SAHA ANTAR

Published:
2020-10-14 19:08:52 BdST

" দাদা খেয়ে এসেছেন নাকি যেয়ে খাবেন! "


 

ডাঃ সুকুমার সুর রায়
________________________


বৃহত্তর বাংলা অবশেষে ভাগ হয়ে পুর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলা হয়েছিলো।
অবশ্য এই বাংলা ভাগের অনেক আগে থেকেই পুর্ব ও পশ্চিম এই দুই অঞ্চলে দুই রকমের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা
বিরাজ করতো তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ফলশ্রুতিতে ' ঘটি' ও 'বঙ্গাল' এই দুই ধরনের সামাজিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আমরা আগে থেকেই দেখে আসছিলাম।
আমি ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, অর্থনীতির ছাত্র নই।
তবে সাধারণ মানুষের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা এটুকু বুঝি যে, পূর্ববঙ্গ নদী মাতৃক, উর্বর ভূমির সমৃদ্ধ অঞ্চল।
অপর পক্ষে পশ্চিম বঙ্গ তুলনামূলক অনুর্বর ভূমির অসমৃদ্ধ অঞ্চল।
কিন্তু তা হলে কি হবে, বৃহত্তর বাংলার রাজধানী ছিলো কলকাতা।
সেই সুবাদে শিক্ষা দীক্ষায় কলকাতা ও পশ্চিমের অধিবাসী 'ঘটিরা' ছিলো অগ্রসর ও উন্নাসিক।
অপরপক্ষে পূর্ববঙ্গ ছিলো অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ এলাকা।
একই সাথে অধিকাংশ জমিদারেরা ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
এই সকল জমিদারদের অধিকাংশ জমিদারি ছিলো পুর্ববঙ্গে।
জমিদারি ও অন্যান্য ব্যবসা বানিজ্য থেকে উপার্জিত অর্থ তারা বিনিয়োগ করতেন রাজধানী কলকাতা কেন্দ্রিক শিল্প ও বানিজ্যে।
তাদের সন্তানেরাও কলকাতায় উচ্চ শিক্ষার্থে গমন করে সেখানকার এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত উন্নাসিক গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতেন।
পরবর্তীতে দেশ বিভাগের পর পুর্ব বঙ্গের অধিকাংশ জমিদার গোষ্ঠি সহায় সম্পদ জমিদারি ফেলে ওপারে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। ফলে তারা রাতারাতি সহায় সম্পদহীন হয়ে না পড়লেও উচ্চ বিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে রুপান্তরিত হয়ে যান।
জমিদার শ্রেনীর সাথে সাথে আরো যারা দেশত্যাগ করে ওপারে চলে যান তারা হলেন মধ্যবিত্ত কৃষক ও মাঝারি ব্যবসায়ী।
প্রকৃত পক্ষে এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর লোকেরা সত্যিকারার্থে পশ্চিম বঙ্গে চলে গিয়ে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসা বানিজ্য হারিয়ে সত্যিকারের নিম্নবিত্তে পরিনত হন।
এমনকি অনেক মানুষ যারা দেশ ভাগের পর পর এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন দাঙ্গা কিংবা দাঙ্গার ভয়ে ও পঁয়ষট্টির পাক ভারত যুদ্ধের পর, দেশত্যাগ করেছে তারা আক্ষরিক অর্থেই সহায় সম্বলহীন উদবাস্তুতে পরিনত হয়ে যায়।
বিভিন্ন উদবাস্তু শিবিরে এমনকি পশ্চিম বঙ্গের বাইরে উরিষ্যার দন্ডকারন্যের জঙ্গলে সরকার তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়।
একথা ঠিক যে পুর্ববঙ্গের হিন্দুরা যে হারে দেশত্যাগ করে পশ্চিম বঙ্গে চলে যায় সেই একই হারে পশ্চিম বঙ্গের মুসলমানেরা পুর্ববঙ্গে মাইগ্রেশন করেনি।
এর একটা রাজনৈতিক কারন হতে পারে এই যে, মুসলমানেরাই রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান রাস্ট্রের জন্ম দিয়েছে তাই এই রাস্ট্রে স্বাভাবিক ভাবেই তাদের অগ্রাধিকার থাকবে।
আরো একটি কারন হলো হিন্দু জমিদার ও তাদের বশংবদেরা এদেশীয় মুসলমান প্রজাদের উপরে যে অকথ্য অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে তা এতো তাড়াতাড়ি ভুলবার কথা নয়।
ফলে একথা অনস্বীকার্য যে, দেশত্যাগী হিন্দুরা ওপারে গিয়ে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে এবং সেই অবস্থা থেকে তাদেরকে অনেক কষ্টে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে হয়েছে।
অপর পক্ষে পুর্ববঙ্গীয় মুসলমানেরা দ্রুত শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে গিয়েছে।
দ্রুত এক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত এলিট শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে এই আর্থসামাজিক উন্নতির ধারা আরো বেগবান হয়েছে।
একথা অনস্বীকার্য যে , এই আর্থসামাজিক উন্নতির ধারা বেগবান হতে হতে এক শ্রেনীর নীতি নৈতিকতাহীন লুটেরা ধনিক শ্রেনির উত্থান হয়েছে।
এই লুটেরা ধনিক শ্রেণী রাজনৈতিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে দেশের সব কিছুতে জেঁকে বসেছে।
শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি, সুষম উন্নয়নের পরিবর্তে এক অস্থিতিশীল মার মার কাট কাট সমাজের উৎকট আবির্ভাব হয়েছে।
সেই সমাজে ন্যায় নির্বাসিত হয়েছে। অন্যায় সামাজিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
সম্পদের অসম বণ্টনের ফলে ধনিক শ্রেণী ধরাকে সড়া জ্ঞান করছে। দরিদ্র শ্রেনি মুখ বুজে পড়ে আছে অথবা লুটেরা ধনিকদের অনুসরণ করে তারাও এক অসম লুটপাটের অর্থনীতির সামিল হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এত কথা বলার ইচ্ছা আমার ছিলো না।
দুই বাংলার আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারায় বর্তমানে যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে হাস্য রসের সৃষ্টি করে তা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এত বড় ভূমিকার অবতারণা করতে হলো।
" দাদা খেয়ে এসেছেন নাকি যেয়ে খাবেন? "
এই সংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠে নাই।
১৫ বছর আগে পশ্চিম বঙ্গে ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম ।
সেখানে যাওয়ার আগে সামাজিক কারনেই মিষ্টির দোকানে যেতে হলো।
মিষ্টির দোকানির সাথে কথোপকথন:
আমি: " দাদা মিষ্টি কত করে?"
দোকানিঃ " চার টাকা পিস দাদা।"
আমি: " আরে দাদা কেজি কত করে? "
দোকানিঃ " প্রতি পিস চার টাকা দাদা । "
আমি: " দেখুন দাদা, আমি চার কেজি মিষ্টি নেবো। কিসের পিস' পিস ' বলছেন! "
দোকানিঃ " ও, দাদা! বুঝেছি আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন! আগে বলবেন তো!! "
এবার চার কেজির চার প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে যখন ভাইয়ের বাসায় ঢুকলাম তখন ভাই ও ভাইবউ চক্ষু বড় বড় করে আমার দিকে এগিয়ে এলো!
ভাই ঃ " এগুলি কি! ? "
আমি ঃ" মিষ্টির প্যাকেট। "
ভাই ঃ " চার প্যাকেট কেন!? "
আমি ঃ " তোমাদের এক প্যাকেট, ভাতিজার শশুর বাড়ি একপ্যাকেট, দুই ভাতিজির শশুর বাড়ি দুই প্যাকেট। "
ভাই ঃ " প্রতি প্যাকেটে কয় পিস করে আছে? "
আমি ঃ" প্রতি প্যাকেটে এক কেজি করে আছে। "
ভাই ঃ " সর্বনাশ! এখানে কেউ মিষ্টি খায় না! সবার রক্তে সুগার!"
দোকানী নির্ঘাত তোমাকে ঠকিয়েছে! এখানে কেজি হিসেবে মিষ্টি বিক্রি হয় না।
কারো বাড়িতে গেলে, সেই বাড়িতে যে কয়েকজন মানুষ সেই কয়েক পিস মিষ্টি নেওয়া হয়! "
তারপর মিষ্টির প্যাকেট খুলে পিস হিসেবে গুনে গুনে দেখা হলো আমাকে ঠকানো হয়েছে কিনা তা যাচাই করার জন্য!?
এরপর বোনের বাড়ি গিয়েছিলাম।
ভাগ্নে আমাকে সাথে নিয়ে মাছের বাজারে গিয়েছিলো।
একটি ছয় কেজি ওজনের রুই মাছ মাপা হলো।
দরদাম করে ছয় কেজি ওজনের মাছ কেটে সেখান থেকে পাঁচ টুকরো পেটির মাছ কিনে নিয়ে আমরা বাসায় ফিরলাম। উল্লেখ্য বাসায় সদস্য সংখ্যা ছিলো চার জন, আমি সহ পাঁচজন।
আরো উল্লেখ্য যে, আমার এই ভারতীয় ভাই ও বোনের পরিবার হত দরিদ্র নয়।
তাদের নিজস্ব দোতলা ছিমছাম আধুনিক বাড়ি আছে। ভাইয়ের গাড়ি আছে। ভাই ও ভাই বউ স্কুল শিক্ষক।
তারা বছরে কম পক্ষে একবার দেশে ও দেশের বাইরে বেড়াতে যায়।
এই প্রসঙ্গে আরো একটি কথা বলে রাখা ভালো।
চল্লিশ বছর আগে আমরা যখন জাপানি টেট্রন কাপড়ের জামা গায়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে যেতাম, তখন তারা অবাক বিস্ময়ে সেই টেট্রনের জামা হাত দিয়ে টিপে টিপে দেখতো!
এখন তাদের রেমন্ড কাপড় ছাড়া আমাদের একদম চলেই না।
এতো কথা বললাম এই কারনে যে, গতকালের প্রথম আলো পত্রিকার উপসম্পাদকীয় লিখেছেন প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দোপাধ্যায়। তার লেখাটি পড়ে মনে কষ্ট লেগেছে।
তিনি ঢাকার কারওয়ান বাজারে মাছ কিনতে গিয়ে বড় মাছের একটা অংশ কিনতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সেই সঙ্গে ঢাকার নাম করা মিষ্টির দোকানে গিয়ে তিনি মিষ্টি কিনতে পারেন নাই।
দোকানি তাকে বিরাট বাক্স সহ এক কেজি মিষ্টি মেপে দিয়েছেন! কিছুতেই বাক্সের ওজন বাদ দিয়ে মিষ্টি মেপে দেননি।
এতে সাংবাদিক বাবু মন্তব্য করেছেন যে বাংলাদেশে ' ভোক্তা অধিকার ' বলে কিছু নেই।
এর সোজাসাপ্টা অর্থ দাঁড়ায় সমাজে কোন শৃঙ্খলা নেই। আপামর নাগরিক স্বার্থ এখানে রক্ষিত হয় না। অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকট হচ্ছে।
বড় বড় মাছ, ও অন্যান্য খাদ্য পন্য কখনোই গরীবের ক্রয়সীমার মধ্যে ছিলো না এখনো নেই।
এই যে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য! গরীবের ক্ষুধার্ত চোখের সামনে গাড়ি ঠেকিয়ে লুটেরা ধনিকের বড় মাছটি নিয়ে যাওয়া, এটি সেই বড় লোকের সাময়িক বড়লোকি স্টাটাস প্রকাশ করে বটে তবে ধীরে ধীরে তা সমাজে
এক ভয়ংকর অস্থিরতা তৈরি করতে বাধ্য।
সেই অস্থিরতা অলরেডি তৈরি হয়ে গেছে।
যা আমরা বর্তমান সমাজের পরতে পরতে দেখতে পাচ্ছি।
এক শ্রেণির মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লুট করে বিদেশে পাচার করছে, অস্ট্রেলিয়া কানাডায় সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে!
আরেক শ্রেণির মানুষ সামান্য জীবন মানের
পরিবর্তনের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে শেষমেশ ইঁদুরের মতো ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছে!
মনে রাখা দরকার এই অবস্থা বেশিদিন চলতে পারে না।
একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।
কারন - "প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে । "
তাই গরীবের ঘরের একমাত্র মোরগটি জবাই করে আতিথেয়তা দেখানোর যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি একটি বড় ইলিশের একখানা পেটির মাছ কিনে খাওয়ার অধিকার এই গরীবের থাকা প্রয়োজন।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়