Dr. Aminul Islam

Published:
2021-03-26 19:31:46 BdST

একাত্তরে চড়িয়া গ্রামে গনহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ


 

ডাঃ সুকুমার সুর রায়


____________________________
( ৭১ সালের ২৫ এপ্রিল 'চড়িয়া গ্রামে' চোখের সামনে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক সত্যি ঘটনা অবলম্বনে)

২৫ শে মার্চ রাত হলো আমাদের ইতিহাসের কালো রাত।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী "অপারেশন সার্চলাইটের " নামে এই রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালি জাতিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল।
অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে ঢাকাতে যে বাংগালী নিধনের শুরু তা কালক্রমে সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
আসলে গোটা দেশ ৭ই মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হুকুমমত চলছিলো। সেই অসম সাহসী বীর বাঙালিদের নিয়ন্ত্রিত তাদের নিজেদের দেশকে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আধুনিক অস্ত্রের জোরে নৃশংস ভাবে দখল করে নিচ্ছিলো। নিরস্ত্র বাংগালিদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে তারা মুলত বাংগালি জাতি সত্বাকে নির্মুল করতে চেয়েছিলো।

আমার আলোচ্য দিন তারিখ ২৫ শে মার্চ নয় , ঠিক এর এক মাস পরে ২৫ শে এপ্রিল সকাল বেলা ।
ঢাকায় ক্র‍্যাক ডাউনের পরে আমাদের গ্রামে চলছিল এক নিরব আতংক ও উত্তেজনা। ঢাকা থেকে গ্রামের ছাত্র যুবকেরা চলে এসেছিল । জেলা শহর থেকেও অনেক পরিবার দশ কিলোমিটার দুরের এই গ্রামের দিকে চলে এসেছিলো।

নির্বাচিত এমএনএ মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ একদিন বিকালে পাচিলা স্কুল মাঠে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষনের সূত্র ধরে তিনিও যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই পাকিস্তানি মিলিটারির বিরুদ্ধে প্রস্তুত থাকতে বললেন।

মানুষের মাঝে এক দারুন উৎকন্ঠা দেখা দিলো। ঢাকা থেকে যারা ফিরে এসেছিল তাদের কাছ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা শুনে মানুষ ' থ' হয়ে গিয়েছিল।
ছাত্র যুবকেরা পাচিলা স্কুল মাঠে প্রতিদিন সকালে হাসান কমান্ডারের নেতৃত্বে বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে সামরিক ট্রেনিং নিতে শুরু করে দিলো।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের বৈঠকখানায় যথারীতি রেডিওর আসর বসতে শুরু করলো।
রেডিওর খবর, কথিকা, সংবাদ ভাষ্য, দেশাত্মবোধক সঙ্গীতে উজ্জীবিত হয়ে কোন কোন দিন রাতেই মিছিল বেরিয়ে পড়তো _ ' বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধর - বাংলাদেশ স্বাধীন কর। তোমার আমার ঠিকানা - পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। তোমার দেশ আমার দেশ - বাংলাদেশ বাংলাদেশ ।

এভাবেই দিন যেতে লাগলো। তখনো আমাদের মহুকুমা শহরে পাকিস্তানি মিলিটারি এসে পৌছে নাই। কিন্তু চারিদিকে নানা রকমের গুজব, আতংক আর কানাঘুঁষা চলছিলো।

অবশেষে এলো ২৫ এপ্রিলের সেই সকাল।
বৈঠক খানায় প্রতিদিন সকালে যেমনটি হয় তেমনি রেডিওর খবর শোনার আসর বসেছিল।
হঠাৎ এক অজানা শব্দে সবাই সচকিত হয়ে উঠলো। বৈশাখের মেঘ যেমন গুরুম গুরুম করে দুর থেকে ডেকে ওঠে তেমনি গুরুম গুরুম শব্দে পশ্চিমের গ্রামগুলি কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো।
সবাই গ্রাম ছেড়ে দক্ষিনের খোলামাঠে জড়ো হতে লাগলো এবং হাঁ করে পশ্চিমের পাচিলা গ্রামের ওপারে চড়িয়া গ্রামের দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো।
ওই দিক থেকেই একনাগাড়ে গুরুম গুরুম শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হতে লাগলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঐসব গ্রামের উপর দিয়ে আগুনের শিখা ও ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখা যেতে লাগলো।
আর কিছুক্ষন পরেই দেখা গেল বহু লোক দিগবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে উর্দ্ধ্বশ্বাসে পূর্বদিকে ছুটে আসছে, কারো মাথায় বোচকা বাস্কি, কেউবা গরুছাগল তাড়িয়ে নিয়ে আসছে, কেউবা শুন্য হাতে শুধুমাত্র পৈত্রিক জানটি হাতে নিয়ে ছুটে চলে এসেছে।
প্রশ্ন করে কারো কাছেই কোন সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। তাদের ঘোলাটে দৃষ্টিতে, চোখে মুখে রাজ্যের ভয় ও উৎকন্ঠা তাড়া করে ফিরছিলো ।
কেউ কেউ দুই এক কথায় যা বলতে পেরেছিলো তার সারমর্ম হল এই যে, পাকিস্তানি মিলিটারি হামলা করেছে। শত শত মানুষকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছে! তারপর বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এক কথায় বর্ননা করার মত ভাষা তাদের জানা ছিল না, তারা জন্ম থেকে কোনদিন এই বিভৎস দৃশ্য চোখে দেখা তো দূরের কথা বাপ দাদার আমল থেকে এপর্যন্ত কখনো কেউ এমন ভয়াবহ কথা কানেও শোনেনি!
গ্রামের 'কাদের ভাই ' আর্তচিৎকারের মত বলে উঠলেন _ " আর কোন উপায় নাই রে! লাঠি সোঁটা, হলঙ্গা, যার যা আছে তাই নিয়া প্রস্তুত হয়্যা যাও।!"

এরপর আটমাস ব্যাপী আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ চলেছিল।
যুদ্ধ শেষে জেনেছিলাম চড়িয়া গ্রামে শত শত লোককে নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলা হয়েছিল।

তারপর বছরের পর বছর পার হয়ে গেছে। নানা রাজনৈতিক উত্থান পতনে চড়িয়া গ্রামের শত শত মানুষের আত্মদানের ইতিহাস মানুষের মন থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে বসেছিল। বছর তিনেক আগে উল্লাপাড়া উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে সেইগ্রামে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল।
সিরাজগঞ্জ গনহত্যা অনুসন্ধান কমিটির সাইফুল ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় কয়েকমাস আগে কায়ুম হোসেন জুয়েল ভাইকে সাথে নিয়ে সেই গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।

উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ রোডের মোড় থেকে সামান্য দক্ষিনে এগিয়ে গেলেই চড়িয়া শিকার কবরস্থান। এই কবরস্থান থেকে পশ্চিম দিকে একটি চাপা রাস্তা নেমে গেছে হাইওয়ে থেকে গ্রামের দিকে।
সেই চাপা রাস্তা ধরে দেড় কিলোমিটার পথ এগিয়ে গেলেই চড়িয়া মধ্যেপাড়া।
চড়িয়া মধ্য পাড়া গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে একটি শহীদমিনার নির্মিত হয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫ শে এপ্রিল সকাল বেলায় এইগ্রাম এবং এর আশেপাশের ৩/৪ টি গ্রাম - চড়িয়া কালিবাড়ি, চড়িয়া শিকার দক্ষিন পাড়া, কান্দিপাড়া, গোলকপুরের প্রায় দেড়শো মানুষকে আধা ঘন্টার মধ্যে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলা হয়েছিল। সেই মৃত মানুষদের ১২৯ জনের নাম শহীদমিনারের স্মৃতিফলকে লিখে রাখা হয়েছে।
সেদিনের সেই লোমহর্ষক ঘটনাবলীর জ্বলজ্যান্ত স্বাক্ষী হয়ে এখনো অনেকেই বেঁচে আছেন।
এই বেঁচে থাকাদের একজন হলেন মোহাম্মদ গগন মন্ডলের পুত্র মোহাম্মদ আবু কাঙাল মন্ডল।
একটু খোঁজ করতেই কাঙাল মন্ডলের বাড়ি পাওয়া গেল।
কাঙাল মন্ডল তখন বাড়ির পাশের খেতে কাজ করছিলেন।
কাঙাল এক নিশ্বাসে সেদিনের সকালের যে বর্ননা দিলেন তা নিম্নরূপ। _
কাঙাল লেখা পড়া জানতেন না। তার বয়স ছিল সেসময় ১৬ কি ১৭ বছর।
তিনি পাশের শাজাহান সরকারের বাড়িতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। তার খাওয়া পড়া সেখানেই হয়ে যেত। সূর্য ওঠার অনেক আগে গোয়াল থেকে গরু বের করা দিয়ে তার দিনের কাজ শুরু হতো, তা চলতো অনেক রাত অবধি।
কাঙালের কোন দুঃখ ছিল না। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও সে আনন্দেই দিন কাটাতো।
ঘটনার দিন সকাল ৮টা কি সাড়ে ৮ টা হবে।
পূর্বদিকে ভয়ার্ত চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সে এগিয়ে এসেছিল কী ঘটনা তা জানার জন্য। ঠিক তখনই চোখাচোখি হয়ে গেল পাকিস্তানি মিলিটারির সাথে। খাকি পোশাক পড়া, কাঁধে ভারী অস্ত্র শস্ত্র, মাথায় লোহার হেলমেট, তাকে লক্ষ্য করে বলে উঠলো --
" ইধার আউ, ইধার আউ। "
কাঙাল কোনকিছু না বুঝলেও একথা বুঝে গেছিলো যে, এই আদেশ অমান্য করার কোন উপায় নাই ।
কাঙাল দেখলেন তার মত অনেককেই এনে পুকুর পাড়ে বসিয়ে দেওয়া হল।
কাঙাল আরো দেখলেন যে, তার বৃদ্ধ পিতা গগন মন্ডল সম্ভবত তার খোঁজ নিতেই এগিয়ে এসেছিলেন ; তাকেও বন্দুকের নলের গুঁতা দিয়ে মানুষের লাইনে বসিয়ে দেওয়া হল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুকুরের অপর পাড়ে মেশিনগানের ঠা ঠা ঠা গুলি এবং ধোঁয়া উঠতে দেখা গেল!
পরমুহুর্তেই তাদের দিকেও মেশিনগান তাক করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেল।
কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই নরক গুলজার শুরু হয়ে গেল।
তারপর কিছু মনে পড়ে না।
তবে এটুকু মনে আছে তার পিতা গগন মন্ডলের একটানা অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ আর থেকে থেকে আর্তনাদ " পানি দ্যাও, গলা শুকাইয়্যা গ্যালো, পানি দ্যাও, পানি দ্যাও" ... তারপর সব শ্যাষ! ।

মুহুর্তের মধ্যে বিনামেঘে বজ্রপাতের মত শ' দেড়েক লোককে পাখির মত গুলি করে মেরে ফেলে দিয়ে, গান পাউডার দিয়ে বাড়ি ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে, বীরদর্পে পাকিস্তানি মিলিটারি চলে গিয়েছিল।
বহুলোক কবরস্থানের জঙ্গলে ঢুকে লুকিয়েছিল, কেউ কেউ ডোবার পানিতে সারা গা ডুবিয়ে আত্মগোপন করে বেঁচে গিয়েছিল।

তা আপনি বেঁচে গেলেন কেমন করে?
" লাইন কইর‍্যা যা'গরে গুলি কইর‍্যা মাইর‍্যা ফালাইল্যো, সেই দলের মদ্যেই আমি আচিল্যাম, আমার বাপজান আমার পাশেই আচিল্যো। আমার শরীলে চার খান গুলি লাগচিলো, সব মড়া মাইনষের মদ্যে মইর‍্যা পইড়্যা আচিল্যাম।
দুপুরবেলে গাঁয়ের মানুষ লাশগুল্যান টাইন্যা সরাইতে আমাক খুঁইজ্যা পায়, আমি তহুনো বাঁইচ্যা আচিল্যাম।
আমাক বাইরের ঘরে শোয়াইয়্যা থুচিলো। "
' কোন হাসপাতালে নেয় নাই? '
" নাঃ, হাসপাতাল, ডাক্তার ক'নে পাইব্যো? সব বন্দ, সব বন্দ আচিলো। "
' তাহলে, কিভাবে বেঁচে উঠলেন ? '
" আল্লায় বাঁচাইচে। শরীলে পঁচন ধইর‍্যা দুর্গন্ধ ছড়াইচিল্যো। মাস খানেকের মাথায় সাইর‍্যা উটিচি।।

__ ডাঃ সুকুমার সুর রায়।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়