ডাক্তার প্রতিদিন

Published:
2020-07-13 14:43:46 BdST

ফেলুদা, শার্লক হোমস আর স্টোনম্যান



প্রলয় বসু
কথাশিল্পী ও লোকসেবী চিকিৎসক , কলকাতা
___________________

ফেলুদা ধপ্ করে একটা শব্দে বইটা বন্ধ করে, নীচু টেবিলটার উপরে রাখা ডান পায়ের উপরে বাঁ পাটা লম্বা করে তুলে, তুড়ি মেরে সিগারেটের ছাইটা ছাইদানিতে ফেলে বললো, "শার্লক হোমস।"

ফেলুদা এতক্ষণে ধরে দুটো বই প্রায় একসাথে পড়েছিল। দুমাস আগে বিহারের শিমূলতলায় একটা খুনের ব্যাপারে অপরাধীকে জুতোর সাইজের গোলমালের সাহায্যে ধরে দিয়ে, বেশ মোটা রোজগার করে বসে আছে। ওর এখন যা পারিশ্রমিক তাতে মাসে একটা কেস হলেই চলে যায়। যদিও গত দুমাসের মধ্যে ফেলুদা কোন কেস নেয়নি। গত দুমাসে ও অনেক বই পড়েছে। যার অধিকাংশই ডিটেকটিভ গল্প, বাংলা এবং বিলিতি, দুই ভাষাতেই। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছে। খাতা কলম নিয়ে বসে পড়াশুনো করেছে। বই থেকে পড়ে রীতিমতো নোট করে রেখেছে। লেখালেখি করেছে। কয়েকটা মাসিক পত্রিকায় লেখা ছাপাও হয়েছে। তিন বার বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, চুল ছাঁটতে। একদিন নিউ মার্কেটে গিয়ে কয়েকটা সিরাপ কিনে এনেছে। আর দুবার সিধু জ্যাঠার বাড়িতে গিয়েছে, বইয়ের জন্যে। সিগারেট খাওয়া কমিয়েছে, দশটার থেকে আটটায় নেমেছে আর খাবার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছে।

আজ রবিবার, ৩ জুন, সকাল সাড়ে নটা। গরমের ছুটি চলছে। বাবা যথারীতি সুবিমলকাকুর বাড়িতে তাস খেলতে গেছে। আমি আমাদের বৈঠকখানার তক্তপোশে বসে, আমাদের বাড়ির চিলেকোঠায় পরে থাকা এক গাদা পুরনো চিঠি থেকে, নেপালের স্ট্যাম্প খুঁজে আমার ডাকটিকিটের খাতায় আটকাচ্ছি। ফেলুদা একটা সোফায় বসে আছে। বই দুটোই খবরের কাগজের মলাট দেওয়া, তাই নাম গুলো পড়তে পারিনি। আমি প্রশ্ন করলাম "তুমি বুঝি এতক্ষণ শার্লক হোমসের কোন গল্প পড়ছিলে?"

ফেলুদা চারমিনারটা থেকে পরপর দুটো ধোঁয়ার রিং ছেড়ে, চোখ বুঁজে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে বললো, "কলকাতায় শার্লক হোমসের নামে একটা ক্লাব ছিল জানিস?" আমি জানতাম না।
কিন্তু আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফেলুদা বলে চললো, "১৯৮৩ সালে সৃষ্টি হলো একটা ক্লাব। বারোয়ারি পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠানের জন্যে অথবা বসে আঁকো প্রতিযোগিতা আর অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্যে না। বরং এই ক্লাবটি সৃষ্টি হলো বাঙালিদের মধ্যে আরো গোয়েন্দা গল্পের চর্চার জন্যে। শার্লক হোমস এবং পৃথিবীর আরো সমস্ত বিখ্যাত গোয়েন্দাদের নিয়ে চর্চা করার জন্যে। ভাবতে পারছিস গোয়েন্দা চর্চার জন্যে ক্লাব? অবাক হলেও কিন্তু এটাই সত্যি। আর নামকরণের জন্যে বেছে নেওয়া হল এমন একটি নাম যিনি সব গোয়েন্দাদের প্রতীক। শার্লক হোমস। অধিকাংশ বাঙালী তাঁর গল্প না পড়ে থাকলেও, নামটা অন্তত শুনেছেন। তাই সংঘের নাম হলো 'হোমসিয়ানা'। সুকুমার সেন, প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, সন্তোষ কুমার ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমরেশ বসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়, বাদল বসু, দেবীপদ ভট্টাচার্য, অরুণ কুমার মিত্র, দিলীপ কুমার বিশ্বাস প্রমুখ ছিলেন সেই ক্লাবের সদস্য। চলতো, নিয়মিত গোয়েন্দা গল্প পাঠ এবং তার পর্যালোচনা।"

আমি অবাক হয়ে বললাম, "ক্লাবের নাম 'হোমসিয়ানা' ছিল?"

ফেলুদা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললো, "শোন, ‘হোমসিয়ানা’ নামকরণের কারণ ব্যাখ্যার জন্যে সুকুমার সেন একটা ছড়ায় এর রহস্যভেদ করেছেন
"...মানবজ্ঞানের কৌতূহলী/
শার্লক হোমসের চেলা/
হোমসিয়ানা নাম দিয়ে তাই/
বন্ধু পাঁচের খেলা।”

'হোমসিয়ানা' নামকরণের আরো একটা ব্যাখ্যা আছে অবশ্য। একাধারে হোমস আর 'রামসিয়ানা' দুয়ে মিলে 'হোমসিয়ানা'। 'রামসিয়ানা' কে যদি রাম সেয়ানা বা অতি চালাক, ধূর্ত ভেবে থাকিস, তাহলে কিছু ভুল ভাবিসনি। ঠিকই ধরেছিস। আর একটু শোন, 'রামসিয়ানা' নামে একটা ঠগী সম্প্রদায় ছিল। তাই, 'হোমসিয়ানা' নামের মধ্যে মিশে আছে হোমসের মতো শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দার নাম, আবার অন্যদিকে ঠক বা অপরাধী সম্প্রদায়ের নাম। এহেন ক্লাবের প্রথম বৈঠক ছিলো, ১৯৮৩ সালের ২৭ শে আগস্ট, শনিবার। তোর মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে কেন সেই দিন? তারও উত্তর দিয়েছেন সুকুমার সেন। ১৯৮৩ সালের ২৭ আগস্ট ছিল, নষ্ট চন্দ্রের তিথি। তাই শুভ লগ্ন। প্রশ্ন করবি, কেন শুভ লগ্ন? তার উত্তরে বলবো, নষ্ট চন্দ্র নাকি চোরেদের দিন (রাত)। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নাকি সেই দিনেই 'চৌর্যবৃত্তি' তে নেমেছিলেন। সুতরাং যারা গোয়েন্দা হয়ে চোরদের তাড়া করবেন, তাঁরা তো সেই দিনটাকে বাছবেনই।
আরো আছে, বাংলা ভাষায় প্রথম বারোয়ারি গোয়েন্দা উপন্যাস 'পাঞ্চজন্য' এই হোমসিয়ানা সংঘের ফসল। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। শার্লক হোমসের প্রকাশিত হবার শতবর্ষের, হোমসিয়ানার শ্রদ্ধাঞ্জলি ছিল 'পাঞ্চজন্য'। আর শার্লক হোমস যে ১৮৮৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই তোর মতো উজবুককেও মনে করিয়ে দিতে হবে না। সেই উপন্যাসের লেখকদের তালিকায় ছিলেন সুকুমার সেন, সমরেশ বসু, আনন্দ বাগচী, রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়, সুভদ্র কুমার সেন। তবে এরপরে, সমরেশ বসুকে দিয়ে শুরু করে, সদস্যেদের একের পর এক মৃত্যু এই ক্লাবকে বেশী দিন সচল থাকতে দেয়নি।"

আমি যদিও উজবুক না, তবু ফেলুদার কোন কথাই আমার খারাপ লাগে না। আসলে আমার এই খুড়তুতো দাদাটির সব কথাই আমার ভালো লাগে। ফেলুদার মুখে শার্লক হোমস সম্বন্ধে এতো কথা শুনেছি যে, এই নামটা শুনলেই চোখের সামনে কতো গুলো শব্দ চারিদিকে ভেসে ওঠে।
ফেল্ট হ্যাট, মুখে পাইপ, কোকেনের নেশা আছে, ভাবুক, দারুন ভায়োলিন বাজাতে পারেন, গন্ধ শুঁকে তামাকের জাত বলে দিতে পারেন, কল্পনাপ্রবণ, রোগা-লম্বা, স্বভাবে বোহেমিয়ান, থাকেন নিজের খেয়ালে, রসায়ন বিজ্ঞানে পারদর্শী, প্রায় নির্ভুল অনুমান ক্ষমতা, অপরিচ্ছন্ন, অবিবাহিত, পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণী ক্ষমতা অপরিসীম, হৃদয়বান। হোমসের বাড়ির ঠিকানা, ২২১/বি বেকার স্ট্রিট। আর মনে পড়ে কতো গুলো মুখ, তাঁর সহকারী ডঃ ওয়াটসন, বাড়িওয়ালি মিসেস হাডসন, তাঁর দাদা মাইক্রফট হোমস, তাঁর থেকেও বেশী বুদ্ধিমান, তবে ভীষণ কুঁড়ে আর তাঁর সবচেয়ে সাংঘাতিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রফেসর জেমস মরিয়ার্টি।

ফেলুদার মুখেই শুনেছি, যদিও, প্রথম হোমসের গল্প লেখা হয় ১৮৮৭ সালে, তবু কাহিনী অনুসারে হোমস ওই বাড়িতে ১৮৮১ সাল থেকে ১৯০৩ অবধি ছিলেন। আরো একটা মজার জিনিস আছে, হোমসকে নিয়ে কোনান ডয়েল ১৮৮৭ থেকে ১৯২৭ সাল অবধি লিখলেও, গল্প অনুযায়ী হোমসের সময়কাল ছিল ১৮৭৮ থেকে ১৯০৭ সাল, আর একেবারে শেষ ঘটনাটি ১৯১৪ সালের। এটাও শুনেছি যে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল (১৮৫৯–১৯৩০), এডগার অ্যালান পো আর এমিল গাবরিওর লেখা পড়েই গোয়েন্দা গল্প লেখার প্রেরণা পেয়েছিলেন। শার্লক হোমস চরিত্রটাই উনি নাকি সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁর ডাক্তারি পড়ার সময়ে দেখা শিক্ষক ডঃ জোসেফ বেলের আদলে। ডঃ বেলের চমৎকারী পর্যবেক্ষণ দেখে, এই চরিত্রটাকে সেই ভাবেই গড়তে চেয়েছিলেন। ফেলুদা বলছিল, "কিন্তু এর পরেও তৈরী হয়েছে আরো অনেক ক্লাব, সোসাইটি। শার্লক হোমসের কাজ নিয়ে, শার্লক হোমসকে নিয়ে আলোচনা করার জন্যে, গবেষণা করার জন্যে। থেমে নেই। চলছে। হোমসের প্রতি অনুরাগ বাঙালীর কখনো যাবার নয়।"

ফেলুদাকে এখানে থামতে হলো, কারণ বাইরে একটা ট্যাক্সি থামার আওয়াজ এলো আর তার আধ মিনিটের মধ্যেই কলিং বেলটা পরপর দুবার বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখি প্রখ্যাত রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজের লেখক লালমোহনবাবু ওরফে জটায়ু এসেছেন। বাইরে সবুজ অ্যাম্বাসাডরটা না দেখতে পেয়ে, একটু ভুরু কুঁচকে চাইতেই উনি বললেন, "ওটা সার্ভিসিং এর জন্যে গ্যারেজে। কিন্তু আমি আর না থাকতে পেরে চলেই এলাম।" পকেট থেকে একটা নীল রঙের রুমাল বের করে, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন। লালমোহনবাবু থাকেন গড়পারে, লেখার জন্যে ব্যস্ত না থাকলে প্রায় প্রতি রবিবারেই চলে আসেন আমাদের বাড়িতে গল্পগুজব করতে। ওনার মুখের চওড়া হাসি দেখেই বুঝেছিলাম সুখবর। তবে সেটার কারণ বুঝতে পারিনি।

ফেলুদা লালমোহনবাবুকে দেখেই বললো, "সুখবর যে বুঝতেই পারছি। নতুন ব্লেড দিয়ে কাঁটা ক্লিন শেভড গাল, ওল্ড-স্পাইস কোলনের সুগন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। পরপর দুবার কলিং বেলের আওয়াজেই বুঝতে পেরেছিলাম, কোন একটা সংবাদ জানাতে আপনি ব্যাগ্র। তবে সেটা সুসংবাদ না দুঃসংবাদ বুঝিনি, এখন আপনার মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে সুখবর। আর আপনি সাধারণত নটা নাগাদ আসেন, কিন্তু এখন দশটা বাজতে চৌদ্দ মিনিট বাকি। সুতরাং আপনি বাড়িতে কোন কারণে আজ অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষা করতে গিয়েই আপনার দেরী হয়েছে। আপনি যখন অপেক্ষা করছিলেন তখন নখ কাটছিলেন। আপনার ডান হাতের সব কটা নখ সমান করে কাঁটা অথচ বাম হাতের কড়ে আর তার পাশের আঙুলে এখনো নখ লেগে আছে। অর্থাৎ খবরটা পেয়েই আপনি তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছেন।" ফেলুদার এরকম পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে যাই। একঝলক দেখেই ও মানুষের ছোটখাট এই পরিবর্তন গুলো লক্ষ্য করে নিতে পারে আর সেই মানুষটা সম্পর্কে অনেক তথ্য বলে দিতে পারে। আমি খালি লালমোহনবাবুর মুখের হাসিটাই লক্ষ্য করেছিলাম, কিন্তু ও সেখানে সব কিছুর নজর করেছে।

খানিকটা অবাক হলেও, ফেলুদার কথায় লালমোহনবাবুর মুখের হাসিটা গেলো না। সোফায় বসতে বসতে বললেন, "ইনক্রেবিডেল ব্যপার মশাই।" ভদ্রলোকের ইংরেজিটা শুধরে দেবার আগেই দেখি, পাঞ্জাবির পকেট হাতড়িয়ে কিছু একটা খুঁজছেন মনে হলো। আর সেটা না পেয়ে খানিকটা বিরক্ত হলেও মুখের হাসিটা ঠিক ধরে রাখলেন। ফেলুদা ওনার দিকে তাকিয়ে বললো, "আপনি যেটা খুঁজছেন সেটা ওই চেয়ারের পায়ায় লটকে আছে। ঘরে ঢুকে রুমাল বের করার সঙ্গে সঙ্গেই ওটা বেরিয়ে এসেছে আপনার পকেট থেকে।" কাগজটা তুলে নিয়ে দেখলাম, লেখা আছে "সেন্ডিং ফাইভ টুমরো মর্নিং। সোল্ড ফোর থাউজেন্ড কপি ইন থ্রি উইকস্"। তারিখটা দেখলাম আজকের। এবার বুঝতে পারলাম প্রকাশক নোটটি পাঠিয়েছেন আজ সকালে, আর এই চিঠির অপেক্ষা করতে গিয়েই আজ আমাদের বাড়ি আসতে দেরি করেছেন ভদ্রলোক। ফাইভ মানে যে পাঁচ হাজার টাকা, সেটাও বুঝতে পারলাম। লালমোহনবাবু বলে উঠলেন, "সেলিং লাইক পান্না'স সুইটস্।" সম্প্রতি উনি বেহালার পান্না সুইটস্ এর মিষ্টি খেয়েছেন। তারপর থেকে ওনার ধারনা হয়েছে, পান্না সুইটসের মতো আর মিষ্টির দোকান ভূভারতে নেই। অবশ্য আমাদেরও উনি সেখাকার মিষ্টি খাইয়েছেন। এবং ফেলুদাকে বেশ তৃপ্তি করে খেতে দেখে বুঝেছি, ফেলুদাও লালমোহনবাবুর সাথে এ ব্যাপারে সহমত।

এতক্ষণে লালমোহনবাবুর মুখের হাসির কারণটা পরিষ্কার হলো। গত বৈশাখ মাসে ওনার 'হায়নার হুঙ্কার' বইটি বেরিয়েছে। এই বইয়ে প্রখর রুদ্রকে একটা কুড়ি ফুট লম্বা হায়নার সাথে লড়াই করতে হয়েছে। লালমোহনবাবু বলেছিলেন এই হায়নার আইডিয়াটা উনি স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা 'হাউন্ড অফ বাস্কারভিল' এর হাউন্ড কুকুরের থেকে পেয়েছেন। আমি জানি সেই কারণেই এই বইটা উনি 'স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে' উৎসর্গ করেছেন। যদিও এই গল্পটা বেশ জমেছিল, তবু সেই বই তিন সপ্তাহের মধ্যে চা-র হা-জা-র কপি বিক্রি হয়েছে শুনে বেশ অবাকই হলাম।

লালমোহনবাবু আবার বললেন, "শার্লক হোমসের এ হেন মহিমা হবে কে জানতো বলুন তো? তবে আমার মতো করে বোধহয় শার্লক হোমসকে কেউ বাংলা ভাষায় ব্যবহার করেননি, কি বলে ফেলুবাবু? জয়তু কোনান ডয়েল, জয়তু শার্লক হোমস।"
আমি কোনক্রমে হাসি চেপে রাখলেও, ফেলুদা বললো, "এ তো ভক্তিরস হয়ে যাচ্ছে। আপনার তো ওতে কাজ হবে না। আপনার তো চাই শক্তিরস।" ভদ্রলোক হেঁ হেঁ করে হেসে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ফেলুদা বলে উঠলো, "শুধু আপনি নন লালমোহনবাবু, আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসকে, কে যে, কবে বাংলা সাহিত্যে টোকেনি, সেটাই রহস্য। অবশ্য শুধু বাংলা সাহিত্যের বলি কেন, বহু বিদেশী সাহিত্যই শার্লক হোমসের আদলে গড়ে উঠেছিল। আমাদের দেশের সাহিত্যের কথা বলার আগে, যদি ইয়োরোপ-আমেরিকার মাটিতে শার্লক হোমসের প্রভাব কি হয়েছিল বলি তাহলেই আপনার মাথা বনবন্ করে ঘুরবে। প্রভাব দুরকম ভাবে পড়েছিল।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম ধরনে, শার্লক হোমসের পথ আঁকড়ে, পথ অনুসরণ করে। আবার কেউ কেউ সেই পথেই চলে আর একটু নতুনত্ব আনার চেষ্টা করার কথা ভেবেছিলেন। রিচার্ড অস্টিন ফ্রিম্যানের (১৮৬২-১৯৪৩) কথা শুনুন বলি। উনিও যে শার্লক হোমসের লেখাতে থেকে প্রভাবিত হয়েছিলেন তা অনস্বীকার্য। তবে উনি কেবল অনুপ্রাণিত না হয়ে, শার্লক হোমসের ধারাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুজনের মধ্যে অসংখ্য মিল। আবার অমিল আছে, তবে কম। দুজন বলতে একদিকে শার্লক হোমসের সাথে রিচার্ড অস্টিন ফ্রিম্যানের ডিটেকটিভ থার্নডাইকের আবার কোনান ডয়েলের সাথে রিচার্ড ফ্রিম্যানের। কোনান ডয়েলের মতো অস্টিন ফ্রিম্যানও ছিলেন একজন ডাক্তার। দুজনেই যে প্রতিভাবান গোয়েন্দার গোয়েন্দার জন্ম দিয়েছিলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা তীক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসু এবং বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে নেন। এবং দুজনেই ছাত্রাবস্থায় এমন শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছেন, যাদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, তাদের গোয়েন্দাকে প্রভাবিত করেছে। শার্লক হোমসের ক্ষেত্রে আর্থার কোনান ডয়েলের শিক্ষক ডঃ বেলের ভূমিকা যেমন সবাই জানে, ফ্রিম্যানের ডঃ থর্নডাইকের উপরেও, তাঁর শিক্ষক 'তীক্ষ্মদর্শী এবং বিশ্লেষণকারী' ডঃ টেলর একই রকম প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ফ্রিম্যানের সৃষ্টি ডঃ জন থর্নডাইক, শার্লক হোমসের মতোই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমস্ত সমস্যার সমাধানের পথে হেঁটে ছিলেন। তবে এই দুজনের যে পার্থক্যটা সবচেয়ে বেশী 'চোখে পড়ে' সেটাই বলি। শার্লক হোমসের বিশ্লেষণ অনেকটাই মনের মধ্যে, মাথার ভেতরে, যা আমাদের চোখের দৃষ্টির বাইরে। কিন্তু ডঃ জন থার্নডাইকের বিশ্লেষণ পাঠকের সামনে, চোখের উপর, চোখে পড়ে, সকলেই জানতে পারে। তবে, ফ্রিম্যানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তাঁর গোয়েন্দা সৃষ্টির মধ্যে না। তার গোয়েন্দা গল্পের লেখার কৌশলের মধ্যে। গল্পের বর্ণনায়। যা গোয়েন্দা গল্পের ক্ষেত্রে নতুনত্ব।

গোয়েন্দা গল্পে গোয়েন্দার প্রবেশের আগেই ঘটে যায়, অপরাধ। অর্থাৎ গোয়েন্দা যখন প্রবেশ করে, অপরাধ তখন 'হয়ে গেছে'। তাই গল্পে গোয়েন্দা 'আসার পর' গল্পের মধ্যেই আবার অপরাধের ঘটনা পর্যন্ত পিছু হটতে হয়, অপরাধের কারণ জানতে, পিছিয়ে যেতে হয়। এতে গল্পের স্বাভাবিক অভিমুখের বিপরীতে আবার যেতে হতো। গল্পের মূল স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আবার সামনে এগোতে হয় সমাধানের উদ্দেশ্যে। গোয়েন্দা গল্পের এই চিরাচরিত পদ্ধতির বাইরে বেরিয়ে এসে, ফ্রিম্যান এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করেছিলেন। গোয়েন্দার উপস্থিতিতেই, অপরাধ সংঘটিত করলেন। অবশ্যই গোয়েন্দার অগোচরে। এতে গল্পের স্বাভাবিক অভিমুখের বিপরীতে আবার যেতে দরকার পরে না। তবে গোয়েন্দাকে ঘটনার কাটাছেঁড়া করার জন্যে, 'ছানবিন' করতে একটু পিছন ফিরে তাকাতে হয়। এই অভিনব প্রয়াস রীতিমত সাড়া জাগিয়ে তুলছিল। এই পদ্ধতিকে গবেষক এবং বিশেষজ্ঞেরা নাম দিলেন 'উল্টো রীতি'। রিচার্ড ফ্রিম্যান কেবলমাত্র এই 'উল্টো রীতি'র কারণেই গোয়েন্দা গল্পের ইতিহাসে চিরস্থায়ী থাকবেন। বাংলাতেও এই রকম ভাবে গোয়েন্দা গল্প এরপর লেখা হয়েছে বহু। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশের বেশ কয়েকটা গল্পের মধ্যেই এমনটা দেখা গেছে।

এবার বরং প্রভাবের দ্বিতীয় ধাপের কথা বলি। দু-চারটে নাম বলছি, দেখুন তো চিনতে পারেন কি না?
আর্থার মরিসনের গোয়েন্দা মার্টিন হিউয়েট,
আর্নেস্ট ব্রামার গোয়েন্দা ম্যাক্স ক্যারাডস,
এডমন্ড ক্লোরিহিউ বেন্টলির গোয়েন্দা ট্রেন্ট,
ফ্রিম্যান ক্রফ্টস্ এর গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর ফ্রেঞ্চ,
জ্যাক ফুত্রেলের গোয়েন্দা প্রফেসর ভ্যান ডুসেন,
আর্থার বি রীভের গোয়েন্দা ক্রেগ কেনেডি,
এদের মধ্যে মিলটা কোথায় বলুন দেখি?
এরা সকলেই শার্লক হোমসের সমসাময়িক। এছাড়া?"

বড্ড বড়ো হয়ে গেছে লেখাটা, তাই চার পর্বে শেষ করবো।
এরপর দ্বিতীয় পর্ব কদিন পরে।

(প্রসঙ্গত ৭ জুলাই ছিল স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের মৃত্যু দিন। সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।)

 

______________________________

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়