SAHA ANTAR

Published:
2021-03-18 15:53:56 BdST

রাজিক হাসান লন্ডন থেকে -------------------------- ১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবার ও জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায় প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয় যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে। বাংলাদেশে আইন করে বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় শান্তিতে নোবেল পুরবঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড, বিচার ও নানা দিক


রাজিক হাসান 

লন্ডন থেকে 

--------------------------

১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবার ও জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায় প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয় যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে। বাংলাদেশে আইন করে বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী শন ম্যাকব্রাইড সহ চার ব্রিটিশ আইনবিদ মিলে এ কমিশন গঠিত হয়। তবে অনুসন্ধানের কাজে এ কমিশনকে বাংলাদেশে ভিসা দেয়নি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার।

এ কমিশনকে দেশে আসতে না দেওয়ার মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িতদের প্রতি সামরিক সরকারের সরাসরি সমর্থন ছিল। সরকার এর তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত করেছিল। এই ঘৃণ্য ঘটনার কুশীলবদের পক্ষ নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি এড়াবার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশে “ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ” আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন। যার ফলে ইতিহাসের নৃশংস একটি হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রোহিত হয়ে যায়।

জেনারেল জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকারের দুই দশকের অধিক সময় ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে দেওয়া হয়নি এই স্বাধীন বাংলাদেশে। শুধু তা-ই নয়,খুনি চক্রকে দেশ বিদেশে বড় পদ ও চাকুরী দিয়ে রক্ষা করেছে জিয়া, এরশাদ ও খালেদা সরকার।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি আদালতে বিচার শুরু হয়।

১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।

২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে।

২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।

বঙ্গবন্ধু তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। "আমার জীবনে বড় ভুল; মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বানাতে গিয়েছিলাম পাকিস্তানের প্রশাসন দিয়ে!" কথাটির জলজ্যান্ত সত্যতা প্রমাণ করে ১৫ অগাস্ট অভ্যুত্থান ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা। দুটো ঘটনাই ছিলো হত্যাকারীদের দিক থেকে সফল অভিযান। তারপর থেকেই শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণ প্রক্রিয়া, সূচনা হয় এক কালো অধ্যায়ের। শুরু হয় এক অন্ধকার যুগের। এর পর থেকেই শুরু হয়, একের পর এক মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার নিধন।

৭১ এর গণহত্যা, ৭৫ এর মুজিব হত্যা এবং ৪ নেতার জেলহত্যা; এর কোন অপরাধই সাধারণ ফৌজদারি অপরাধ নয়; এগুলো সবই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। রাজনৈতিক বিচারে মরণোত্তর পুরস্কার দেয়া যায় যেমন; তেমনি মরণোত্তর বিচার করাও সম্ভব। কিন্তু আমাদের সাধারণ ফৌজদারি অপরাধে তা সম্ভব নয়। যে কারণে মুজিব হত্যার বিচারে মূল ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মুশ্তাক, মাহবুব আলম চাষী এদের উল্লেখ নাই, তেমনি জেলহত্যা মামলায় রিসালদার মুস্লেউদ্দিনের সাজা হয়। অর্থাৎ এসব খণ্ডিত বিচার। খণ্ডিত বিচার সব সময় সত্যিকার ঘটনাকে আড়াল করে দেয়।

বিচারগুলো পূর্ণাঙ্গ করতে হলে এগুলোর রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বিষয়গুলো উঠে আসতে হবে। যে নুরেমবার্গ ট্রায়াল থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে মানবতাবিরধী বিচারটা হচ্ছে; সেটাও কোন সাধারণ ফৌজদারি ট্রাইবুনাল ছিলো না, এটার জন্য নতুন আইন, নতুন রূপরেখা তৈরি করতে হয়েছিলো। যেকোন ধরনের ভুল বোঝাবুঝি ও প্রতিকূল পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য এটা করতে হয়েছে। আসলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিচারে বেশি সাক্ষী সাবুদের দরকার পড়ে না। তৎকালীন কাগজপত্র ও বিভিন্ন ডকুমেন্টই সাক্ষী হিসাবে কাজ করে। জেল হত্যার মতো বিচারকে সাধারণ ফৌজদারী আইনের বাইরে নিয়ে বিচার করতে হলে দরকার হবে আলাদা আইনের, গঠন করতে হবে আলাদা ট্রাইবুনাল।

আওয়ামী লীগ একটা গণদল (mass party)। এই দলের দক্ষিণপন্থী অংশ ৭১এ স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না, তাদের অনেকেই মুজিব হত্যা, ৪ জাতীয় নেতা হত্যার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। এরাই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যাবহার চালু রেখেছে। এই দলের দীর্ঘদিনের সহচর জেনারেল এরশাদ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে একযোগে কাজ করেছিলেন। জেঃ এরশাদ '৮৬ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনি কর্নেল ফারুককে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ তার সকল রাজনৈতিক মতাদর্শ ও তার ফ্রিডম পার্টিকে বৈধতা দিয়েছিল।

নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মাধ্যমে সমস্ত নাজী ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং একটা পরিপূর্ণ বিনাজীকরন (denazification) প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল। বিচারে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া বিচার হয়ে যায় খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ।

আজ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকীতে শুধু একটি কথা স্পষ্ট করে বলেই লেখাটি শেষ করতে চাই, আজকের এই নষ্ট রাজনীতির বীজ- থেকেই যাবে ভবিষ্যতে পরিস্ফুটনের অপেক্ষায়।

 

সম্পাদনা অন্তর সাহা 

সহযোগী সম্পাদক 

কলকাতা অফিস 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়