রাতুল সেন

Published:
2020-07-21 06:36:57 BdST

ভ্যাকসিন দৌড়ে চীনের সিনোভ্যাকই চ্যাম্পিয়ন? না কী আরেকটি গোঁজামিল?



ডেস্ক
_______________

ভ্যাকসিন দৌড়ে চীনের সিনোভ্যাকই চ্যাম্পিয়ন? না কী আরেকটি গোঁজামিল? শিরোনামে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ খোন্দকার মেহেদী আকরাম একটি ভাবনার খোরাক মূলক তাৎপর্যপূর্ণ লেখা লিখেছেন। লেখাটি প্রকাশ হল। তিনি লিখেছেন ,

গত  রোববার ১৯ জুলাই বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (BMRC) চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক কোম্পানীর কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন ‘করোনাভ্যাক’ কে বাংলাদেশে ফেইজ-থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে। আইসিডিডিআরবি’র তদারকিতে ঢাকার ৭ টি সরকারী কোভিড হাসপাতালে এই ভ্যাকসিন ট্রায়াল চালানো হবে।

প্রাথমিক ভাবে এই ট্রায়ালে অন্তর্ভূক্ত করা হবে ৪,২০০ স্বাস্থকর্মীকে। এদের মধ্যে অর্ধেককে অর্থাৎ ২,১০০ জনকে দেয়া হবে দুই ডোজ করোনাভ্যাক ভ্যাকসিন, আর বাকি অর্ধেককে দেয়া হবে ডামি ভ্যাকসিন বা প্ল্যাসিবো (কন্ট্রোল গ্রুপ)। এবছরের নভেম্বরে এই ট্রায়াল শেষ হবে। ট্রায়াল শেষে দেখা হবে ভ্যাকসিনটা আসলেই করোনা ইনফেকশন প্রতিরোধ করতে পারে কী না। আরো দেখা হবে যে এই ভ্যাকসিনটা বিভিন্ন বয়সের মানুষের উপর কতটা নিরাপদ।

বাংলাদেশের আগে, এই মাসের শুরুতে সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে ব্রাজিলে। ওখানে একটি বেসরকারি কোম্পানী এই ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে এবং ট্রায়াল পরিচালনা করবে। এই ট্রায়ালে অন্তর্ভূক্ত করা হবে ব্রাজিলের বিভিন্ন শহরের ১২ টি কোভিড হাসপাতালের মোট ৯,০০০ স্বস্থকর্মীকে যারা কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত। এদের অর্ধেককে দেয়া হবে ভ্যাকসিন আর বাকি অর্ধেককে দেয়া প্ল্যাসিবো।

ব্রাজিল, ভারত এবং বাংলাদেশ এখন ভ্যাকসিনের ফেইজ-থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য স্বর্গ! ভ্যাকসিনের ফেইজ-থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য দরকার ভাইরাসের চলমান তীব্র সংক্রমণ। চীনে এখন করোনা সংক্রমণ এতই কম যে ওখানে তারা তাদের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে পারছে না। আর একারনেই ফেইজ-থ্রি ট্রায়ালের জন্য তারা ঝুঁকেছে বাংলাদেশ এবং ব্রাজিলের মত দেশে। ঠিক এই একই কারনে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তাদের করোনা ভ্যাকসিনের ফেইজ-থ্রি ট্রায়াল চালাচ্ছে ব্রাজিল এবং দক্ষিন আফ্রিকাতে।

ভ্যাকসিন দৌড়ে সবচেয়ে আগানো অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন। তারা ফেইজ-থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে জুনের শেষে। ঠিক ঐ সময়টাতে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার অত্যাধিক বেশী ছিল। আমার ধারনা, বাংলাদেশ যদি তখন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাথে যোগাযোগ করতো তাহলে হয়তো আমরা অরো আগেই ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে পারতাম। আমার বিশ্বাস অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন চীনের ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশী কর্যকরী এবং নিরাপদ হবে। এ কথাটি আমি কয়েকদিন আগে চ্যানেল ২৪ এর একটা প্রোগ্রামে বলেছিলাম।

এখন পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে মোট ১২৫ টি কোম্পানী করোনা ভ্যাকসিন তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছে। তার ভেতর বেশীর ভাগ ভ্যাকসিনই রয়েছে লাবরেটরী পর্যায়ে। অক্সফোর্ড এবং সিনোভ্যাক এই দুটি ভ্যাকসিনই ফেইজ-থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে পেরেছে। আমেরিকার মর্ডানা তাদের এম.আর.এন.এ ভ্যাকসিনটির ফেইজ-থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করবে এ মাসের শেষে। জার্মানের ফাইজার কোম্পানিও তাদের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করবে শীঘ্রই। আরেকটি চায়না ভ্যাকসিন ‘ক্যানসিনো’ ফেইজ-থ্রি ট্রায়াল না করেই তা প্রয়োগ করা শুরু করেছে তাদের আর্মিদের উপরে!

কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিস্কারে সফলতার হার মাত্র শতকরা ৬ ভাগ। উপরে আমি ৫ টা ভ্যাকসিনের নাম করেছি। সাথে যদি ইমপেরিয়াল কলেজের ভ্যাকসিন আর রাশিয়ার ভ্যাকসিনের নাম যোগ করি তাহলে সম্ভাব্য করোনা ভ্যাকসিনের সংখ্যা দড়ায় সাতটি। ১২৫ এর ৬% তো প্রায় ৭ টি ই! অর্থাৎ উপরের ভ্যাকসিনগুলো ছাড়া আর নতুন কোন ভ্যাকসিনের সম্ভবনা নাই বল্লেই চলে। এই হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে চীনা ভ্যাকসিনের আগমনকে স্বাগত জানাতেই হয়!

সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটি হল নিস্ক্রিয় বা ইন্যাক্টিভেটেড করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনটি তৈরী করা হয় করোনা ভাইরাসকে রাসায়নিক ভাবে নিস্ক্রিয় করার মাধ্যমে। বস্তুত ভ্যাকসিন উৎপাদনে এই পদ্ধতিটিই সবচেয়ে সনাতন। পোলিও, ইনফ্লুয়েন্জা ইত্যাদির ভ্যাকসিনও এই পদ্ধতিতে তৈরী করা হয়। অন্যদিকে অক্সফোর্ডের অ্যাডিনোভাইরাস ভ্যাকসিন বা মর্ডানার এম.আর.এন.এ ভ্যাকসিন সবই নতুন পদ্ধতির ভ্যাকসিন। এই পদ্ধতিতে এর আগে কখনও ভ্যাকসিন বাজারজাত করা হয় নাই।

সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটি কী কার্যকরী? এটা কী আমাদের জন্য নিরাপদ? তাদের ল্যাবরেটরী পরীক্ষার ফলাফল কী? ফেইজ-ওয়ান এবং ফেইজ-টু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল কী? এসব ফলাফল কী তারা প্রকাশ করেছে?

ফেইজ-থ্রি ট্রায়ালের আগে এসব প্রশ্নের উত্তর জানা খুবই জরুরী। অনিরাপদ ভ্যাকসিন ভালোর চেয়ে খারপই করে বেশী। আবার অকার্যকর ভ্যাকসিন রোগের প্রকোপ বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত, বিএমআরসির (BMRC) বিশেষজ্ঞগন ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমতি দেয়ার আগে এসব ব্যাপার পুংখানুপুংখ ভাবে যাচাই বাছাই করে দেখেছেন এবং সিনোভ্যাকের গবেষনার ফলাফলে তারা সন্তষ্ট হয়েছেন।

সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিন প্রকল্প শুরু করে জানুয়ারীর শেষ ভাগে। তারা ভেরোসেল ব্যাবহার করে কালচার পদ্ধতির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস উৎপাদন করে ল্যাবরেটরীতে। উৎপাদিত ভাইরাসকে তারা পরিশোধণ করে ফিল্ট্রেশনের মাধ্যমে। পরিশোধিত করোনা ভাইরাসকে তারা এক ধরনের কেমিকেল দিয়ে নিস্ক্রিয় করে ফেলে। এই নিস্ক্রিয় ভাইরাসের সাথে মিশ্রিত করা হয় অ্যালুমিনিয়াম অ্যাডজুভেন্ট। অ্যাডজুভেন্ট ছাড়া এধরনের ভ্যাকসিন শরীরে ইমিউন রেসপন্স করেনা। এভাবেই তারা তৈরী করে ভ্যাকসিনটি। এর পর এই ভ্যাকসিন তারা প্রয়োগ করে ইঁদুর এবং বানরের উপর। ২ সপ্তাহ অন্তর ২ টি ডোজ প্রয়োগ করা হয়। দুটি ডোজ দেয়ার পর দেখা যায় ১৪ দিন পরে ইঁদুর এবং বানরের রক্তে পর্যাপ্ত পরিমান এন্টিবডি তৈরী হয়েছে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে। এর পর তারা ভ্যাকসিন দেয়া বানরের ফুসফুসে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে দেখতে পান যে ভ্যাকসিন দেয়া বানরগুলে করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্ত। এ সবই খুব আশাব্যঞ্জক ফলাফল। এই ফলাফল তারা প্রকাশ করে বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়ীকি ‘সাইন্স’ এ এপ্রিল মাসে। এ পর্যন্ত সিনোভ্যাকের কর্যক্রম পরিস্কার এবং স্বচ্ছ।

এরপর তারা শুরু করে মানুষের উপর ফেইজ-ওয়ান এবং ফেইজ-টু ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এই ট্রায়াল দুটো ভ্যাকসিন তৈরীতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ট্রায়াল দুটো থেকেই জানা যায় নতুন ভ্যাকসিনটি কতটুকু নিরাপদ এবং কতটুকু কার্যকরী হতে পারে। তারা দুটো ট্রায়ালই এক সাথে শুরু করে। ফেইজ-ওয়ান ট্রায়ালে তারা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে ১৪৩ জনের উপর এবং ফেইজ-টু তে ৬০০ জনের উপর। এবং ট্রায়াল শেষে জুনে তারা বিবৃতি দেয় যে তাদের ভ্যাকসিন মানব শরীরে তেমন কোন খারাপ প্রভাব ফেলেনি, এবং তাদের ভ্যাকসিন ৯০% ভ্যাকসিন গ্রহিতার শরীরে পর্যাপ্ত এন্টিবডি তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। এতটুকুই আমরা জানি। তারা তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল এখনও কোন জার্নালে প্রকাশ করেনি। এমনকি কোন প্রি-প্রিন্টেও তাদের এই ফলাফল প্রকাশ করেনি। অবশ্য তারা বলেছে তারা তাদের রেজাল্ট প্রকাশ করবে।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা একটা ব্যাপারে এক মত হয়েছেন যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পরে রক্তে তৈরী হওয়া এন্টিবডি খুব তারাতারি কয়েক মাসের ভেতরেই নিঃশেষ হয়ে যায়। আর এ কারনেই করোনা ভাইরাসের বিপরীতে ইমিউনিটি তৈরী করতে হলে শরীরে মেমোরী টি-সেল এবং মেমোরী বি-সেল তৈরী হওয়া জরুরী। ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরে শরীরে এন্টিবডি ছাড়াও যদি টি-সেল রেসপন্স ঘটে থাকে তাহলে অনেকটা বলা যায় যে অ্যাডাপটিভ ইমিউনিটি কার্যকরী হয়েছে এবং ভ্যাকসিনটি হয়তো রোগপ্রতিরোধক হবে। সিনোভ্যাক তাদের কোন বিবৃতিতে তাদের ভ্যাকসিনের টি-সেল রেসপন্সের কথা উল্লেখ করে নি। তারা শুধু বলেছে যে তাদের ভ্যাকসিন মানবদেহে এন্টিবডি তৈরী করতে সক্ষম। তবে তৈরী হওয়া এন্টিবডির টাইটার সম্পর্কেও তারা কোন ধারনা দেয় নি! এ বিষয়গুলো জানাটা খুবই জরুরী।

চীনের আরেকটি ভ্যাকসিন ‘ক্যানসিনো’, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন এবং মর্ডানার ভ্যাকসিন কিন্তু তাদের ভ্যাকসিনের প্রাথমিক মানব-ট্রায়ালের রিপোর্ট বিখ্যাত জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশ করেছে। এবং দেখিয়েছে যে তাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন মানবদেহে পর্যাপ্ত এন্টিবডি তৈরী করতে পারে এবং কার্যকরী টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে পারে।

আশাকরি বিএমআরসি সিনোভ্যাকের অপ্রকাশিত ফলাফল ভালভাবে যাচাই করেছেন। করোনার ক্ষেত্রে একটা ভ্যাকসিন যদি টি-সেল রেসপন্স না করে তাহলে সেই ভ্যাকসিনের কার্কারীতা ৩ মাসের বেশী থাকার কথা নয়।

করোনাতে মৃত্যুহার বাংলাদেশে মাত্র ১.৫% ভাগ। এ ধরনের রোগের প্রতিরোধে ভ্যাকসিন ট্রায়ালে তরিঘরি করার কিছু নেই। মৃত্যুহার যদি ইবোলা ভাইরাসের মত ৫০-৬০% হত তাহলে ঝুঁকি নিয়ে যে কোন ভ্যাকসিন ট্রায়ালে করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে।

বাংলাদেশে প্রথম ভ্যাকসিনের টিকাটি দেয়ার আগে আমরা জানতে চাই সিনোভ্যাকের ফেইজ-ওয়ান এবং ফেইজ-টু হিউম্যান ট্রায়ালের ফলাফল। জার্নালে না হোক অন্তত আইসিডিডিআরবির উচিত হবে এর উপরে একটা স্বচ্ছ ব্রিফিং প্রকাশ করা। অস্বচ্ছ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে কোন ধরনের ভ্যাকসিন ট্রায়াল সমীচীন হবে না।

ডঃ খোন্দকার মেহেদী আকরাম,
এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি,
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়