে পড়ার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে। কাজের ফাঁকে সময় কাটানোর এক বিনোদন বৈকি। এরা বইমুখী না হলেও ফেসবুকের নতুন ঘরানার অনু লেখার পাঠক।
প্রাতিষ্ঠানিক নামী লেখকগন প্রথমে এই মিডিয়া থেকে দূরে ছিলেন। এঁরা এইসব ফেসবুক লেখকদের অনুকম্পার চোখে দেখতেন আর কি। পরে দেখলেন আরে বাঃ, হেঁজিপেঁজি লেখকের লেখার কাটতি তাদের অনেকের চাইতে বেশি, তাই এই প্ল্যাটফর্মকে প্রচারের মাধ্যম হিসেবে সপারিষদ নেমে পড়লেন। এই সমস্ত লেখককুল অবশ্য ফেসবুকে লেখা পোস্ট করেন না। এই ব্যাপারে এখনও এরা নির্মম (hard) ফেসবুক লেখকদের মত নরম সরম ( soft ) নন।
তবে ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের বিড়ম্বনা একেবারে নেই তা নয়। সম বৈশিষ্ট্যের মানুষেরা একসঙ্গে জড়ো হবেন এ আর নতুন কি। এখানে "সকলেই স্রষ্টা নন কেউ কেউ স্রষ্টা" এই তত্ত্ব একেবারেই অচল। তাই লেখক বন্ধুকে অবশ্যই পাঠক বন্ধুর লেখা পড়তে হবে তা সে লেখার ভারে যতই নুব্জ হয়ে যান না কেন। ভাল কিছুর সঙ্গে বেনোজল সব সময় বেশি থাকে। এক একজনের দৃষ্টি উৎপাদনের দিকে, গুণমানের দিকে নয়। (বিশেষ করে শিক্ষিত অবসরপ্রাপ্ত মানুষজন। আসলে এঁরা এককালে শুধু পাঠক ছিলেন। এখন দেখলেন হাত মসকো করলে আর ক্ষেতি কি। নামাতে পারলেই দুর্দান্ত , অসাধারণ এসব থেকে আটকাচ্ছে আর কে। কাজেই অনবরত জন্ম নিচ্ছে উপন্যাস গল্প কবিতা অনুগল্প মুক্তগদ্য। কি নেই এখানে। রানী মৌমাছিও হার মানে আর কি। অথচ পাঠকের অভাব যে বড়। তাই পাঠক ধরার জন্য ঘোলা জলে মাছ ধরার মতো পলো নিয়ে নেমে পড়তে হয় লেখককে। "লেখক নন অথচ সুপাঠক" এঁরাই হলেন পাঠক জগতের রাঘব বোয়াল। লেখকরা এদেরই সন্ধান করে থাকেন।
সাহিত্যচর্চার আঁতুড়ঘর হিসাবে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ফেসবুক গ্রুপ। সাহিত্যচর্চার পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ এর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক মন্ডলীর সবাই লেখক। অধিকাংশ গ্রুপে যত নিয়ম কানুন থাকুক না কেন পরিচালকমণ্ডলীর আত্মপ্রচারই প্রধান উদ্দেশ্য। এর সঙ্গে রয়েছেন এঁদের চাটুকারের দল যারা প্রশংসা শব্দ এবং বাক্যের ঝুড়ি নিয়ে সদা সঞ্চারণশীল। যাঁরা ভাল লেখেন তাঁদের কাছে আসে খোলাখুলি আমন্ত্রণ আর তাঁর সুপাঠ্য লেখার কারণে গ্রুপে পাঠকবৃত্তের পরিধি ছড়ালেই মুশকিল। গোঁসা করার অধিকার কার নেই। তবে সরাসরি নয়, মহানাগরিক শিক্ষা মানুষকে মোড়কবদ্ধ করতে শেখায়।
অধিকাংশই একাধারে লেখক এবং পাঠক তাই পরস্পরের পিঠ চাপড়ানো থাকবে না তাতো হতে পারে না। অধিকাংশের সুস্থ সমালোচনা না পসন্দ। তাই ঝোপ বুঝে অকাতরে সুন্দর, চমৎকার , অসাধারণ অতুলনীয়, লা জবাবের কোপ দিতে অসুবিধা কোথায় এবং অনেক সময় না পড়েও। হোক না ভার্চুয়াল রিলেশন, খামোখা সম্পর্ক খারাপ করে লাভ কি
( পাঠক আর কে হারাতে চায় )। ঝামেলা অনেক। যেমন পাঠক লিখতে শুরু করলে তাঁর মন আর পড়ার দিকে থাকে না থাকে পড়ানোর দিকে। এইভাবে সুপাঠকের মৃত্যু হয়। এইভাবে অনেকভালো লেখক এর কম পাঠক। যেটা আমরা বাস্তবের বইয়ের দুনিয়া তো দেখেছি। আসলে মার্কেটিং একটি বড় ব্যাপার। তাই অতি সাধারণ লেখা হিট হয়ে যায় এবং সেইসঙ্গে লেখক নিজেও। খোলা জায়গা হলেও সঠিক লেখা সঠিক পাঠকের কাছে পৌঁছায় না। অথচ গ্রুপের পরিচালকগণ এটা ইচ্ছে করলে করতে পারেন। নামি পত্রিকার পত্রিকা সম্পাদক যেটা করে থাকেন। অধিকাংশ গ্রুপে প্রকৃত পাঠক এক শতাংশেরও কম। এখানে যেমন বিভিন্ন রকম নিয়মিত সম্মাননা ইত্যাদির প্রচলন রয়েছে। আর অতীতে এক লাইন না লিখেও এগুলির অধিকারী হয়ে আত্মশ্লাঘার উদ্রেক না হওয়ার কি রয়েছে। অনেকের সন্মাননার সেঞ্চুরি হয়ে গেছে। কেননা অনেক লেখক শতাধিক গ্রুপের সদস্য। কিন্তু মোদ্দা ব্যাপার, পাঠক নেই। কি কারনে এইসব ব্যাঙের ছাতা ধুনো জ্বালিয়ে বসে থাকে তা কে জানে। যে কোন দলের প্রধান হতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সেরকম মানসিকতা আর দেখা যাচ্ছে কই।
আবার অধিকাংশ লেখক বিভিন্ন গ্রুপে ঘুরে বেড়ান খ্যাপলা জাল বা বেড়াজাল হাতে। যদি দু-একজন স্থায়ী পাঠকের সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে আর ক্ষতি কোথায়।
কি আর করা যাবে , বাজারে এখন এইসব চলছে যে। এটাই এখন ফেসবুক লেখকদের টিকে থাকার লড়াই। তবে একাধারেই সুলেখক এবং সুপাঠক কম নেই। দুর্দান্ত সব লেখা চোখে পড়ে যা লিখতে পারলে অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতেন। তেমনি সুচিন্তিত মতামতে সমৃদ্ধ করার মানুষ রয়েছেন অনেক। অনেকের মতামত এতটাই তথ্যসমৃদ্ধ এবং বলিষ্ঠ যে 'এরকম একজন পাঠকের জন্যই লেখা যায়' বলে মনে করেন লেখক। । আরো রয়েছেন কিছু শিক্ষকের মত মানুষ যাঁরা নিয়মিত ইনবক্সে ক্লাস নিয়ে থাকেন। তবে গুরু মিললেই হবেনা শিষ্য মেলা দরকার।
শেষে আবার সমকালীন সময়ের কথা মনে আসে। ইদানিং তারাদের দেশে চলে যাওয়া মানুষেরা ফেসবুকে ভীষণভাবে জীবন্ত। কেননা তাঁদের একাউন্টটি মৃত নয়। লেখা ট্যাগ করার সময় এদের মুখগুলি সামনে এসে পড়ে। মনে হয় যেন ট্যাগ করা মাত্র এঁরা লেখা পড়ে মন্তব্য লিখতে শুরু করবেন।
এই লেখাটি লিখতে লিখতে খগেশ আচার্য দাদার কথা মনে পড়ছে খুব। এমন ধৈর্যশীল সুপাঠক সত্যিই বিরল। বহু লেখকের লেখাতেই উনি দীর্ঘ দীর্ঘ মতামত দিতেন। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালো হওয়ায় অনেক সময় কঠোর হতে পারতেন না। ব্যক্তিগত পরিচয় হয়েছিল। উনি চলে যাবার পর পরিবারের মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি যে বাড়ীর মানুষদের ওর পছন্দের লেখা পড়াতে বাধ্য করতেন। আমার প্রকাশিত বইটির দাদার হাতে পৌঁছেছিল। একটি জম্পেশ রিভিউ এর আশায় ছিলাম। তেমনি মনে পড়ছে প্রিয় বন্ধু গৌরিশঙ্করের কথা। যে সমস্ত বাল্যবন্ধুর অনুরোধ আর প্রেরণায় অবেলায় হাত মসকো করতে শুরু করেছি এ তাদেরই একজন। আমার প্ৰথম উপন্যাসের ছায়ামানুষদের একজনও বটে।
কতকিছুই অসমাপ্ত থেকে যায় মানুষের। খগেশ দাদার বইটির শেষ পর্যন্ত পড়া হয়নি। গৌরীশঙ্কর নতুন লেখাটি সম্পর্কে অতি উৎসাহী হলেও ওর আর পড়া হলনা।
বয়স বাড়তে থাকলে অনেক কিছুর সঙ্গে মানুষের আক্ষেপের সংখ্যাও বাড়ে বৈকি।
কলমে দেবব্রত তরফদার।
সৌজন্যে বাংলাভারতী চিন্তন সঙ্ঘ
আপনার মতামত দিন: