Dr. Aminul Islam
Published:2020-12-24 02:45:00 BdST
দাম্পত্যে অভিমান , দাম্পত্যে রাগ
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
_____________________________
সত্যি সেদিন রাগ, অভিমানের যথেষ্ট কারণ ছিল। রাতেই দুজনের কথা হয়েছিল। শিউলি মনেও করিয়ে দিয়েছিল, মনে আছে গো কালকের কথা? মনোজ মনে করতে পারল না। শিউলি কপট রাগ করে মুখ ভার করে ছিল। এরপর আর না বলে কী করে থাকা যায়, কণ্ঠ অভিমানী—শোনো, কাল আমাদের বিবাহবার্ষিকী। সব আমাকেই মনে করিয়ে দিতে হয়। কাল অফিস থেকে আগে আগে আসবে। একটু আগে ছুটি নিতে পারবে না?
মনোজের আশ্বাস—দেখি, এরপর দুজনে বেরোব। ঘরে কিচ্ছু না, বাইরে মোমবাতির আলোতে ডিনার।
এদিকে শিউলি সারা দিন রূপচর্চা, সাজুগুজু করে তৈরি হয়ে থাকল। অপেক্ষার পালা আর শেষ হয় না। কিন্তু কী হলো? এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না। প্রথমে রাগ, এরপর অভিমানের মেঘ জমে মনের আকাশে। বাবু এলেন সন্ধ্যা পেরোলে। মুখ ফিরিয়ে নেয় শিউলি প্রচণ্ড অভিমানে। এখন কি জল ঝরবে চোখ বেয়ে? মনোজ ক্ষমা চাইল। হাতের উপহার দেওয়ার চেষ্টা, কিন্তু ব্যর্থ হলো সে প্রচেষ্টা। অবস্থা গুরুতর। জরুরি মিটিং পড়ল, কী করব বলো। এরপর ক্ষমা চাওয়া। আমার হাতে কিছু ছিল না, চাকরি রাখতে হবে তো। সন্ধ্যা পেরিয়ে এলে দেবী কথা বলছেন, মানে বরফ গলছে।
তুমি লক্ষ্মী, তুমি সব বোঝো। এই তো চলো, আমি তৈরি। উপহারের বাক্স খুলে বেশ ঝলমলে মুখ। যাক, অন্তত মনে তো রেখেছে। আর বাক্সের ভেতর কী ছিল তা জানে দুজনে, আর কেউ জানে না, আমিও না। শিউলির মুখে যেন আষাঢ়ের কালো মেঘ কেটে সোনাঝরা রোদের রেখা। অনেকটা যেন মেঘের কোলে রোদ হেসেছে টাইপ।
এরপর দুজনে মিলে বাইরে গেল আর তারপর যা ঘটল, পাঠক–পাঠিকা অনুমান করবেন। বিয়ে করলে মানুষকে এসব মেনে নিতে হয়। দুটো হাঁড়ি পাশাপাশি থাকলে ঠোকাঠুকি হবেই। বিয়ের পর একাধারে আনন্দ হলে সেটা মনে হবে পানসে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সোহাগের সঙ্গে রাগ না মিশিলে ভালবাসার স্বাদ থাকে না, তরকারিতে লঙ্কামরিচের মত।’
হৃদয় দিয়ে তা না হলে কী করে হবে হৃদি অনুভব? আঁখি দিয়ে আঁখির বোঝাপড়া? অভিমান না থাকলে?
আর রাগ? এ তো রাগ নয়, এ যেন অভিমান। এ শুধু তোমায় চাওয়ার, আরও বেশি কাছে পাওয়ার ছল। সেদিন শিউলির অভিমানের ছল ছিল, মনোজ কি বুঝেছিল? প্রেম থেকে দাম্পত্যে রাগ, অভিমানের পর্ব লেগে থাকে। অবশ্য রাগ কারও ওঠে তুঙ্গে। এমন ঘটনা মনোজের বাড়িতেও হয়। শিউলি যখন খুব রেগে যায়, মনোজ চুপ হয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে ক্লান্ত হয়। শিউলি বিরক্ত হয়, এরপর মনোজের অসহায় আত্মসমর্পণ দেখে হাসে। রাগ মিলিয়ে যায়। মনোজ ঘরোয়া এই রাগের ভালো ওষুধ বের করেছে। নিজে ডাক্তার তো!
এরপর কোথায় থাকে রাগ, দুজনের খুনসুটি, একান্ত আলাপ, তারপর কপোত–কপোতী যথা। একটি জিনিস ভালো, ওরা রাগ পুষে রাখে না, দ্রুত বের করে দেয়। এটাই তো স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। আর বোতলে ছিপি বন্ধ রাগ থাকলে একদিন তার বিস্ফোরণ হয়। এটা তাই বড় মন্দ অভ্যাস। হাসতে চাইলে হেসে ফেলুন, কান্না পেলে কাঁদুন আর রাগ হলে ঝেড়ে ফেলুন। ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে নিন। ঝড়–জলের পর সোনা সোনা রোদ ঝিকমিক করবে দাম্পত্যে।
আবার ফিরি কবিগুরুর কাছে, ‘সাধারণত স্ত্রীজাতি কাঁচা আম, ঝাল লঙ্কা এবং কড়া স্বামীই ভালোবাসে। যে দুর্ভাগ্য পুরুষ নিজের স্ত্রীর ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত সে-যে কুশ্রী অথবা নির্ধন তাহা নহে, সে নিতান্ত নিরীহ।’
দাম্পত্যে অনেক সময় অনেকে পণ করে বসে, তার সঙ্গে আর কথা বলব না। তখন হয়তো স্ত্রী ভাববাচ্যে কথা বলে, ‘নাশতা যেন খেয়ে নেয়’, বসার ঘরের টিভিকে বলতে থাকে, ‘বাইরে শীত পড়েছে। গরম কাপড় পরে যায় যেন।’ আধুনিক মেয়েরা তখন স্বামীকে আপনি বলে। কারণ, ভালোবাসে যখন তখন তুমি বলে, আর রাগলে বলে তুই। এ রকম কত দাম্পত্য কথা থাকে, সব কান পেতে শুনতে নেই। ছেলেদের বেলাতেও একই কথা।
কবিগুরু আরও বলেন, ‘মানুষ পণ করিয়া পণ ভাঙ্গিয়া ফেলে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচার আশায়।’ তাই তো দম্পতির মধ্যে রাগ, অভিমান হয়, পণ করে কথা না বলার, আবার সেই পণ ভাঙেও। সত্যিকার ভালোবাসায় তা–ই হয়।
অরূপ রতন নাটকে আছে, প্রেমের মধ্যে ভয় না থাকলে রস নিবিড় হয় না। আসলে এ তো এক জটিল কেমিস্ট্রি। এর রস দুর্জ্ঞেয়। বোঝে কার সাধ্য!
তবে অনেক সময় স্বামীর অভিমান হয় স্ত্রীর অবহেলা পেলে। কেউ অবহেলা সহ্য করতে পারে না। তাই অবহেলা যেন না করেন প্রিয়জন। স্ত্রী–পুরুষ দুপক্ষের জন্যই কথাটা প্রযোজ্য।
নীরবতার যে ভাষা আছে, তা বুঝতে পারে গভীর প্রেমে মজে যারা। আর প্রেমের সম্পর্ক কিন্তু পদ্মপাতার ওপর জলের ফোঁটার মতো, যত্ন না নিলে ভেঙে খান খান হতে পারে যেকোনো সময়।
ভালোবাসা কাকে বলে? অপেক্ষার মধ্যে অনিশ্চয়তা আছে জেনেশুনেও অপেক্ষা করা, এই হলো ভালোবাসা। আর অভিমান থাকে হৃদয়ের অতি গোপন প্রকোষ্ঠে, যা সহজে কেউ ছুঁতে পারে না। মনে রাখতে হবে, মানুষ অভিমান করে ভালোবাসার মানুষেরই ওপর, এই অভিমান সে সবার ওপর করে না। অভিমান বড় আন্তরিক এক অনুভূতি। বড় পলকা, বড় হালকা, বড় নাজুক অনুভব।
আর সত্যি বলতে কি, রাগ হবে না, অভিমান নেই এমন সংসার প্রাণহীন। রাগ, অভিমানের মোড়কে যে দাম্পত্য, এর একটি আলাদা সৌন্দর্য আছে। মান, অভিমান ভাঙানোর পর্ব আকর্ষণীয়, এর রসায়ন আলাদা। এই স্বাদ আস্বাদনের মধ্যে এক অনিঃশেষ আনন্দ আছে। আবার অভিমানের পর অনুশোচনার পর্ব যেন আরও আকর্ষণীয়, সিনেমার সেই টান টান মুহূর্ত—গল্প কোন দিকে মোচড় দেবে, সেটা নির্ভর করছে আপনার ওপর। তাই সংসারে হালকা রাগ বা অভিমান যেমন দাম্পত্যে প্রাণ আনে, তেমনি অতিরিক্ত রাগ ডেকে আনে ভাঙনের সুর। তাই রাগকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে হবে।
কেউ যদি খুব রাগী হয়, তাহলে তাদের জন্য কিছু টোটকা আছে—যোগব্যায়াম। মৎস্যাসন, শবাসন, প্রাণায়াম ও শ্বাসের ব্যায়াম রাগ কমাতে সাহায্য করে। রাগলে কিছু সময় মৌন ব্রত থাকুন।
শোবার ঘরের রং বদলে দিতে পারে বিছানার চাদর–পর্দাও। সবুজ রং শোবার ঘরে। দিনভর ক্লান্ত খিটমিটে হয়ে ফিরলে মন হবে শান্ত আর শান্তির চাদরে ঢাকা পড়েছেন। তবে এমন করে যাবে দিন যাক না। টক–ঝাল–মিষ্টি—এই নিয়ে বিবাহিত জীবন। আর অবশ্যই পালন করুন বিবাহবার্ষিকী। কারণটা নাহয় আবার রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ধার করি, ‘লোকে ভুলে যায়, দাম্পত্য একটি আর্ট, প্রতিদিন ওকে নতুন করে সৃষ্টি করতে হয়।’
আপনার মতামত দিন: