Dr. Aminul Islam

Published:
2020-09-29 16:43:33 BdST

সোনার হরিণ : পর্ব ১৩শুভ বিবাহ পর্ব :মালী শামসুদ্দিনের ঘরে আয়া রোকেয়া খাতুন ঢুকেছিল!


 

ডাঃ সুকুমার সুর রায়

____________________


দক্ষিন দিকের জানালা হাট করে খোলা।
বৈশাখি পুর্নিমার মায়াবী রাতে দখিনা বাতাস খোলা ধানক্ষেতে অপরুপ ঢেউ তুলে দোল খেতে খেতে সামনের আম গাছের কচি আমের সুঘ্রান ছড়িয়ে হু হু করে ঢুকে পড়ছে আমার ঘরে!
অদুরে যমুনা নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ ছন্দময় শব্দ! আর ঝিরিঝিরি প্রান জুড়ানো বাতাসে, বৈশাখের তীব্র গরমেও কখন যেন বিভোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎ দরজায় খট খট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
-- " কে? "
" স্যার, আমি হরলাল পালদালাল।"
" কি ব্যাপার বড়বাবু? এতো রাতে!? "
- " স্যার, একটু কষ্ট করে উঠতে হবে যে!"
হরলাল পালদালাল আমার অফিসের বড়বাবু। একজন অতিব করিৎকর্মা পুরুষ। অফিসের কাজতো বটেই, অফিসের বাইরেও যেকোন কাজ তিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করে থাকেন । এহেন বড়বাবুর ডাকে উঠতে তো হবেই।
বলে রাখা ভালো , আমি তখন চৌহালি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছি !
আগেই বলেছি, জায়গাটা দুর্গম চর এলাকা। নানা রকম বিপদের হাতছানিতো আছেই! এত রাতে আবার হলোটা কি!?
চোখ মুছতে মুছতে ঘড়ি দেখলাম। রাত সাড়ে দশটা। সাড়ে দশটা মানে এখানে গভীর রাত! সভ্যতার মানদণ্ড বিদ্যুৎ তখনো এখানে এসে পৌছায়নি। সন্ধ্যার পরে একটু রাত নামতেই চারিদিকে ঘুটঘুটে আঁধার নেমে আসে! খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া তেমন কিছু করনীয় থাকে না।
জামাটা গায়ে চাপিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে বের হয়ে দেখি কি, শুধু বড়বাবু নয়!
আমার কোয়ার্টারের মেইন গেটের সামনের রাস্তায় অনেক লোক!
অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় অনেকগুলি ছায়ামূর্তি জটলা পাঁকিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে!
ভড়কে গেলাম! না জানি কি হয়েছে!!
দালাল বাবু আমার কাছে এসে বললেন, " স্যার,ন্যাক্কার জনক ঘটনা ঘটে গেছে! "
আমার কোয়াটারের ঠিক পুর্বপাশে নার্স ডরমিটরির দিকে ইংগিত করে, সেদিকে যেতে বললেন!।
আমি জানি নার্স ডরমিটরিতে কোন নার্স থাকেনা। যে কয়জন নার্স আছে তারা সবাই পরিবার নিয়ে ডরমিটরির ঠিক পুর্ব পাশে তৃতীয় শ্রেণীর কোয়াটারে থাকে।
ডরমিটরিতে চারটি রুমে চারজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী থাকে।
" কি হয়েছে কি বড়বাবু? বলেন তো!"
বড় বাবু আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগলো -- " স্যার, মালী শামসুদ্দিনের ঘরে আয়া রোকেয়া খাতুন ঢুকেছিল! টের পেয়ে পাশের রুমের ওয়ার্ডবয় মুছা বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়ে, সবাইকে ডেকে তুলে আমাকে খবর দিয়েছে! এখন আপনি এর একটা বিহিত করেন স্যার, মান সম্মানতো আর অবশিষ্ট থাকলো না স্যার! "
সব ছায়ামূর্তি চারিদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরলো।
ঝারুদার আতাহার বলে উঠলো ,"দুইজনের কঠিন শাস্তি দ্যান স্যার।"
মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট নজরুল বললো, "একটা উপযুক্ত ব্যাবস্থা নেন স্যার, না হলে পরিবার নিয়ে আমরা এখানে থাকতে পারবো না স্যার! "
আমার হয়েছে মুশকিল! সবাই একযোগে স্যারের কাছে তড়িৎ একশন দাবি করছে!।
এদিকে ছুটির দিন বিধায় আমার কলিগ আরো তিনজন মেডিকেল অফিসার বাড়ি চলে গেছে।! যা করার আমাকে একাই করতে হবে। যত্ত সব উটকো ঝামেলা!
হুংকার দিয়ে বললাম, -" কোথায় বদমাশ গুলো?"
মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। কি ব্যবস্থা নেব!?
তারাতো অফিসিয়াল কাজের কোন অপরাধ করে নাই যে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেব!তারা হয়তো অনৈতিক কোন কাজ করেছে, তাও অফিসের বাইরে, অফিস টাইমের বাইরে, তাদের নিজেদের ঘরে।
তাহোক,তবুতো ক্যাম্পাসের ভিতরে! আমার প্রশাসনিক আওতার মধ্যে! ব্যবস্থা একটা নিতেই হবে।কিন্তু কি সেই ব্যবস্থা!? আমি তো গ্রাম্য মাতব্বর নই যে প্যাঁচগোচ দিয়ে একটা সমাধান বের করে ফেলব!
ঘরে ঢুকে দেখলাম রোকেয়া খাতুন মাথা নিচু করে বসে আছে।
" কোথায় শামসুদ্দিন!? "
ওয়ার্ডবয় আজিজ বললো -
" স্যার, বাইরে থেকে দরজা খুলতেই ওতো দৌড়ে পালিয়ে গেছে! "
"রোকেয়া তুমি এখানে কেন? জবাব দাও।"
"ছার, জোতপাড়া হাট থেইক্যা বোয়ালমাছ আনছিলাম, পাক শাক করতি দেরি হয়্যা গ্যাছে, তার পর বোয়্যাল মাছের এল্লা তরকারি বাটিত কইর‍্যা শামসুদ্দিনের জন্যি নিয়্যা আইছি, আর ওমনি মুছা আর আজিজ মিল্ল্যা আমারে আটকাইছে! আমার কি মান ইজ্জৎ নাই ছার! আপনি এগরে বিচার করেন ছার! " বলেই রোকেয়া ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
আমি তড়িঘড়ি একটা সিদ্ধান্ত দিলাম।
দালাল বাবু আর ইনচার্জ সিস্টার নাজমাকে বললাম - " এখনি রোকেয়াকে ওর বাসায় রেখে আসেন।
আগামীকাল অফিস টাইমে বিচার, আচার, শাস্তি,বদলী ,যাহোক একটা কিছু হবে! রাতে কোন কিছু নয়। "
"আর হ্যাঁ , যার যার মত সবাই বাসায় চলে যান। আরো একটা কথা, আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর যাতে দুর্নাম না হয়। বাইরে কেউ কোন আলোচনা করবেন না। যে কোন প্রশাসনিক পদক্ষেপ কাল নেওয়া হবে।"
আমার কথায় কেউ সন্তুষ্ট হলো বলে মনে হলো না। সবাই নগদ নগদ বিচার আচার আশা করছিলো! তবে অফিসারের আদেশ মেনে সবাই ধীর গতিতে যে যার বাসার পথ ধরলো।
আমিও বাসায় এসে শুয়ে পড়লাম।
শুয়েতো পড়লাম, কিন্তু ঘুমতো আসে না!
রোকেয়া নামের মহিলাটি সুন্দরী, বয়স সাতাশ আটাশ হবে। একটি ছেলে আছে প্রাইমারীতে পড়ে। যতদুর জানি, রোকেয়া হয় বিধবা, নয়তো তালাকপ্রাপ্তা কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা।
শামসুদ্দিন ছেলেটা ভালো, বুদ্ধিমান, বিনয়ী,। মালী পদে চাকুরী করলেও শুনেছি সে নাকি জোতপাড়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে। লেখা পড়া জানে বলে বাগান ও অন্যান্য গাছ গাছড়া পরিচর্যার পাশাপাশি তাকে বহিঃবিভাগে টিকেট দেওয়ার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তা সে নিষ্ঠার সাথে পালনও করে।
শামসুদ্দিনের বয়স বাইশ/তেইশ হবে। তার মানে রোকেয়ার চেয়ে কমপক্ষে ৫ বছরের ছোট।
দুই জনের বাড়ি একই এলাকায়, পাবনার সাঁথিয়া থানার পুন্ডুরিয়া এলাকায়।
আচ্ছা! দুইজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকা কি সম্ভব!? হ্যাঁ , খুবই সম্ভব!
একই এলাকায় বাড়ি, আগে থেকেই পরিচয় যোগাযোগ থাকতে পারে! সেটা আরো ঘনিভূত হতে পারে চৌহালির মত উর্বর জায়গায়, যেখানে নদীর ধারে ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ হয়!, দখিনা হাওয়ায় পালতোলা নৌকাগুলি কেমন যেন মনকে উদাস করে দিয়ে দুরান্তে চলে যায়! অফিসের কাজের চাপ খুবই কম, কোথাও বেড়াতে যাওয়ার জায়গা নেই, ঘুরেফিরে নিজেরা নিজেরাই গল্প, আড্ডা, হই চই, পরচর্চা, পরনিন্দা, দুঃখ - সুখের ভাব বিনিময়,আস্তে আস্তে প্রেমে জড়িয়ে পড়া অসম্ভব কিছু নয়!।
আবার এটাওতো হতে পারে, দুইজনের প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক, নির্ভেজাল ভালো সম্পর্ক। যমুনা নদীর স্বাদের বোয়ালমাছ রান্না হবে, আর তার একটা টুকরা ভালো ছেলে, দ্যাশের ছেলে, শামসুদ্দিনের ঘরে দিতে যাওয়া কি খুবই অন্যায় হবে!?
এমনও তো হোতে পারে মুছা আর আজিজ প্রতিহিংসা বশত তাদের এই নির্ভেজাল ভালো একটি সম্পর্ককে সুযোগ বুঝে কালিমা লিপ্ত করতে চেয়েছে!
এই সব সাঁত পাঁচ ভাবতে ভাবতে উদাসী হাওয়ায় ঘুমিয়ে পরেছি।
ঠক্ ঠক্, ঠক্ ঠক্!!
আবার কি হলো! " কে? "
"স্যার, আমি হরলাল পালদালাল।
আবার একটু কষ্ট করে উঠতে হবে স্যার।"
" কেন কি হয়েছে?"
"স্যার, একটু আসেন স্যার, আপনি আমাদের সকলের মুরুব্বি!"
আবার উঠতে হলো, যেতে হলো ।
সবাই হাজির, হাজিরানা মজলিশে কাজি সাহেবও হাজির!
আমি যখন বিছানায় শুয়ে সাত পাঁচ ভাবছিলাম সেই সময়ে তারা শামসুদ্দিনকে খুঁজে বের করেছে! চাঁদা তুলেছে! সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে!
দালাল বাবু বললেন " এই তোমরা স্যারকে সালাম করো , আমাদের সবার মুরুব্বি "।
সিস্টার নাজমা বললেন "স্যার কে মিষ্টি দাও'।"
বর শামসুদ্দিন বললো- " স্যার, সামনের মাসের বেতন পাইয়্যা সবাইরে খাওয়াবানে। "
কনে রোকেয়া খাতুন বল্ল " স্যার, ওর একার বেতন দিয়্যা হবিন্যানে,দুইজনের বেতন একখানে কইরি সবাইকে দাওয়াত দেবানি, সেই সময় কিন্তু স্যার আপনার ছুটিত থাকা চলবিন্যানে। "
মুছা এতক্ষন চুপচাপ ছিলো , সে বললো, " স্যার, আমি কিন্তু ঘটকালী কইরেছি।"
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
রাত তখন ২.০০টা।।।।
( ----------- চলবে -----------)

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়