SAHA ANTAR

Published:
2020-10-09 15:26:58 BdST

"দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আমার নোবেলপ্রাপ্তি লজ্জাজনক বিষয়ে পরিণত হয়েছে"


 

নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের পর জাঁ পল সার্ত্রে ১৯৬৪ সালে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখান থেকে চুম্বকাংশের অনুবাদ করেছেন প্রখ্যাত কথাশিল্পী রাজিক হাসান
____________________


আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আমার এই নোবেলপ্রাপ্তি ঘটনা এক ধরনের লজ্জাজনক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমাকে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে, এবং আমি তা প্রত্যাখ্যান করেছি। কেন করেছি? এর কারণ হল, পর্যাপ্ত সময় নিয়ে আমাকে জানানো হয়নি আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে।
অক্টোবরের পনের তারিখ পর্যন্ত যদিও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, আমি ‘ফিগারো লিটারেয়ার’-এর কলামে পড়লাম সুইডিশ অ্যাকাডেমির পছন্দ আমার দিকেই ঝুঁকছে, আমি সিদ্ধান্ত নেই যে অ্যাকাডেমি বরাবর একটা চিঠি লিখেই আমি বিষয়গুলি পরিষ্কার করতে পারব। এরপর তা নিয়ে আর কোনো বাড়তি আলাপও হবে না। পরদিনই আমি চিঠিটা পাঠাই।
আসলে আমার জানা ছিল না যে প্রাপকের মতামতের তোয়াক্কা না করেই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। আমি ভেবেছিলাম যে ঘটনাটি ঘটার আগেই প্রতিকার করবার মতো যথেষ্ট সময় রয়েছে। কিন্তু আমি এখন বুঝতে পেরেছি যে সুইডিশ অ্যাকাডেমি একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে , পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার করা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।
নোবেল প্রত্যাখ্যান আমার কোনো খামখেয়ালী পদক্ষেপ নয়। আমি সবসময় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বর্জন করেছি। একই কারণে দ্বিতীয বিশ্বযুদ্ধের পর আমাকে ‘লিজিওন অভ অনার’ প্রদানের প্রস্তাব করা হলে আমি তা ফিরিয়ে দেই। একইভাবে প্রিয় বন্ধুদের অনুরোধ ও পরামর্শ সত্ত্বেও কখনো আমার "কলেজ দ্য ফ্রান্সে" প্রবেশ করার ইচ্ছে হয় নি।
একজন লেখক যখন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যিকবিষয়ক ইস্যুতে তাঁর অবস্থান নেয়, তখন তাঁকে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজস্ব উপায়ের উপর সক্রিয় হতে হয়। সেই উপায়টা হচ্ছে লিখিত শব্দ। একজন লেখক যেসব স্বীকৃতি গ্রহণ করে, সেই সব স্বীকৃতিই তাঁর পাঠকের উপর চড়াও হয়, যা আমার কাছে একেবারেই কাঙ্খিত নয়। নিজের নাম ‘জাঁ পল সার্ত্র’ লিখে সই করা ও ‘জাঁ পল সার্ত্র, নোবেলবিজেতা’ লিখে সই করা, দুটো স্বাক্ষর কখনোই নয়।
লেখক যখন কোন সন্মান গ্রহণ করে থাকেন, তখন তিনি নিজের নামের সাথে সন্মানদাতা প্রতিষ্ঠানটিকেও জড়িত করে ফেলেন। আমার দায়বদ্ধতা ভেনেজুয়েলার বিপ্লয়িদের প্রতি, অন্যদিকে সেই দায়বদ্ধতা ও সহানুভূতি যদি নোবেলবিজয়ী জাঁ পল সার্ত্র থেকে আসে তখন সমগ্র ‘নোবেল’ একটা প্রতিষ্ঠান হিসাবে সেই সমর্থনের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে।
অতএব একজন লেখককে নিজে একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া থেকে রোহিত হওয়া উচিত।
আসলে নোবেল পুরস্কার আলাদা করে পশ্চিমা জোটের নিজস্ব কোন সাহিত্য পুরস্কার নয়। আবার নোবেলের অর্থ এমন দাঁড়িয়েছে যে এখানে এমন অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে যা সুইডিশ একাডেমির সদস্যদের গন্ডির বাইরে। শুধু এই কারণেই বর্তমান পরিস্তিতিতে নোবেল পুরুস্কার বলতে আসলে পশ্চিমের লেখকদের ও পূর্বের বিদ্রোহীদের জন্য সংরক্ষিত একটি সন্মান বোঝায়।
দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় একজন কবি নেরুদাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয় নি। পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিলেন ল্যুই আরাগোঁ, যদিও তিনি কখনও বিবেচনায় আসেন নি। পাস্তেরনাককে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, অথচ শোলোকভকে নয়। এর ফলে নোবেল জয়ী একমাত্র সোভিয়েত সাহিত্যকর্মটি বাইরের দেশে প্রচার হবে আর নিজদেশে হয়ে থাকবে নিষিদ্ধ।
আলজেরিয়ার যুদ্ধের সময় যখন আমরা ‘১২১ এর ঘোষণা’তে সই করেছিলাম, সন্দেহ নেই তখন আমাকে নোবেল পুরস্কারটি দেওয়া হলে আমি কৃতজ্ঞচিত্তে পুরস্কারটি গ্রহণ করতাম। কারণ তখন পুরস্কার শুধু আমাকেই সম্মানিত করতো না, বরং যে স্বাধীনতার জন্য আমরা যারা যুদ্ধ করছিলাম তাঁরাও সম্মানিত হতো। কিন্তু পুরস্কারটি আমাকে দেওয়া হলো যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে।
স্বাধীনতা ' শব্দটি এমন একটা শব্দ যা অসংখ্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেকে চিনিয়ে দেয়। পাশ্চাত্যে এর মানে করা হচ্ছে abstract freedom বলে কিন্তু আমার কাছে এর অর্থ আরও বাস্তব স্বাধীনতা। এটা এক জোড়ার চেয়ে বেশি জুতো থাকার স্বাধীনতা এবং খিদে পেলে খাওয়ার অধিকার থাকার স্বাধীনতা।
পুরস্কারটি গ্রহণ করার চেয়ে প্রত্যাখ্যান করাটাই আমার কাছে তুলনামূলক কম বিপদজনক মনে হয়েছে। আমি যদি এই পুরস্কার গ্রহণ করি, তার অর্থ আমি নিজেকে এমন একটা কিছুর সুযোগ দিচ্ছি যেটাকে ‘উদ্দেশ্যমূলক পুনর্বাসন’ বলা যেতে পারে।
ফিগারো লিটারেয়ার পত্রিকাটি লিখেছে, “সার্ত্রের রাজনৈতিক অতীত, যা সমালোচনার উর্দ্ধে নয়, তা নিয়ে আর কোনো কথা নয়, সব এখন হারিয়ে যাবে”। কিছু ডানপন্থী মহল আমার এই পুরস্কারগ্রহণকে কী চোখে দেখবে তা এই বক্তব্যে পরিষ্কার। যদিও আমি মনে করি আমার এই “বিতর্কিত রাজনৈতিক অতীত” এখনো যুক্তিযুক্ত, যদিও কিছু পুরানো ভুলত্রুটি আমার সহযোদ্ধাদের কাছে স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত আমি।
সত্যিই আমি দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার ক্রাউন প্রত্যাখ্যান করছি। পূর্বে হোক কিংম্বা পশ্চিমে হোক, কোন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার একেবারেই নেই। আসলে দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার ক্রাউনের বিনিময়ে ব্যক্তি আমি এমন সব নীতি জলাঞ্জলি দিতে পারি না, যে সব নীতি শুধু ব্যক্তি আমার নয়, আমার সহযোদ্ধাদেরও।
-------------------------------------------------------------------------------
নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের পর জাঁ পল সার্ত্রে ১৯৬৪ সালে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখান থেকে চুম্বকাংশের অনুবাদ

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়