ডেস্ক

Published:
2021-05-11 16:11:10 BdST

স্থান -কাল -পাত্র ' বিবেচনা করে কথা না বললে কি পরিণতি হতে পারে


ডাঃ সুকুমার সুর রায়
_____________________

""স্থান -কাল -পাত্র ""
-------------------------------
স্থান -কাল -পাত্র ' - বিবেচনা করে কথা না বললে কি পরিণতি হতে পারে তা আমরা সবাই জানি।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে দেখা যায় - "আত্মার" কোন মৃত্যু নাই, জন্ম নাই। পানিতে পঁচে না, রোদে শুকায় না,আগুনে পোড়ে না। অমর অজর এক স্বত্তা। জড় জগতের বন্ধনমুক্ত এক চিন্ময় স্বত্তা।
হতে পারে তা কোন সুক্ষ্মকনিকা কিংবা সুক্ষ্ম তরঙ্গ, কিংবা উভয়ই। জড় বন্ধনমুক্ত এক মহাজাগতিক চেতনা। যদি আত্মা নামক কোন স্বত্তার অস্তিত্ব আমরা মেনে নেই।

চিন্ময় দাস আজ কোভিড জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করলেন।
কোন সে পরলোক?
জড়জগৎ থেকে চিন্ময়লোক। স্থুল জড়লোক থেকে অতি সুক্ষ্ম কনিকা বা তরঙ্গললোক।
অতি সুক্ষ্ম কনিকা ভরহীন তরঙ্গে পরিনত হওয়ার সংগে
সংগে তিনি আলোর গতিতে ছুটতে লাগলেন কনা পদার্থবিদ্যার সূত্র অনুযায়ী।
যেই তিনি আলোর গতিপ্রাপ্ত হলেন সংগে সংগে তার সময় থেমে গেল। ঘড়ির কাঁটা স্তব্ধ হয়ে গেল।
তিনি হয়ে গেলেন মহাজগতের অংশ ও সাক্ষী।
বিশেষ আপেক্ষিকতার সূত্র অন্তত এইরকম ভাবেই বলে।

তিনি তখন সূদুর মহাজগত থেকে দেখতে পাবেন তার ছেড়ে আসা পৃথিবীর সময়ের বিবর্তন । তার স্ত্রী পুত্র পরিবার কেমন করে স্থানকালের আবর্তে আবর্তিত হছে! বংশ বিস্তার হচ্ছে, স্থান কালের আবর্তে বুড়িয়ে যাচ্ছে! মৃত্যু বরন করছে, নতুন প্রজন্মের উৎপত্তি হচ্ছে।!
অথচ তখন তিনি পরিণত হয়েছেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের অতি ক্ষুদ্র কনায়। এই আছেন! এই নাই! থাকাটাও যেমন বাস্তব, না থাকাটাও সমান বাস্তব!।

অতি সরলিকৃত ভাষায় - 'স্থান' বা জায়গা (space),
'কাল' বা সময় (Time), এবং 'পাত্র' বা ব্যাক্তি (subject) বলতে আমরা কি বুঝি!?

ধরুন আপনার গ্রামের স্কুল মাঠটি একটি 'স্থান'।
সেই 'স্থান' বা মাঠটির একটি পরিমাপ আছে। এটি একটি ফুটবল মাঠের সমান। এটি আপনার গ্রামের উত্তর পাশে অবস্থিত। এই ফুটবল মাঠের অবস্থান পৃথিবী সাপেক্ষে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ দ্বারাও প্রকাশ করা যায়।
এই মাঠে গ্রামের কিছু মাতব্বর এক বিচার শালিশের আয়োজন করেছে।
বিচার বসেছে গ্রামের 'আকাশ পাগলের ' বিরুদ্ধে।
'আকাশ পাগল ' - 'আকাশ ' নিয়ে গবেষনা করেন আর যতসব আজগুবি কথা বলেন।

তার সেই সব আজগুবি কথা বার্তায় ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গ্রামের সব ছেলে বুড়া তাকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই শালিস বসিয়েছে। সম্প্রতি ' আকাশ' বলতে শুরু করেছে - " সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হয়।!! "
কি ভয়ানক কথা!
এই ভয়ানক কথার বিধিবিধান করে এক চরম শাস্তির ব্যবস্থা না করলে গ্রামের কারোরই মান ইজ্জত থাকে না।
ফুটবল মাঠ নামক স্থানে সমাগত গ্রামবাসীরা হল পাত্র পাত্রী বা ব্যাক্তি (subjects)।

২০২১ সালের ৫ ই মে বেলা দশ ঘটিকার সময় ফুটবল মাঠে এই শালিস বসেছে।
অতএব ' সময়' বা ' কাল' (time) হল ২০২১ সালের ৫ই মে বেলা ১০ টা।

এখানে ফুটবলমাঠ স্থির ও অপরিবর্তনীয় একটি জায়গা। (পৃথিবীর সাপেক্ষে বিজ্ঞানী নিউটন তাই বলেছিলেন) ।

'সময়' বা 'কাল', ফুটবলমাঠ থেকে সম্পুর্ন আলাদা।
২০২১ সালের ৫ই মে বেলা ১০টায় সেখানে শালিস বসেছে।
আবারো ২০২২ সালের ৫ই মে বেলা ১০টায় সেখানে শালিস বসানো যেতে পারে। কিন্তু এবার সেই শালিসের পাত্র পাত্রিরা একই রকম থাকবে না।

কিন্তু কোন মতেই এক বছর পিছিয়ে ২০২০ সালের ৫ই মে বেলা ১০টায় একই রকম শালিস বসানো সম্ভব হবে না।
কারন সময়ের তীর শুধুমাত্র সামনের দিকেই চলে।
অতীতে যাওয়া যায় না।

এই যে 'স্থান' ও 'কালের ' অতি সরলিকৃত বিবরন পেশ করা হলো বিষয়টি এত সরল হলে বিজ্ঞানীদের কাছে তা এতো জটিল হতো না।

আমাদের ছোট্ট গ্রামের ছোট্ট ফুটবল মাঠের বেলায় এই অপরিবর্তনীয় বর্ননা নির্ভেজাল সত্যি।

কিন্তু অসীম মহাজগতের বেলায় এই বর্ননা মোটেই সত্যি নয়।
বিজ্ঞানী আইন্সটাইন ১০০ বছর আগে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব ও সাধারণ আপেক্ষিক তত্বের মাধ্যমে সেটি বলে দিয়েছেন এবং এখন পর্যন্ত সেটি প্রমানিত সত্য।

তাঁর ভাষায় 'স্থান 'ও 'কাল' আলাদা সত্বা নয় দুইটি মিলে একটিমাত্র স্বত্তা তা হল 'স্থান-কাল '!
২০২১ সালের 'স্থান- কাল' কখনোই ২০২২ সালের ' স্থান-কালের' সাথে মিলবে না।

যেদিন বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে সেদিনই ' স্থান-কালের' সৃষ্টি হয়েছে।
যেদিন বিশ্ব লয় হবে সেদিন ' স্থান- কালের'ও বিলুপ্তি হবে।
হবে নয়, হচ্ছে।
'ব্ল্যাকহোলে' চারিদিকের ' স্থান-কাল' অনবরত দুমড়ে মুচড়ে অতল গহবরে হারিয়ে যাচ্ছে।
মহাবিশ্ব কোন মসৃন ফুটবল মাঠ নয়।
এবড়ো খেবড়ো, দুমড়ানো মোচড়ানো এক জটিল কঠিন ' স্থান-কালের' চাদর মাত্র।
পৃথিবী নামক এক ছোট্ট গোলক ধাঁধার - 'স্থান-কালে ' আমরা আটকা পড়ে আছি।

আজ থেকে পাঁচ শতাব্দী আগে, গ্রামের ' আকাশ পাগলের' মত এক পাগলের আবির্ভাব হয়েছিল ইউরোপে।
তিনি আমাদের চির চেনা আকাশটিকে অনেক বড় দেখতে পেয়েছিলেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে আমাদের এই পৃথিবী সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু নয়।
আমরা আকাশ সম্পর্কে যা জানি আকাশ আসলে অত ছোট নয়।

তার কথাগুলি চার্চের বিরুদ্ধে যায়।
তাকে আটক করে স্কুল মাঠে শালিস বসানো হয়।

কয়েকবছর তাকে জেলখানায় আটকে রাখা হয় যাতে সে অনুশোচনা করে ক্ষমা চায়।

কিন্তু তিনি তার বৈজ্ঞানিক চিন্তন থেকে এক চুলও নড়েননি। উপরন্তু তিনি জেলখানায় বসে অনেকগুলি পুস্তক রচনা করেন যা হতে পারতো আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাথমিক দলিল।

কিন্তু না, তার পুস্তকাদি আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হলো। একই সাথে তাকেও জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলা হলো।
তিনি ছিলেন জিওর্দানো ব্রুনো।
যিনি প্রথম অসীম মহাবিশ্বের ধারনা দিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন সময়ের অনেক আগে জন্ম নেওয়া একজন দার্শনিক , একজন গনিতবিদ, একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী।
তিনি জন্মেছিলেন অন্ধকার মধ্যযুগে এক অবিস্মরণীয় আলোর স্ফুলিঙ্গ রুপে।
"স্থান - কাল - পাত্রের" অসামঞ্জস্যতার কারনে মাত্র ৫২ বছর বয়সে তাকে নৃশংস মৃত্যু বরন করে নিতে হয়েছিল।
তিনি নিঃসন্দেহে ছিলেন ইউরোপীয় রেঁনেসার অন্যতম পথিকৃৎ। যাঁর চিন্তার হাত ধরে পৃথিবী এগিয়ে গেছে বহুদূর।
কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় এই যে, পৃথিবীব্যাপী ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উম্মাদনা মানুষকে আবার সেই অন্ধকার গহ্বরে দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।।

----- ডাঃ সুকুমার সুর রায়।।।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়