SAHA ANTAR

Published:
2021-03-06 07:08:28 BdST

শিল্পী : এক মর্মস্পর্শী কাহিনি


দেবব্রত তরফদার 

------------------------------



শিল্পী :

নয়ন পালের সাতপুরুষের বাস নদীয়া জেলার চাপড়া থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে । তারা কুমোর পাল । তার ঠাকুরদা হরেন পালের তৈরি মাটির পাত্র ছিল এ দিগরে সেরা । কথিত আছে তার তৈরি মাটির হাঁড়ি কলসি পড়ে গিয়ে ভাঙতো না । তা সোমবচ্ছর পৌনে আগুন আর নাম থাকলেও হরেন পালের ভাতের টান ছিল । একগাদা পুষ্যি নিয়ে সংসারকে ঠিক কব্জা করতে পারতো না । বড় ছেলে নগেনের হাতের কাজ ছিল বাপের চেয়েও ভালো কিন্তু একটু বড় হয়ে সে আর হাঁড়ি কলসির দিকে ভেড়েনি । মাটিকে ছাড়ল না কিন্তু কুমোরের চাক ছাড়লো । লক্ষীপুর থেকে তিন গাঁ পেরিয়ে পলদা নদী, তার দুই গ্রাম পেরিয়ে মহেশপুর সেখানেই কয়েক ঘর কুমোর আছে যারা একমাত্র এই অঞ্চলে প্রতিমা বানায় । এদের অবস্থা কিছুটা স্বচ্ছল কেননা দু এক বিঘে জমিজিরেত আছে । সারাবছরই মাটির কাজ আর পুজোপার্বনে প্রতিমা গড়ানো। তাও খুব বেশী নয় । দশ গাঁয়ে বারো তেরটা ঠাকুর । তা পনেরো বছরের নগেন গিয়ে জুটলো বিশে পালের সঙ্গে , তার পেটেলগিরি করতে। বিশে পালের বয়স প্রায় আশি , সবাই তাকে খুড়ো বলেই মান্যি করে । চোখে খুব ভালো একটা ঠাওর হয়না কিন্তু কিছুটা আন্দাজেই যা গড়ে তোলে তার তুলনা মেলা ভার ,অসুবিধে হয় চক্ষুদানের সময় তা সে কাজটা বুড়োর ছেলে নারান পালই করে থাকে । তা নগেন তিনটি বছর ধরে বিশের পেটেলগিরি করে আঠারোতেই ওস্তাদ হয়ে উঠলো । তার হাত আর তুলি সমানে চলে । আর পর বছরেই কালীগঞ্জের এক পালের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার সঙ্গে চলে গেলো মধ্যপ্রদেশ , পুজোর তিনমাস আগে । পেট ভাতায় কাজ করবে আর কাজের শেষে লাভের একটি সামান্য অংশ । তা পুজোর পর ছোঁড়াটা নতুন জামাকাপড় আনে সবার জন্য আর মার হাতে তুলে দেয় কড়কড়ে দু হাজার টাকা । আর বিকেলেই নতুন কাপড় নিয়ে দেখা করতে চলে যায় মহেশপুর তার বুড়ো ওস্তাদের কাছে।
তাদের ছেলে লায়েক হয়েছে তাই পালবউ হরেনের কাছে এই বছরেই ছেলের বিয়ে দেবার জন্য বায়না করে । হরেনের একটু আপত্তি ছিল । মেজ ছেলেটি খাটার উপযুক্ত হোক , নাহলে এই বয়সেই সংসারের চাপ ওর একার মাথায় পড়ে যাবে। কিন্তু গিন্নি নাছোড়বান্দা । অগত্যা মেয়ের সূলুক সন্ধান চলতে থাকে । কালীপূজো পেরিয়ে গেলো নগেন জগদ্ধাত্রী পুজোর কাজ করতে চলে গেলো কেষ্টনগরের ঘূর্ণিতে বিখ্যাত বীরেন পালের কাছে । আর এই সময়েই নগেনের বিয়ের প্রস্তাব আসে মহেশপুর খোদ ওস্তাদের বাড়ি থেকে । পাত্রী বিশে পালের নাতনি , নারান পালের মেয়ে কমলা । হরেন বউ এর কাছে কিছু ভাঙেনি, রাতে সবাই খেয়ে শুয়ে পড়লে হরেন দাওয়ায় বসে মৌজ করে একটা বিড়ি ধরিয়ে বউকে ডাকে।
-- নগেনের মা , ইধার পানে আয় ।
কি বুইলচ ?
বড়খুকার বিয়ির সম্মন্ধ এইচে মোষ পুর থেকি।
মোষপুরির কুন বাড়ি ?
যে বাড়িতি খুকা কাজ শিকতো।।
ওমা আমার কি হবে পেম ভালোবাসা হয়েল নাকি ? পালবউ কাঁদতে বসে রাত দুপুরে ।
চুপ কর মাগী , কাল আমি দেখে আসি ।এই বলে হরেন মুচকি হাসে ।
পরদিন একা একাই মেয়ে দেখে এসে হরেন বেজায় খুশি -- মেয়ে তো নয় বউ সাক্ষাৎ মা সরস্বতী , গাঁটরা ইস্কুলে কিলাস টেনে পড়ে , আমাদের ছেলি তো কিলাস ফোর।
ক্যানে আমার ছেলি ফ্যালনা , অমন চিহারা ধীর স্থির কাজের ছেলি কডা আচে এ দিগরে। মা ফোঁস করে ওঠে।
অতঃপর পরের মাঘ মাসের পর থেকেই এবাড়ির উঠোনে আলতা পরা নতুন পায়ের ছাপ পড়ে। আর বউটিও তেমনি এরই মধ্যে একপাল কচিকাঁচা ননদ দেওরের ঝক্কি সামলাচ্ছে একা। পাল বউ আর পালের কাছে ছেলের বউ তাদের পেটের মেয়ের বাড়া ।
এ সব চল্লিশ বছর আগেকার ঘটনা । এর মধ্যে কতকিছুর পরিবর্তন । নগেন দু তিন বছর মধ্যপ্রদেশে কাজ করার পর আর বাইরে যায়নি । তার নিজের ভাইয়েরা ছাড়া কাকার ছেলেদের প্রতিমার কাজ শেখায় । কারখানা বানায় নিজের গ্রামে । তার কাজের সুনাম দূর দুরান্তে ছড়িয়ে পড়ে । অবশেষে সে কুমারটুলিতে কাজ করতে যায় , সেখানে একফালি জায়গাও নেয় এবং পরিবারের লোকজন নিয়ে কাজ করতে শুরু করে । এই সময়ে হরেন পাল মারা গেছে , পালবউ গেছেন কয়েক বছর আগে । কমলা ই সংসারের কর্ত্রী । দেওররা আলাদা থাকলেও পাশাপাশি থাকে এবং সম্পর্ক ভাল। নগেন কমলার তিনটি ছেলে , মেয়ে নেই । তাদের মেয়ের শখ পূরণ হয়নি । ছেলেদের শেষ দুজন তেমন লেখাপড়া শেখেনি প্রথম থেকেই বাবার সঙ্গে ।
বিয়ের পরের বছরই কমলার প্রথম সন্তান হয় তার বয়স তখন মাত্র সতেরো । হরেন ছেলের বউ কে বাপের বাড়ি না পাঠিয়ে কেষ্টনগরে ভালো ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু সেই সময়ে যমে মানুষে টানাটানি । হরেন আর পালবউ সারারাত মাতৃসদন হাসপাতালের গাছতলায় বসেথেকেছে। পালবউ যত দেবতার নাম জানে তাদের ডেকেছে আর কেঁদেছে । শেষে ভোরবেলায় মা ছেলে আলাদা হলো। নগেন তখন কাজ করতে গেছিল মধ্যপ্রদেশ । দু মাস পরে মহেশপুরে গিয়ে ছেলেকে দেখে , কমলা স্বামীকে দেখে কেঁদেকেটে একসা , কান্না তার থামেই না । আর নয়ন হয়ে ওঠে সবার নয়নের মনি । কাকা পিসিরা তাকে কোল থেকে নামায় না । ছেলের বাবা মা দুজনেই সুন্দর তাই ছেলে হয়েছে রাজপুত্তুরের বাড়া । হরেন খুব ধুমধাম করে নাতির অন্নপ্রাশন দেয় । নয়ন বড়ো হতে থাকে অসম্ভব শান্ত ছেলে , মাটি নড়ে তো ছেলে নড়ে না। প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয় । এর পর পিঠাপিঠি তার দুই ভাই হয় সুবল আর বলরাম । তারা দুজনেই ডাং তাদের অত্যাচারে বাড়ির সবাই অস্থির , ভাঙছে ফেলছে , কারখানায় গিয়ে কাদা মাখছে । পরে তারাও স্কুলে যেতে শুরু করে । মা বাবা দু তরফের সবাই শিল্পী কাজেই বড় হতে হতেই তারাও মাটি ধরতে শিখে গেল । হরেন এখন হাঁড়ি কলসির কাজ বাদ দিয়ে ছেলে দের সাহায্য করে। নগেনের ছোটদুটোর লেখাপড়ায় মন নেই । কমলা তাদের বকাঝকা করে আর বলে -- বাপের মতই তোদের মাটি মেখে খেতে হবে।
আর দাদা ? সুবলের প্রশ্ন ।
দাদা কলেজ পড়বে , চাকরি করবে ।
আর আমি আর ভাই বাবার সঙ্গে ঠাকুর গড়তে যাবো দূর দেশে।
তাই যাস ।
তুমি কাঁদবে না ? অবোধ বালকের প্রশ্ন ।
হঠাৎই কমলার চোখে জল আসে । বিয়ের পর নগেন মাসের পর মাস বাড়ি থাকতো না সেকথা মনে পড়ে । দুস্টু ছেলেটাকে কোলের মধ্যে টেনে একটু আদর করে বলে -- যা পালা , অনেক কাজ পড়ে আছে ।
দিন যায় , বাচ্চারা বড়ো হয় । হরেন পাল ক্রমশ অশক্ত হয়ে পড়ে । একদিন বাচ্চারা মৃত্যুর পদধ্বনি শোনে ঘরের আঙ্গিনায় , দাদু কেন আর ফিরে আসবে না এটাই বুঝতে পারেনা একদম ছোটটা । নয়ন ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করে , তার মতো সুবোধ ছেলে বিরল । কিন্তু দুস্টু ভাইদের সামলাতেও পারে না । একটু অদ্ভুত প্রকৃতির সে । কাঁচা মূর্তি গড়তে গড়তে চুপ করে যায় , তন্ময় হয়ে কি দেখে কে জানে । কমলা অনেক সময় দেখে কারখানা ঘরে কার সঙ্গে কথা বলছে নিচুস্বরে । গিয়ে দেখে কেউ নেই । জিজ্ঞেস করতেই ছেলে লজ্জা পেয়ে হাসে । কমলার ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে । এমনিতেই ছেলেটা সবার চেয়ে আলাদা , কি হবে কে জানে । শাশুড়ির সঙ্গে একান্তে আলোচনা করে । আর পালবউ পরদিন ছোটে ময়দানপুর কালিবাড়িতে , কখনো মসজিদের মওলানা সাহেবের কাছ থেকে জলপড়া নিয়ে আসে । নয়নের একমাথা অগোছালো রুক্ষ চুল , ফর্সা ছিপছিপে চেহারা দেখে মনে হয় গ্রিক দেবতাদের মধ্যে থেকে উঠে আসলো । কাদামাটির থেকে রঙ তুলির সঙ্গে তার সখ্যতা বেশি । তুলি হাতে নিলে বাহ্যজ্ঞান থাকে না । তার হাত যেন কথা বলে । আর ষোল বছরের ছেলেকে দেখে নগেনেরও বুক কাঁপে -- মনে মনে বলে এ কে , আমরা শালা কারিগর আর এতো সাধক । নগেনের বেশির ভাগ প্রতিমার চোখ দেয় এখন নয়ন।
প্রতিমা তৈরি করতে গিয়ে গড়ার থেকে ভাঙে বেশি । কিছুতেই মনের মত হয়না । নগেন কাজ করে তার নিজের ছাঁচে তাছাড়া তার দাদাশশুর বিশে পালের ছাঁচ ও তার আছে । নয়নের কিছুতেই পছন্দ হয় না , সে নিজেই ছাঁচ বানিয়ে ফেলেছে প্রতিমার মুখের । তা দেখে অভিজ্ঞ কারিগর নগেন ভাবে তার ছেলের কাজ বহুদূরে ছড়িয়ে পড়বে । সুবল পড়া ছেড়েছে ক্লাস সেভেনে , বাবার পেটেলগিরি করে কখনো সখনো । দাদার কান্ড দেখে বলে -- তুমার হাতে পড়লি এক বছরেও একটা ঠাকুর শেষ হবে না ।
ভাইয়ের কথা শুনে নয়ন হাসে , সে কোন কিছুতেই রাগে না । কিন্তু দাদার তুলি চালানোর ব্যাপারে তার গভীর আস্থা । ছোটটা আবার মাকে বলে -- দাদার আকাঁ চোখ তোমার মত জ্যান্ত ।
কমলা বলে-- দূর বোকা ওতো ঠাকুরের চোখ। ছোট্ট বলরাম মাকে ঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনা , নিজের মতো করে বলে -- দাদার আঁকা মুখ দেখলি বুকের মদ্যি ব্যাথা করে ।
কমলার ভয়ে বুক কাঁপে কেন ?
নয়ন যেবার পাশ করে কলেজ ভর্তি হলো সেবারই নগেন কলকাতার কুমোরতুলিতে ঘর নিলো । আর সুবল চলল বাবা কাকার সঙ্গে । এতটুকু ছেলে , বুক মুচড়ালেও ছেড়ে দেয় কমলা । পালের ছেলে একদিন ছাড়তে হবে।
কলেজ ভর্তি হয়ে মন বসেনা নয়নের , শহরের ছেলেদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনা , আবার অনেক মেয়েও পড়ে যাদের সামনে সে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে । সে প্রায়ই কলেজ কামাই করে আর ঘুরে বেড়ায় কৃষ্ণনগরের পালপাড়া আর ঘূর্ণিতে । এখানকার মাটির পুতুল জগৎ বিখ্যাত । বীরেন পাল , কার্তিক পাল , সুবল পাল , শম্ভু পাল , মহেশ পাল এইসব শিল্পীদের কাজের সঙ্গে পরিচয় হয় এঁরা সবাই রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন । তন্ময় হয়ে তাদের কাজ দেখে । অনেকেই এই ছেলেটিকে চিনে গেছে , জেনেও গেছে সে কি করে । বীরেন পাল মহাশয় অনেক কিছু বলেছেন , কিন্তু তার কোনো জিজ্ঞাস্য নেই , চোখে কৌতূহলও ধরা পড়ে না । শুধু তন্ময়তা , কখনো কখনো ক্লান্তি । কি চায় সে ? নিজেই জানে না । অবাস্তব ধারণা তার মধ্যে কাজ করে । ঠাকুরের মুখ চোখ নাক আঁকতে আঁকতে তাদের জীবন্ত দেখে । একা থাকলে কখনো কথাও বলে । কমলা ছেলেবেলা থেকেই লক্ষ্য করেছে । সব পুজো শেষ হয় । নগেন বাড়ি ফিরে এসেছে । আবার সরস্বতী পুজোর কাজ কিছুদিন পর থেকে। কৃষ্ণনগরের পালপাড়ার কারখানাগুলো ফাঁকা। অনেকদিন কলেজ যাওয়া হয়নি । আর একদিন বাড়ি এসে ঘোষনা করে পড়বে না। কমলা আশাভঙ্গে একদম ভেঙে পড়ে। নগেন সামাল দেয় -- ঠিক আছে , কাজকর্ম করুক। সরস্বতী পুজোর কাজে বাবার সঙ্গে যায় কুমোরটুলি । সারা সিজেনে দু তিনটি ঠাকুর করেছে , নগেন হাতও দেয়নি । তবে রঙের কাজে সে দশজনের সমান। যে তিনটি ঠাকুর সে বানিয়েছে , চোখ ফেরানো যায় না । অন্য বয়স্ক পালেদের চোখে ছিল মুগ্ধতা , বাহবা দিয়েছে খুব । যারা প্রতিমা বায়না দিয়েছিল তারা সবাই খুব খুশি । প্রতিমাগুলি চলে যাবার পর নয়ন একেবারেই মনমরা । সেদিন রাতে খায় নি । পরে কিছু ছোটখাট কাজ বাকি ছিল সেগুলোতে হাত লাগায়নি । পর পর কয়েক রাত জাগা , ভালো কাজ করার পর মন্ডপে প্রতিমা চলে গেলে খারাপ লাগে ঠিকই । কিন্তু শিল্পী হলেও সে পালের ছেলে , প্রতিমা গড়ানোয় তাদের রুটি রুজি , এমন করলে তাদের চলে । ছেলের ব্যবহার অতিরঞ্জিত মনে হয় । আর রাগের মাথায় জীবনে যা করেনি তাই করে বসে । নয়নকে একটি চড় মারে । ঘটনায় সবাই হতবাক । সুবল ছুটে এসে , দুজনের মাঝে দাঁড়ায় -- দাদার গায়ে হাত দেবে না বাবা। পনেরো বছরের ছেলের আচরণে বাবা অবাক । যাইহোক নয়নই ভাইকে নিয়ে সরে যায় । তারপর দুজনে কাজে লেগে যায় ।
ছেলের গায়ে হাত তুলেই আফসোস হয় নগেনের , এমন ছেলে তার । কমলা জানতে পারলে তার কপালে দুঃখ আছে । আর সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছে সুবলের ব্যবহারে । অসম্ভব ডানপিটে হলেও তিন বছরের বড় দাদাকে কখনই তুই সম্বোধন করেনি আর আজ আচরণে বুঝলো নয়ন সুবলের শুধু দাদাই নয় গুরুও বটে । আশ্বস্ত হয় নগেন তার অবর্তমানে তার ভোলেভালা ছেলেটির পাশে দাঁড়ানোর মতো লোক রইল। ও পাশ থেকে নয়নের নিচুস্বর আর সুবলের হাসি ভেসে আসছে । ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাওয়াই নগেন খুশি। কিন্তু নয়নের ব্যাপারটা তার কাছে স্বাভাবিক লাগে না । আজ কয়েক বছর এখানে আসার পর অনেক ভালো শিক্ষিত লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ঠাকুর গড়ার সুবাদে সেরকম একজন হলেন অধ্যাপক সুবীর মুখার্জি বাবু । তাঁকে নগেন নয়নের সব ব্যাপার খুলে বলে। অধ্যাপক জানান তাঁর একজন বন্ধু আছেন এই ব্যাপারে বড় ডাক্তার । তাঁর কাছে নয়নকে পরদিন নিয়ে যাওয়া হয় । তিনি নয়নের সঙ্গে দু ঘন্টা কথা বলে অধ্যাপককে জানান নয়ন একদম স্বাভাবিক , এবং অনেক বড় শিল্পী মধ্যে এই ব্যাপারটি দেখা যায় যারা নিজের সৃষ্টির মধ্যে জীবন্ত সত্তা খোঁজে । বাড়ি ফিরে নগেন কমলার সঙ্গে এসব কথা আলোচনা করে । এরপরই কমলা আর তার শাশুড়ি নয়নের বিয়ে দেবার জন্য ক্ষেপে যায় । নগেন ভাবছিল আরো দু এক বছর যাক সংসারটা আর একটু গুছিয়ে নেওয়া যাবে । কিন্তু সবার চাপে মত দিতে হয় । পিসিরাও মেয়ে খুঁজতে শুরু করে । কমলার মত হলো সুন্দরী মেয়ে ছাড়া তার সুন্দর ছেলের বিয়ে দেবে না । পাত্রী পাওয়া যায় কাছেই বড় আন্দুলিয়ায় । এক প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের মেয়ে । বর্ধিষ্ণু পরিবার , চাষবাস ব্যবসা আছে , কিন্তু সাতপুরুষের মাটির কারবার নেই । তারা ছেলে দেখে আর ছেলের সম্পর্কে খবর নিয়ে খুশি। অতঃপর পরের ফাল্গুনে কমলার ঘরে নতুন লক্ষী আসে । তার গুন আর রূপের ছটায় পালবাড়ি আলোকিত হয় । ধনী বাপের মেয়ে কল্যাণী মাটির ঘরে মানিয়ে নেয় খুব তাড়াতাড়ি । নগেন তার ছেলেদের নিয়ে কখনো বাইরে কাজ করতে যায় । সুবল বলরাম রাজ্যের বাইরে যায় কিন্তু নয়ন তার খুশিমত কাজ করে । কখনো দেখা যায় সারা দিনরাত জেগে কাজ করছে আবার কখনো দেখা যায় অসমাপ্ত মূর্তির সামনে চুপচাপ বসে আছে । কখনই বেশি প্রতিমার বায়না নেয় না । সংসারে কখনও টানাটানিও চলে । কল্যানীর কাজ হল সময় পেলেই স্বামীর কাজ দেখা । অনেক সময় স্বামীর সঙ্গে সারারাত জাগে কিশোরী মেয়েটি । সুপুরুষ আত্মভোলা মানুষটিকে পাগলের মত ভালোবাসতে শুরু করেছে । দু বছর পর কমলা সুবলের বিয়ে দিয়ে দেয় আর সেই বছরেই কল্যানীর কোল জুড়ে ঘর আলো করে আসে আঁখি । কাকাদের নয়নের মনি । নতুন কাকী কোল থেকে তাকে নামাতেই চায়না । সুখের সংসারে কালের অমোঘ নিয়মে একদিন চলে যায় পালবউ ।
আঁখি বড় হতে থাকে , এরমধ্যে তার ছোট্ট সঙ্গী পেয়েছে , নতুন কাকীর ছেলে হল । সে খিচুড়ি স্কুলে যেতে শুরু করে । নয়নের নাম জেলার শিল্পী সমাজে ছড়িয়ে গেছে বিশেষ করে তার তুলির গুন। অল্প কয়েকটি প্রতিমা সে করে কিন্তু প্রতিমার চক্ষুদানের জন্য বিভিন্ন পালেদের কাছ থেকে বরাত আসে । এমনকি যে সব পালের শিল্পী হিসেবে নাম আছে তাদের কাছ থেকেও । শুধুমাত্র তার আঁকা চোখের জন্য প্রতিমা অন্য মাত্রা পায় । এতে কম পরিশ্রমে আয় বেশি করা যায় । কিন্তু নয়ন অন্য জাতের শিল্পী তাকে পয়সা দিয়ে কেনা যায়না । সে সারাদিনে দু তক্তা প্রতিমার চোখ দেয় । কাজটা পরিশ্রমের কারন সমস্ত সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
এবার পুজো এসে গেল , নগেন তুতো ভাইদের নিয়ে কুমোরতুলিতে । সুবল বলরাম গাড়ি ভর্তি জিনিসপত্র আর লোকজন নিয়ে মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে। এই সময় সংসারে টাকার টানাটানি হয় খুব। মহালয়ার দিন থেকেই টাকা আসতে শুরু করে । এখনো প্রায় দুমাস । নয়ন তার ইচ্ছেমতো অল্প কয়েকটি বায়না নিয়েছে । শেষদিকে দু চার তক্তা চক্ষুদান করবে ।
একদিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফেরে আঁখি । দিদিমণি তাকে বকেছে সে পড়া বলতে পারেনি । কল্যাণী মেয়েকে কোলে টেনে নিয়ে বলে -- কেন মা তোমায় তো সব শিখিয়ে দিয়েছি ।
আমি বোর্ডের পড়া দেখতে পাচ্ছিলাম না।
বই বার করে পড়তে দেয় মেয়েকে , আর দেখা যায় মেয়ের পড়তে কষ্ট হচ্ছে । পরদিনই কৃষ্ণনগরে চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া হয় তিনি ভালো করে পরীক্ষা করে বলেন -- এ চোখের সমস্যা নয় , তারপর কলকাতায় এক ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেন । কল্যাণীর বাবাকে নিয়ে নয়ন পরদিনই কোলকাতা যায় । অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর শিশুটির ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে , তবে ম্যালিগ্যান্ট নয় এই বাঁচোয়া । বাপ মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে । ডাক্তাররা তাড়াতাড়ি অপারেশনের কথা বলে । সব মিলিয়ে তিন লাখ টাকার প্যাকেজ । কল্যাণী শিশুটিকে আঁকড়ে ধরে চোখের জল ফেলে । নয়ন নির্বাক বোবা চোখে তাকিয়ে থাকে । বাড়ি ফিরে কমলাকে কিছু জানানো হয়নি । কিন্তু সে বুঝতে পারে অঘটন কিছু ঘটেছে । পুজো কাছে, বাবা ভাই দের খবর দিলে তারা আসতেও পারবে না বরং কাজের ক্ষতি হবে ।
নয়ন অতি দ্রুততার সঙ্গে ক দিনের মধ্যে প্রতিমাগুলি শেষ করে দিনরাত জেগে। পিতৃত্ব তার শিল্পীসত্তার পথ ঘুরিয়ে দিয়েছে। এরপর বিভিন্ন পালেদের কাছে সে খবর পাঠায় প্রতিমার চক্ষুদানের বরাত নিয়ে । একদিন ভোরবেলা ঘুমন্ত মেয়েটিকে কোলে নেয় নয়ন । কল্যাণী এই প্রথম দেখে স্বামীর চোখে জল । সে নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। নিজে ভেঙে পড়তে পড়তে নয়নকে বলে -- চোখের জল ফেলবে না , মেয়ের অকল্যাণ হবে , তারপর বলে , তুমি যাও , কেউ নিতে পারবেনা আমাদের ধন কে। তার স্বরে কি শক্তি ছিল কে জানে , নয়ন ঘুমন্ত মেয়েকে একটা চুমো খেয়ে তুলির ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায় ।
টানা এগারো দিনে ষাট তক্তা প্রতিমার চক্ষুদান করে নয়ন । প্রায় চব্বিশ ঘন্টা কাজ করেছে প্রতিদিন । স্নান খাওয়া নেই , চোখদুটি অসম্ভব উজ্জ্বল , তাকানো যায় না । যখন সে চক্ষুদান করে তখন তাকে ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসী বলে মনে হয় । অতি সাধারন প্রতিমা তার তুলির টানে অসাধারন রূপ পায় । বেথুয়াডহরির পালপাড়াটি পুরাতন , বহুকাল ধরে কাজ করছে এমন একজন পাল তার কাজের পর হাত ধরে বলে -- বাবা শিল্পী হিসেবে আমারও নাম ছিল এককালে । আমার গর্বও ছিল কিন্তু বাবা তোমার কাজ না দেখলে আমার শিল্পী জীবন অপূর্ন থেকে যেতো ।
এসব কথা স্পর্শ করেনা নয়নকে । আগে চক্ষুদানের সময় প্রতিমার জীবন্ত সত্তা খুজত এখন প্রতিমার সঙ্গে তার ছোট্ট শিশু তার আঁখি মায়ের মুখ এক হয়ে যায় । এ কদিন সে যেন একটি মুখেই চক্ষুদান করেছে । অভিজ্ঞ লোকেরা তাকে দেখে ভাবে লোকটি বোধহয় মারা পড়বে কিন্তু তার সামনে কোন কথাই বলতে পারেনা।
প্রায় একলাখ টাকা কালেকশন হয়েছে । বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে একজনকে দিয়ে । এখনো অনেক কাজ বাকি । বেথুয়াডহরিতে শেষ চক্ষুদানের কাজটি যখন শেষ করে তখন রাত্রি দশটা । এরপর হরিনারায়নপুরে তিন পাটা কাজ আছে , সেখান থেকে বার্নিয়ায় দু পাটা কাজ করে বিকেলের মধ্যে তেহট্ট পৌঁছতে হবে । দুদিনের কাজ আছে প্রায় দশ বারো পাটা, তারপর আন্দুলিয়া হয়ে বাড়ি । সেখানেও তার নিজের তিনটি প্রতিমা অপেক্ষায় । কারো মানা না শুনে বেরিয়ে পড়ে , ক্ষ্যাপা মানুষটিকে বেশি কিছু বলতে পারে না । দুজন তার সঙ্গে যেতে চায় । নয়ন বারণ করে । দশ কিলোমিটার রাস্তা, দুদিন পর অমাবস্যা কিছুক্ষন পর যেন অন্ধকার পাতলা হয়ে আসে । পিছনে একটি কুকুর অনেকদূর পর্যন্ত আসে , প্রথমে ডাকছিল পরে চুপ করে যায় । নয়ন তার সঙ্গে কথা বলে । কুকুরটি লেজ নাড়ে গ্রামের সীমানায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে । দূরের গ্রামে বিজলি বাতির আলো , স্টেশনের আলোটা ও দেখা যায় । শরীর ভেরে আসছে , পাশেই বড় একটি গাছ ,।অন্ধকারে বোঝা যায় না , বোধহয় তেঁতুল হবে । তার নিচে বসে নয়ন । কতক্ষণ বসেছিল কে জানে , তার চটকা ভাঙে । হঠাৎই কান্নায় ভেঙে পড়ে , তার কান্নার শব্দে কোন নিশাচর পাখি গাছ থেকে উড়ে যায় । আর তখনই যেন অন্ধকারের মধ্যে ভেসে ওঠে চিন্ময়ী মাতৃমূর্তি । মায়ের যেন হাজারো চোখ , যা এ কদিনে সে এঁকেছে , হাতে ত্রিশূলের বদলে বরাভয় মুদ্রা । কত কিছু বলতে চেয়েছিল নয়ন কিন্তু কিছুই বলতে পারেনা । ভোরের পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে । নয়ন ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে যায় হরিনারায়নপুর গ্রামের দিকে। এখনো কতো কাজ বাকি ।।
( দু একটি চরিত্র কাল্পনিক , কিন্তু হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় )

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়