ডেস্ক

Published:
2021-05-01 20:33:28 BdST

ডাক্তারি জীবন নিয়ে কিছু নিঠুর সত্য কথা


 


ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ
সুলেখক, দুই বাংলায় সম্মানীয় সঙ্গীতশিল্পী
----------------------

আমার অধিকাংশ সহকর্মী সারাবছর ফ্রাস্ট্রেটেড থাকে। কোভিড সময়ে ভিন্ন পরিস্থিতি। এটার জাজমেন্ট আলাদা। কিন্তু ইন জেনারেল বলছি।

সদ্য এমবিবিএস পাশ করে যারা বিভিন্ন ক্লিনিকে চাকরি করছেন ডিউটি অফিসার হিসেবে তারা ফ্রাস্ট্রেটেড। কারণ বললে অনেক কথা। পোস্ট গ্রাডে ঢুকতে পারছেন না। এমডি এম এস বা এফসিপিএস কোর্সে যেতে পারছেন না। বিসিএসটাও ধরা দিচ্ছেনা। এভাবে কদ্দিন চলবে কে জানে? ক্লিনিকের চাকরিতে সম্মান মিলেনা। সিনিয়রদের বকাঝকা আর সহ্য হচ্ছেনা।

যারা ফ্রাস্ট্রেটেড তাদের একটা বড় অংশ এফসিপিএস এবং এম এস/এমডি দুরকম ডিগ্রিরই প্রথম পর্ব সম্পন্ন করে বসে আছে। কেউ কেউ বিসিএসও। আবার ডিগ্রী পুরো সম্পন্ন করেও এবং বিসিএস হবার পরও অনেকে হতাশ। প্রফেশন থেকে কাংক্ষিত মর্যাদা তারা পাচ্ছেন না৷

নতুন বিশেষজ্ঞরা হতাশ। ভাল জায়গায় চেম্বার পাচ্ছেননা৷ রোগী আসে তো আসেনা। রোগীরা প্রফেসর কিনা জানতে চায়। দিনে হয়ত তিন চারটা রোগী পায়। শুক্রবারে দূর জেলায় খ্যাপে যায়। মাসে সাকুল্যে এক লাখ থেকে তিন লাখ রোজগার। কিন্তু তা দিয়ে তো চলছেনা।

খুব বিজি প্র‍্যাক্টিশনার গুলশান-বারিধারায় ফ্ল্যাট আছে এমন মানুষও ফ্রাস্ট্রেটেড। সামাজিকতা রাখতে পারেননা, ছেলে মেয়েদের সময় দিতে পারেননা বলে হতাশ। মানুষের মনের অশ্রদ্ধা পড়তে পারেন অনেকেই। সেটা পড়েও হতাশ। আর কিছু না হোক দেশে পুলিশ আর এডমিনের লোকেরা এত ক্ষমতাবান এটা দেখেও কেউ কেউ হতাশ।

এক বিখ্যাত প্রফেসর চিকিৎসক মারা গেলেন। বিএসএমএমইউ তে জানাজা হলো। জানাজায় মানুষ হলো সব মিলিয়ে গোটা পঞ্চাশ। তাঁর এক সহকর্মী বললেন স্যারের চেম্বারেও তো ডেইলি সিরিয়াল পড়ত এর চেয়ে বেশি। এই শুনে তাঁর বাকি সহকর্মীরা হতাশ। কি করতেছি আসলে?

এভাবে হতাশা গভীর হয়। আচরণে প্রভাব পড়ে। মেজাজ গরম থাকে বেশিরভাগ সময়। অন্যকে এক হাত নিতে পারলে ভাল লাগে।

এই হতাশার চক্র থেকে মুক্তি আসবে কিভাবে? কেন এই হতাশা?

আমি কারণ জানার চেষ্টা করি। কয়েকটা কারণ আমার মাথায় আসে। ভুল হতে পারে। আবার ঠিকও হতে পারে। অন্তত চিন্তার খোরাক হতে পারে।

অধিকাংশ ডাক্তার প্রফেশনটাকেই তার লাইফ ভেবে বসে থাকে। তার জীবনে যে আরো কিছু করার আছে, তার চিত্ত আরো কিছু চায় সেটা সে অনুসন্ধান করেনা। বাচ্চাদের ক্ষুধা লাগলে বুঝতে পারেনা তার ক্ষুধা লেগেছে। ঘ্যান ঘ্যন করে, তিরিক্ষি করে। খাবার দিলে পরে খেয়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ডাক্তারদের চিত্ত অস্থির হয়, কিন্তু বুঝতে পারেনা তার কি করা উচিত। অধিকাংশ ডাক্তার সপ্তাহের সাতদিনই কাজ করে। তার চিত্তবিনোদনের সুস্থ মাধ্যম নেই। সেটাতে সে অভ্যস্তও না। ছেলেবেলা থেকে তাকে এগুলোতে অভ্যস্ত করানো হয়নি। বরং তাচ্ছিল্য ও ঘৃণার চোখে দেখেছে। মন প্রফুল্ল করার প্রক্রিয়াটি তার কাছে ফূর্তিবাজি বলে বোঝানো হয়েছে৷ এই কাজটি এক শ্রেনীর গার্জিয়ানরাই করে। ছোটবেলা থেকেই " পড়, নাইলে রিকশাওয়ালা হবি" এসব বলে বলে তাকে মানসিকভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। খেলতে গেলে বলা হয়েছে "আজাইরা কামে টাইম নষ্ট করস ক্যান? পড়লে কামে দিবে" । এই ভাবনার চক্র থেকে সে বের হতে পারেনা। সে কাজ করে, ডাক্তারি করে, পড়ে। কিন্তু ভাল লাগেনা৷ যা করলে ভাল লাগতো তা করলেও মনে হয় "এইটা কি ঠিক হইল? পড়লে বা চেম্বারে গিয়ে দুইটা রোগী দেখলেও কামে দিতো"।

জীবন ভারসাম্যের খেলা। ভাল লাগা, দায়িত্ববোধ, কর্তব্য, কাজ সব মিলিয়ে চলতে পারলেই জীবন সুন্দর।

এক জীবনে সব পাওয়া যায়না। আপনি দরবেশের সম্মান, ব্যাবসায়ীর প্রাচুর্য, পুলিশের ভীতি, সচিবের ক্ষমতা এক জীবনে পাবেন না। তাই আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি কি চান? যা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন তা গ্রহন করুন। বাকিদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলুন। একে অপরে মিলে জীবনের প্রয়োজনগুলো মিটিয়ে নিন। এককভাবে সব অর্জন হবেনা।

ডাক্তাররা আশা করে সে যেহেতু মেডিকেলে চান্স পেয়েছে, কঠিন সিলেবাস পড়েছে সুতরাং সে সমাজের সবচেয়ে বেশি সম্মান পাবে। কিন্তু বাস্তবে এটা হয় মেডিকেল স্টুডেন্ট থাকা অবস্থা পর্যন্তই। সমাজের সবাই খুব আদর করে। মেডিকেলে পড়ে -কি ব্রিলিয়ান্ট! কিন্তু এরপরই সামাজিক বাস্তবতা পালটে যায়। ডাক্তারের কাছে সমাজ সার্ভিস চায়। এখানে ব্রিলিয়ান্সের মর্যাদা দেবার সময় নেই। কারণ সমাজের সাথে তার সম্পর্কটা এখন দেওয়া নেওয়ার।

কেউ আপনাকে সেধে কিছু দেবেনা। না অর্থ, না সম্মান। যুদ্ধ করেই পেতে হবে। যুদ্ধ মানে গৌরব। যুদ্ধে হতাশার স্থান নেই। আপনি আপনার উপযোগিতা বোঝাতে পারলে সম্মান আপনাকে দিতে বাধ্য৷

ডাক্তাররা সারাক্ষণ প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকে। তার লাইফ একটা ভিডিও গেইমের মত। একেকটা লেভেল পার হবে, পরের লেভেলটা আরো কঠিন হবে। কিন্তু এই লেভেল ক্রসিংকে খেলা বা গেইম হিসেবে নিলেই কিন্তু আপনি উপভোগ করতে পারবেন। যেটা ভিডিও গেমাররা করে। কিন্তু ডাক্তাররা ভাবে গেইমের পরের স্টেপে না গেলে " এই জীবন লইয়া কি করিব? "

আমাদের সমাজে ইন্ট্রোভার্ট, ঘরকুনোরা পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করে। এদের একটা বড় অংশকে বাপ, মায়েরা ঠেলে ঠুলে ডাক্তার বানায়। এটা আমার কাছে আরেকটা ডিজেস্টার মনে হয়।

যে ছেলেটা ইন্ট্রোভার্ট তার জন্য ডাক্তারি জীবন অনেক বৈরি হতে বাধ্য। এটা পাবলিক রিলেশন টাইপের জব। দামী কার্পেটের অফিস, জ্বি হুজুর করা পিওন আর্দালির স্বপ্ন নিয়ে এই পেশায় আসলে আপনি হতাশ হতে বাধ্য৷ ন্যুনতম ফ্যাসিলিটিজ আপনি চাইতে পারেন। সেটা ভিন্ন জিনিস। কিন্তু নিজের মাইন্ড সেটিং টা নিজেই আপনি বুঝে নেবেন।

অনেক কথা বললাম। আরো অনেক কথা হয়ত আছে। এইসব ব্যাখ্যার পরও মানুষ হতাশ হবে। এমনকি আমিও হতাশ হতে পারি। এটাই হিউম্যান নেচার৷ একই প্রাপ্তিকে একাধিক মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিচার করে। যেমন আমার কাছে মনে হয় দেশ আমার মত দরিদ্র পিতার সন্তানকে ডিগ্রি দিয়েছে। আর কি দেবে? এবার আমার দেবার পালা। আবার এই আমারই মনে হতে পারে আমি এত মেধাবি হয়ে এই দেশে কি পাইলাম?

তবে আসল মোরালটা হলো হতাশ হওয়া যাবেনা। হতাশ মানুষ সবাইকে ভারাক্রান্ত করে। যা সমস্যা না তাকেও সমস্যা বানিয়ে ফেলে। এই যেমন হাসপাতালে নাচার বিষয়টাকেই দেখুননা। এর তেমন কোন নেতিবাচক দিক না থাকলেও কতিপয় তরুনের আনন্দ বার্তাটিতেও কেউ কেউ রেগে গেছেন। কারণ হতাশ মানুষ অন্যকে আনন্দিত দেখলেও বিরক্ত হয়। এদের মনে তখন কাজ করে "জগতে এত সমস্যা, এদের এত সুখ আসে কইত্তে? "

অবশ্য হাসপাতালে নাচার কারণে কোন রোগী মারা গেলে বা স্বাভাবিক কার্যক্রমে অসুবিধা হলে অন্য কথা। মনে হয় তেমন কিছু হয়নি। হয়েছে কি?

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়