SAHA ANTAR

Published:
2020-10-30 01:31:31 BdST

ডাক্তারি পেশার সঙ্কট ও সাত সতেরো


 


অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার
_____________________


এক.
আমরা চিকিৎসা পেশার সদস্যরা যে সংকটে পড়েছি সেখান থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসার আপাত কোন সুযোগ নেই। তবে চেষ্টা করলে সমস্যার তীব্রতা কমিয়ে আনা যাবে এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের সময়টাও কাছে নিয়ে আসা যাবে।
কে চিকিৎসক হয়?
সাধারণত ছোট্টবেলা থেকে যারা নিয়মিত পড়াশোনা করে, ভাইবোনদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সুশৃংখল-বাবা-মার অনুগত, সমাজে মেধাবী বলে পরিচিত তারাই চিকিৎসক হয়।
তাদের অধিকাংশেরই স্বপ্ন থাকে চিকিৎসক হবার, বাকিরা পিতা মাতা, নানা নানি, দাদা-দাদির স্বপ্ন পূরণের জন্য চিকিৎসা পেশা বেছে নেয়।
রাত জেগে পড়াশোনা করে, কোচিং সেন্টারের নিচে মাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখে ক্ষুধা পেটে কোচিং করে উদ্বিগ্নতায় কয়েকটা মাস কাটিয়ে অবশেষে মেডিকেল কলেজে যখন এই ১৭/১৮ বছরের তরুণ-তরুণী ভর্তি হয় তারপর শুরু হয় নতুন এক পাংশু জীবন।
সে জীবনের সাথে আমরা সবাই পরিচিত।
হোস্টেলে সিট থাকে না -এনিমেল হাউসে অবস্থান হয়,
ডাইনিং এর খাবার খারাপ-টিফিন ক্যারিয়ারে বাইরে থেকে খাবার আসে, ডিসেকশন হলের ফরমালিনের গন্ধে ক্ষুধা চলে যায়-আইটেম পেন্ডিং পড়ে-কার্ড ক্লিয়ার হয়না।
মা-বাবার টেলিফোন থেকে শুরু করে পরিচিত মহলের কাঙ্খিত টেলিফোন গুলোও বিরক্তির সৃষ্টি করে।
বই-খাতা বিছানা বালিশ সব ফেলে রেখে এক সময় যে ছেলে মেয়েটি বাড়ি চলে যায় অভিবাবকরা আবার বুঝিয়ে তাকে এই খোয়াড়ে নিয়ে আসে। মুখোশ পড়া সমব্যাথী সঙ্গী জুটে গিয়ে জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে।
শুরু হয় অমানুষিক পীড়ন।
নিজের ভাই বোন কাজিনরা যখন শীতের সময় সিলেটে লালাখাল দেখতে যায় তখন এই তরুণ-তরুণী ফাইনাল প্রফ এর পাঠ নিয়ে জীবন মরণ যুদ্ধ করে।
মেলা খেলা পিঠা উৎসব তাদের জীবনের কোন অর্থ বহন করে না।
মেডিকেল কলেজের পরিবেশের কারণে এই নিরপেক্ষ ভদ্র ছেলে মেয়েগুলো ক্রমশ পরিবর্তিত হতে থাকে। তাদের মন মানসিকতায় দ্রুত পরিবর্তন আসে এবং তারা তাদের সেই সুকুমার মনোবৃত্তি ধরে রাখতে পারেনা।
দলীয় কোন্দল থেকে শুরু করে এমন কোনো ঘটনা নেই যা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও মেডিকেল কলেজে ঘটেনি।
আবার একই সাথে ভালো-মন্দে মিশ্রিত এই ছেলে মেয়েগুলো তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে আগত রোগীদের আতিথিয়তায় ও চিকিৎসা সেবায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করে থাকে।
গ্রাম থেকে আগত পরিচিত-অপরিচিত আত্মীয়-স্বজনকে নিজের বেডে রেখে চিকিৎসা করায়নি এমন মেডিকেল স্টুডেন্ট হাতে গোনা, নাই বললেই চলে।
মেডিকেল জীবনের সেই দৃশ্যগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলে আমি সত্যিই এই পেশা নিয়ে গর্বিত হই।
একই সাথে যখন শুনি কোন অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার ইন্টার্ন ও পঞ্চম বর্ষের মেডিকেল ছাত্রদের হাতে মার খেয়েছে তখন লজ্জায় মাটির নিচে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
ছাত্র জীবন শেষ করে যখন এরা কর্মজীবনে প্রবেশ করে তখন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় ইন্টার্ন লাইফে।
এরপর যখন বেকার জীবন শুরু হয় তখন বস্তুত সবাই বুঝতে শুরু করে জীবন কত কঠিন: বাবার টাকায় ফুরফুরে মেজাজে পাঁচটা বছর কাটিয়ে দেয়া আর ইন্টার্ন জীবনে নিজের কামাইয়ের টাকায় চলায় যোজন যোজন ফারাক।
মামার বাড়িতে আটকা পড়া- পাত্তা না পাওয়া অবহেলিত ফটিকের মত এই অবহেলিত বেকার নব্য চিকিৎসকগণ প্রথমবারের মত বুঝতে পারে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলেও এর মাধ্যমে একটা সুন্দর জীবন পাওয়ার অভিলাসে সম্ভবত ছাই পড়তে বসল।
এরপর তাদের জীবন যুদ্ধ শুরু হয়।
সেখানে সরকারি চাকরি, কোচিং, পোস্ট গ্রাজুয়েশনে চান্স পাওয়া, বিয়ে শশুর বাড়ি, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চাকরি, ঢাকার বাইরের গিয়ে মান-সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে টাকা কামাইর মত যুদ্ধ কয়েকটি বছর অবিরত চালিয়ে যেতে হয়।
যারা কোনরকম সরকারি চাকরির ট্রেনটা ধরতে পারে তারা কিছুটা হলেও সমাজে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে কিন্তু যারা সেই ট্রেন মিস করে বা ইচ্ছা করেই প্রশ্নবিদ্ধ ট্রেনে উঠতে চায় না তাদের হয় বিপদ।
প্রতিবছর সরকারি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে প্রায় ১০ হাজারের মতন চিকিৎসক দের হয়।
প্রশ্নবিদ্ধ মানহীন মেডিকেল কলেজগুলো টিকিয়ে রেখে সরকারের কি লাভ তা আমাদের বোধগম্য নয়।
পরিকল্পনাবিহীন ভাবে এই সমস্ত ফ্যাক্টরি থেকে যে চিকিৎসক উৎপাদিত হয় তাদের অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার এই প্রক্রিয়া কেন জারি রেখেছে তাও বুঝতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।
সিনিয়র জুনিয়র চিকিৎসকদের মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার বিস্তর ফারাক, চিকিৎসক কর্তৃপক্ষের এড়িয়ে চলা দায়িত্বহীন মনোভাব, জুনিয়রদের অস্থিরতা ও দ্রুত টাকা কামাইর দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শতধা বিভক্ত করে ফেলেছে।
বৈষম্যের এই সংসারে এভাবে কষ্ট পেতে পেতে চিকিৎসক কূল এক সময় হতাশাকে সঙ্গী বানিয়ে বসবাস শুরু করে।
দুই.
আমাদের চিকিৎসকদের গ্রুপগুলোতে চিকিৎসকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট পোস্ট থাকবে, পেশার উন্নতি প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা থাকবে, বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে-এটাই স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত।
কখনো কখনো পোস্টগুলোতে সমস্যাবলীর অল্পবিস্তর কারণ প্রস্ফুটিত হলেও অধিকাংশ সময়ই ব্যক্তির মান অভিমান, রাগ গোস্সা, আক্ষেপ ও সংক্ষুব্ধতা মিশ্রিত থাকে বলে আসল জিনিস হারিয়ে যায়। তার মধ্যে যারা মন্তব্য করেন তাদের অনেকে পোস্ট এর বক্তব্য পুরোপুরি হৃদয়াঙ্গম না করেই আবেগ মিশ্রিত মন্তব্য করতে শুরু করেন-যে কারণে পোস্টদাতার আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।
এখানে অ্যানাটমি ডিসেকশন হলে পাঠরত স্বপ্নচারী থেকে শুরু করে এ বছরের ৩১ শে ডিসেম্বর চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুত গ্রহণকারী সেই বৃদ্ধ মেডিকেল অফিসার আছেন যার মেয়ে বিসিএস করে এই উপজেলাতেই চাকরি করছে। হেটারোজেনাস গ্রুপ হবার কারণে বিভিন্ন পোস্টদাতা ও পাঠকের বক্তব্য ও মন্তব্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে যা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু নিজের মনের মতো না হলেই বিপত্তি।
মতামতের ভিন্নতায় কোন সমস্যা নেই।
যে যার মত প্রকাশ করবে, নিজের যুক্তি দেবে, অন্যের যুক্তি খন্ড করবে এতে দোষের কিছু নেই।
কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে মাইন্ডসেট নিয়ে, ভাষা প্রয়োগ নিয়ে ।
অনেকের মধ্যে ফ্লেক্সিবিলিটি এত কম যে তাদের নিয়ে শুরু করা যায়না, শেষও করা যায় না। কোন প্রসঙ্গে বক্তব্য এলে আমি যদি প্রথমেই ধরে নেই তিনি ভুল আমি ঠিক-এবং এটা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে তাহলে কোন সমাধানেই পৌঁছা যায় না। এসব গ্রুপে অধিকাংশ সময় তাই হয়। সেজন্য অনেক সংবেদনশীল সিনিয়র হতাশ হয়ে গ্রুপ থেকে বিদায় নেন, অনেক জুনিয়র মন মতো হয়নি বলে আক্ষেপ করে গ্রুপের এডমিনদের গালমন্দ দিতে দিতে বিদায় নেয়, মেজাজ ঠিক হলে আবার যোগ দেয়।
খালি চোখে আমরা আমাদের পেশায় যে সমস্ত সমস্যা দেখে থাকি তার অধিকাংশই সিস্টেমের সাথে জড়িত, দীর্ঘদিনের চিকিৎসা কৃষ্টির সাথে জড়িত। কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এই সমস্ত সমস্যার ক্ষুদ্র কারণ হলেও হতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে প্রধানত বড় বড় সমস্যাগুলোর আবির্ভাব হয়েছে।
পদ্ধতি বা সিস্টেম নিয়ে একটা লাইন বলতে গেলে বলতে হয় আমাদের দেশে যে খুনের আসামি,যে মাদকাসক্ত চোর, রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় যে পালিয়ে বেড়াচ্ছে-তারা সবাই সুইডেন, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়াতে ট্যাক্সি চালায়-সুপারশপে কাজ করে--সেখানে সে একজন সুনাগরিক।
সেখানে সে রাষ্ট্রের সব নিয়ম মেনে চলে, অন্যের অধিকার সংরক্ষণ করে চলে।
আমাদের দেশেই যে সিএনজি চালক শাহবাগ থেকে ফার্মগেট হয়ে খুব এলোমেলোভাবে গাড়ি চালিয়ে, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে শহীদ জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে সেনানিবাসে প্রবেশ করে- সে কিন্তু সিএমএইচ পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট গতিতে ট্রাফিক নিয়ম মেনেই গাড়ি চালায়।
কারণ সেনানিবাসের ভিতরে অফিসার সৈনিক তাদের পরিবারবর্গ এমনকি বেসামরিক গাড়ি চালকদের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য।
অনিয়ম করলে সামরিক-বেসামরিক নির্বিশেষে ট্রাফিক আইন অনুযায়ী শাস্তি হয়। অতএব সুষ্ঠু সিস্টেম একটা বড় ফ্যাক্টর।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমরা যদি একটা স্থায়ী রোগী বান্ধব চিকিৎসা পদ্ধতি চালু করতে পারতাম তাহলে সবার আগে স্বাস্থ্যকর্মীদের চাহিদাটাই পূরণ হতো।
দেশে যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ইবতেদায়ী মাদ্রাসার মত সরকারি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছড়াছড়ি, ব্যাঙের ছাতার মতো মানহীন অজস্র হাসপাতাল ক্লিনিক এবং সেখানে সেবায়রত নৈতিকতা বিবর্জিত কিছু ফিজিশিয়ান সার্জনদের কুদৃষ্টান্ত স্থাপন, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি, সিনিয়র জুনিয়রদের পারস্পরিক সম্পর্কের দারুন ঘাটতি, ক্যাডার বৈষম্য, হাজার হাজার জুনিয়র ডাক্তারদের চাকরিহীন করুন জীবন যাপন, চিকিৎসা পেশার প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের সঠিক ভূমিকা রাখায় ব্যর্থতা, ভুয়া ডাক্তার-স্যাকমো-ভারতীয় ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন বিহীন দৌরাত্ম্য-কোয়াক ডাক্তারদের অত্যাচার-এর বিপরীতে বিএমডিসির অটিস্টিক আচরণ ও সর্বোপরি পেশার সকল সদস্যদের মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে তার প্রধানতম কারণ হচ্ছে একটা সুন্দর স্থায়ী ও শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভাব যা কিনা সরাসরি রাষ্ট্রীয় পলিসির সাথে সম্পর্কযুক্ত।
একটা কঠিন কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আমরা যে প্রজাতন্ত্রের বাসিন্দা ঠিক সেই একই ছাদের নিচে বসবাস করে নানান পেশার মানুষ।
আমার দেশে যতো আছে উচ্চ শিক্ষিত বেকার তার চেয়ে বহু গুণ আছে কম শিক্ষিত বেকার। আছে কর্মহীন ভবঘুরে মানুষ, আছে বস্তিবাসী, আছে ফুটপাতে শুয়ে থাকা নাম ঠিকানাহীন আদম সন্তান। কৃষকদের পরতায় পড়ে না বিধায় কৃষিকাজ ফেলে রেখে তারা শহরমুখী হচ্ছে প্রতিনিয়ত কারণ ঢাকা শহরে নাকি ভিক্ষা করেও আট দশ হাজার টাকা কামাই করা যায়।
করোণা কালীন সময়ে নিম্নআয়ের প্রচুর মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আঠেরো কোটি মানুষ অধ্যুষিত এই বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এই সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক, নাগরিক ও আর্থিক অধিকারের বিষয়ে আমাদের কোন কিছুই কি ভাববার নেই?
আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত সন্দেহ নেই কিন্তু এই সমাজের উল্লিখিত জনগোষ্ঠী ন্যূনতম মানবাধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারছে না-একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে এগুলো আমাদের ভাবনার বিষয় হওয়া উচিত।
রাষ্ট্রের চোখে সকল নাগরিক সমান, জন্মগতভাবে তার সমঅধিকার।
সাংবিধানিক এই অধিকার কে কতটুকু ভোগ করছে?
ভেন্টিলেটর পাওয়া তো দূরে থাক-আইসিইউতে বেড পাওয়ার সৌভাগ্য কজন করোণ আক্রান্ত রোগীর হয়েছে?
করোনা এসে প্রমাণ করে গেল আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর, আর নিজেদের সকল অযোগ্যতাকে ডাক্তারদের উপর দিয়ে চালিয়ে দেয়ার সহজ কাজটি কর্তৃপক্ষ করেছে -আমাদের স্বাস্থ্য পেশার নেতৃবৃন্দ মেনে নিয়েছে।
সাম্প্রদায়িকতা বলতে আমরা সাধারণত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে বুঝে থাকি। এছাড়াও দলীয়, গোষ্ঠীগত, অঞ্চলভিত্তিক, লিঙ্গ কেন্দ্রিক, পদ-পদবী কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িকতা বিদ্যমান যার স্বেচ্ছাচারী চর্চা যে কোন পেশার জন্য অপরিসীম ক্ষতিকর। আমরা কখনোই নিরপেক্ষ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি যার মাশুল আপনাকে আমাকে সব সময় গুনতে হচ্ছে। কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে কথা বলতে গেলে, আলোচনা উঠলে আমরা আমাদের মাইন্ডসেট নিয়েই কথা বলি যা অতিপ্রাকৃতিক, পাশবিক ও অনেকটা বর্বর যুগের আচরণ: এরমধ্যে কোন মানবিক-উদার মনোভাবের পরিচয় ফুটে উঠে না।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যার মূল কারণটা উল্লেখ করার জন্য আমি ওয়াদা করেছিলাম সেটাই এখন করছি।
Peronial নার্ভ বা Brachial plexus এর সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে আমরা যদি ফোরামেন ম্যাগনাম পর্যন্ত উঠে আর উপরে উঠতে না চাই-সেরিব্রামের Betz Cell পর্যন্ত ঠিক আছে কিনা তা পরখ করে না দেখি বা এতদসংক্রান্ত আলাপে নিষেধাজ্ঞা জারি করি তাহলে আপনি যেভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না ঠিক একইভাবে রাষ্ট্রের গলদ নিয়ে আলোচনা না করলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পলিসির সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্যাগুলোর সমাধানও করতে পারবেনন না , যেমনটা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যার সমাধান করতে পারছিনা।
কোনো সভ্য দেশে পেশাজীবীরা বৈষম্যতার শিকার হয়ে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য মানববন্ধন, কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচির মত হটকারীমূলক কর্মসূচি দিয়েছে এমনটা শোনা যায় না। বিভিন্ন পেশাজীবীরা মূলত জনগণের সেবায় নিয়োজিত। জনগণের সেবাকে নিশ্চিত করার জন্য সরকারই ঐ সকল পেশার সদস্যদের সকল প্রকার যৌক্তিক অধিকার সংরক্ষণ করে থাকে।
আমরাও কোনো হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দাবি দাওয়া আদায় করতে চাইনা-আমরা চাই সমানভাবে সকলে সঠিক সমস্যাটা চিহ্নিত করি। মূল সমস্যা কে পাশ কাটিয়ে প্রান্তিক সমস্যাকে নিয়ে বাকবিতন্ডা করে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে শক্তি ক্ষয় করা যাবে কিন্তু কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে না।
অফিসের অত্যাচারী বসের অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে চললে তার কাছ থেকে ন্যায্য দাবী দাওয়া কখনোই আদায় করা যায় না।
রাস্ট্র কোন সুনির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিতত না হলে কোন স্বতন্ত্র ভাল প্রতিষ্ঠানও একদিন তার সৌন্দর্য হারায়।
আবরার হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিক দৃষ্টান্ত, ভিসি পদত্যাগের নাটকীয় অধ্যায় সহ অন্যান্য কর্মকান্ড ঐতিহ্যবাহী অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কেও কলুষিত করে ছেড়েছে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটাবিরোধী আন্দোলনে দল-মত ধর্ম লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা
একটা দাবিতে ঐক্যমতে পৌঁছেছিল, আজ সময় হয়েছে সকল বিভাজন ভুলে আমাদের সকলের স্বার্থে বিশেষ করে রোগীদের স্বার্থে একটা স্মার্ট স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রবর্তন যেখানে সরকার নাগরিকের মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার সংরক্ষণে বাধ্য হবে।
তারও আগে প্রয়োজন ঘুনে ধরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে মেরামত করা। নাগরিক হিসেবে জনগণ যেমন ট্যাক্স দিয়ে নাগরিক দায়িত্ব পালন করে, ইসলাম ধর্মের ধনী মানুষেরা যেভাবে যাকাত দিয়ে অর্থকে পবিত্র করে - জং ধরা এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ঠিক করার জন্য আপনার-আমার মেধাশ্রমের খানিকটা অংশ সেখানে বিনিয়োগ করা আজ খুব জরুরী।
সাবান দিয়ে জিন্সের ট্রাউজার পরিষ্কার করতে গেলে যেভাবে এমনিতেই হাত পরিষ্কার হয়ে যায়-এমনকি নখের নিচের ময়লা ও চলে যায় সবাই মিলে দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে একটা জবাবদিহিতা মূলক সরকার গঠন ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সব পেশার সব নাগরিকের অধিকার এমনিতেই সংরক্ষিত হবে।
প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ।
শেবাচিম একাদশ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়