SAHA ANTAR

Published:
2021-03-04 18:33:53 BdST

বিচিত্রার রিপোর্ট নিয়ে রোজিনার প্রতিবাদ : সম্পাদক কবি শামসুর রাহমানের অনুপম জবাব


 


ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
-------------------------------------
আশির দশকে আমাদের বাসায় বিচিত্রা নামের ম্যাগাজিনটি আসতো। মোটামুটি নিয়মিতই আসতো। আব্বা স্টেশন বুক স্টল থেকে কিনে আনতেন। আম্মা পড়তো, আব্বাকেও পড়ে শুনাতো।

আমরা সিনেমার পৃষ্ঠাগুলো উলটে পাল্টে দেখতাম। ওটাই ছিল মূল আকর্ষণ। মাঝে মাঝে শাহ মোয়াজ্জেম কি বলেছেন? হাসিনা, খালেদাকে গ্রেফতার করা হলো কিনা এসব দেখতাম ।
একবার দেখেছিলাম একটা ছবি। কোন এক অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমান নায়িকা রোজিনার সাথে খুব আন্তরিক, হাস্যোজ্জ্বল ভংগিমায় কথা বলছেন৷ আরেকটি ছবিতে তাঁরা পাশাপাশি বসা।

এই ছবির পেছনের একটা গল্প ছিল। তার আগে সামনের গল্পটা বলি। এই ছবি প্রকাশের পর হুমায়ুন আজাদ বললেন " কবি শামসুর রাহমান নায়িকার পাশে ছবি তুলেন। তিনি জানেননা কার পাশে বসতে হয় আর কাকে বিছানায় নিতে হয়"।

হুমায়ুন আজাদ অভিনেত্রী বা নায়িকাদের খুব ঘৃণার চোখে দেখতেন৷ তার এই দৃষ্টিভংগিকে সেই কিশোর বয়সেও আমি মানতে পারিনি। আজো পারিনা। উনার এই মন্তব্যটিকে আমি কোনদিন ক্ষমা করিনি। অন্য অনেক কারণে হুমায়ুন আজাদকে আমি সম্মান করলেও এই মন্তব্য ও দৃষ্টিভংগির জন্য আমি তাঁর নিন্দা করি।

হুমায়ুন আজাদ প্রসংগটি থাক। রোজিনার সাথে শামসুর রাহমানের ছবির পেছনের গল্প প্রসংগে আসি। ছবিটি তুলবার কিছু দিন আগে শামসুর রাহমান সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকায় একবার একটি স্টোরি ছাপা হয়েছিলো "রোজিনার স্বামী বৃত্তান্ত" শিরোনামে। নায়িকাদের নিয়ে চিরাচরিত গসিপ টাইপ স্টোরি আরকি। রোজিনা তার প্রতিবাদ করেছিলেন। শামসুর রাহমান রোজিনার সেই প্রতিবাদ পাঠ করে লজ্জিত হয়েছিলেন। সেটা তিনি স্বীকার করেছিলেন রোজিনার সাথে দেখা হওয়া মাত্র। তারপরই সৌহার্দ্যের স্মারক সেই ছবিটি তুলেছিলেন। ছবিটি বিচিত্র ছাড়াও কয়েকটি দৈনিকেও ছাপা হয়েছিলো যদ্দুর মনে পড়ে৷

প্রতিবাদের ভাষা কতটা অনুপম ছিলো সেটা এখানে কপি পেস্ট করে দিচ্ছি। অনেকবছর পর সেই স্মৃতি গুলো মনে করে নস্টালজিক হয়ে পড়ছি। রোজিনা সেই শৈশব থেকেই আমার পছন্দের শীর্ষে ছিলেন। কি কারণে জানিনা সেই বালক বয়সেই তাঁকে আমার ছোট খালাদের মত আপন মনে হতো। বড় হবার পর কিছুদিন আগে ইউটিউবে আমি তাঁর কিছু ইন্টারভিউ শুনেছি৷ আমি বিস্মিত হয়েছি এত পরিশীলিত,নিবেদিত আর উঁচু ব্যক্তিত্বের অভিনেত্রীরা আমাদের চলচ্চিত্রে শিল্পকে একদা সমৃদ্ধ করেছিলেন। একজন আপাদমস্তক শিল্পী ছিলেন রোজিনা। বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা এসে সিনেমার নায়িকা হয়েছিলেন আমাদের রোজিনা৷ তার সেই ত্যাগ, ডিটারমিনেশনের কথা ভাবলে আমাদের এক স্বর্ণযুগের স্মৃতিই ভেসে ওঠে। চলচ্চিত্র তাঁদের কাছে ছিলো আরাধনার জায়গা।

আমি এখানে সাহিত্যিক আনিসুল হকের লেখনি থেকে নায়িকা রোজিনার সেই প্রতিবাদ লিপিটা পেস্ট করলাম।

###

চিত্রনায়িকা রোজিনা তখন বাংলাদেশের এক নম্বর চলচ্চিত্র অভিনেত্রী । বিচিত্রা লিখল, রোজিনার গোটা তিনেক স্বামী ছিল, একজন ছিলেন রাস্তার ধারের সন্ন্যাসী টাইপ ফকির। তাঁর ছবিও ছাপা হলো। কাবিননামা ইত্যাদি।

রোজিনা সেই প্রচ্ছদকাহিনির একটা অপূর্ব প্রতিবাদ করেছিলেন। আমি স্মৃতি থেকে বলছি।

রোজিনা লিখলেন:
প্রিয় কবি শামসুর রাহমান,
আপনি বাংলাদেশের প্রধান কবি। আপনি দৈনিক বাংলা এবং বিচিত্রার সম্পাদক। আপনি জাতির বিবেক। আপনার জ্ঞান, বিদ্যা, বিবেচনা, সহৃদয়তার ওপরে নির্ভর করে আছে পুরো দেশ। আমিও।

আমি একজন খেটে খাওয়া মানুষ। আমি একজন শ্রমজীবী নারী। আমি রোজ কাক-ভোরে বিছানা ছাড়ি। স্নান করে মেকাপ করতে বসি। সকাল নটার মধ্যে আমি সেটে গিয়ে উপস্থিত হই। দুই শিফটে শুটিং করি। হাজার হাজার পাওয়ারের আলোয় আমার চামড়া ঝলসে যায়, চোখ পুড়ে আসে। গনগনে সূর্য আর সোলার পাঞ্জার প্রচণ্ড তাপের মধ্যে গরমে আমি কাজ করি। শীতের রাতে যখন সবাই কাঁপে, আমাকে হয়তো পুকুরের জলে নেমে শুটিং করতে হয়। রাত ১২টায় শুটিং শেষ হলে আমি বাড়ি ফিরি। মেকাপ তুলি। সবকিছু সেরে ঘুমুতে যাই যখন, তখন সমস্ত চরাচর ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ আমি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন সেবক। নিজে নিজে সংগ্রাম করে সাধনা করে পরিশ্রম করে গ্রাম থেকে এই পর্যন্ত উঠে এসেছি।

আপনি বাংলাদেশের প্রধান কবি, আপনি আমার সাধনার কথা বলতে পারেন। আপনি আমার শ্রমের কথা বলতে পারেন। আপনি আমাদের চলচ্চিত্রের শিল্প, আমার অভিনয়ের দোষত্রুটি নিয়ে কথা বলতে পারেন। সেসবের কিছুই না করে আপনি একজন শ্রমজীবী নারীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন। এটা কি আপনি সঙ্গত বলে মনে করেন? এই প্রতিবেদনের সত্য-মিথ্যা নিয়ে আমি কথা বলতে আসিনি। আমার একটাই জিজ্ঞাসা। সম্পূর্ণ নিজের শ্রমে দিনরাত নিজেকে উজাড় করে দিয়ে যে শিল্পীটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে সামান্য একটু জায়গা করে নিয়ে নিজেকে ঢেলে দিচ্ছে, তার ব্যক্তিগত জীবন অনুসন্ধান করা কি বাংলাদেশের প্রধান কবির বিবেকের কাছে সঙ্গত বলে মনে হয়েছে?

আমি বাংলাদেশের প্রধান কবির শিক্ষার কাছে, রুচির কাছে, বিবেকের কাছে শুধু এই প্রশ্নটি করলাম। আমার আর কিছু বলবার নেই।

#####

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়