SAHA ANTOR

Published:
2020-07-06 18:34:20 BdST

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলে মাস্টারদার সহযোদ্ধা সুরেশ দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “শ্রীলেদার্স”




ডেস্ক: তথ্যযোগ :-অভীক মণ্ডল ও ডা. সুবোধ ঘোষ
_____________________

দিনটি ছিল ১৮ এপ্রিল, ১৯৩০ | সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে মাত্র ৬৫ জন যুবকের একটি দল পরাক্রমশালী ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে চট্টগ্রামকে স্বাধীন করার অসম্ভব এক স্বপ্ন বুকে লড়াইয়ে নেমেছিল সেদিন। এ বিপ্লব নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা ব্রিটিশ রাজকেই। বিপ্লবীরা ব্রিটিশদের হাত থেকে দখল করে নিয়েছিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার | অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহের পর জেনারেল লোকনাথ বলের আদেশ শোনা গেল “সেট দ্য আর্মারী অন ফায়ার”। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল গোটা অস্ত্রাগার। সাথে সাথে সমবেত কণ্ঠের জয়ধ্বনি “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”, “সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক”।

জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন মাস্টারদা সূর্য সেন, গঠন করলেন অস্থায়ী সামরিক সরকার । সর্বাধিনায়ক হিসেবে মাস্টারদাকে গার্ড অব অনার প্রদর্শন করা হয়। আবারও আকাশের দিকে মুখ করে গর্জে উঠলো প্রায় পঞ্চাশটা রাইফেল..…… সমবেত কণ্ঠে ঘোষিত হয় স্লোগান।

মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবী দল দুর্গম জঙ্গল দিয়ে হেঁটে চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশে রওনা দেয়। শহর এলাকায় ব্রিটিশ সেনাদের আক্রমণ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। ভোরের আগে শহরে পৌঁছাতে না পেরে বিপ্লবী দল জালালাবাদ পাহাড়ে আত্মগোপনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় একটি ট্রেন এসে পাহাড়ের কাছে রেললাইনের ওপর থামল। সেখান থেকে নেমে আসল ব্রিটিশ সৈন্য |

বিপ্লবী দল বুঝল যুদ্ধ অনিবার্য। যুদ্ধের দায়িত্বে থাকা লোকনাথ বল পাহাড়ের দু’দিকে তার বাহিনীকে বিভক্ত করে দিলেন। অপরদিকে পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকল ইংরেজ সৈন্যরা। ইংরেজদের দেখে লোকনাথ বল নিজের বাহিনীকে আদেশ করলেন গুলিবর্ষণ করার। ইংরেজ সৈন্যরাও পাল্টা গুলি বর্ষণ করল। প্রায় দু’ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ চলল। অসম এই জালালাবাদের যুদ্ধে সেদিন হার মেনেছিল ব্রিটিশ সৈন্যরা |

সেদিন মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের সেই ৬৫ জন যুবকের মধ্যে একজন ছিলেন ২১ বছরের সুরেশ দে | জালালাবাদের যুদ্ধে সুরেশ দে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন | আহত সুরেশ দে কে প্রাণে বাঁচাতে বিপ্লবী শান্তি নাগ কাঁধে করে তাকে জালালাবাদের পাহাড় থেকে গ্রামে নিয়ে আসেন | সেখানেই চিকিৎসা করা হয় সুরেশ দে’র | এদিকে ব্রিটিশরা তখন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের সাথে যুক্ত বিপ্লবীদের তন্ন তন্ন করে খুঁজছে | ধরাও পড়েছিল অনেক বিপ্লবী | সুরেশ দে প্রায় একবছর আত্মগোপন করার পর ধরা পড়লেন | জেলে তার উপর করা হল অকথ্য নির্যাতন | কিন্তু সুরেশ দে’র থেকে একটা কথাও বের করতে পারেনি ব্রিটিশরা | শত অত্যাচারেও মুখে থেকে কথা বের করতে না পেরে ব্রিটিশরা অন্য উপায় অবলম্বন করল | ব্রিটিশরা সুরেশ দে কে প্রস্তাব দেয় যদি সে চট্টগ্রাম অস্ত্রগার দখলের সঙ্গে যুক্ত সব বিপ্লবীদের কথা জানিয়ে দেয় তাহলে তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং ব্রিটিশদের সাহায্য করার জন্যে পুরস্কার স্বরূপ তাকে বিলেতে নিখরচায় ব্যারিস্টারি পড়তে পাঠানো হবে | কিন্তু সুরেশ দে ব্রিটিশদের সেই প্রস্তাবের উত্তরে বলেন, লড়াই যাদের বিরুদ্ধে তাদের পুরস্কার গ্রহণ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না | এরপর বাড়তে থাকে অত্যাচারের মাত্রা | কিন্তু কিছুতেই মুখ খোলেননি সুরেশ দে | এর বেশ কিছু বছর পর গৃহবন্দী থাকবেন এই শর্তে জেল থেকে মুক্তি পান তিনি | এমনকি সুরেশ দে যখন কিরণময়ী দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, সেইদিনও তার বাড়ির চারিদিকে ছিল ব্রিটিশ সৈন্য |

এরপর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল | কিন্তু ভাগ হল পাঞ্জাব ও বাংলা | সুরেশ দে তার পরিবারকে নিয়ে চলে এলেন এপার বাংলায় | থাকতে শুরু করলেন জামশেদপুরে | গোলামি বা অন্য কারও দাসত্ব করা তার রক্তে নেই | তিনি পরিকল্পনা করেন ব্যবসা করবেন | কিন্তু কিসের ব্যবসা ? সুরেশ দে সেই সময়ে দেখেছিলেন বেশিরভাগ সাধারণ ভারতবাসীর জুতো পরার সামর্থ্য নেই | জুতো ছিল উচ্চবিত্তদের জন্যে | সুরেশ দে ভাবলেন সাধারণ ভারতবাসীর জন্যে তিনি জুতো বানাবেন | যেমন ভাবনা তেমন কাজ | ১৯৫২ সালে জামশেদপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন শ্রীলেদার্স | উন্নত গুণমানের পাশাপাশি জুতোর দাম সাধারণ মানুষের নাগালে থাকার জন্যে সহজেই পূর্ব ভারতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শ্রীলেদার্স | ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ব্যবসা | সারা ভারতেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শ্রীলেদার্স | বর্তমানে তারা ব্যবসা করছে ভারতের বাইরে জার্মানি,গ্রীস ও কুয়েতে | জুতোর পাশাপাশি চামড়ার ব্যাগ, বেল্ট ও অন্যান্য সামগ্রীও বিক্রি করছে তারা | টার্নওভার ১০০ কোটির উপর |

সুরেশ দে ১৯৯০ সালের ২১ শে মে প্রয়াত হন | তার মৃত্যুর পর তার তিন ছেলে শেখর, সত্যব্রত এবং আশিষ ব্যবসা দেখতে থাকেন | শেখর দে , আশিষ দে বর্তমানে জামশেদপুরের ব্যবসা দেখভাল করছে | সত্যব্রত দে ১৯৮৫ সালের কাছাকাছি কলকাতায় চলে আসেন এবং লিন্ডসে স্ট্রিটে ৭০০ বর্গফুটের শ্রীলেদার্সের শো রুম দেন | বর্তমান সেই শো রুম প্রায় ৩৫০০০ বর্গফুটের | এর পাশাপাশি ফ্রি স্কুল স্ট্রিটেও তিনি ২৫০০০ বর্গফুটের একটি শো রুম চালু করেন | সত্যব্রত দে’র পুত্র সুমন্ত দে বর্তমানে শ্রীলেদার্সের দিল্লির ব্যবসা দেখছে | সারা দেশে প্রায় ৩০ টি শো রুম আছে শ্রীলেদার্সের | এর পাশাপাশি সত্যব্রত দে ও সুমন্ত দে চালু করেছে “সুমন্ত সুশান্ত এক্সপোর্টস” নামের এক্সপোর্ট ব্যবসা |

“World Class, Right Price” এটাই ট্যাগলাইন শ্রীলেদার্সের | এই কথা মাথায় রেখেই আজও রমরমিয়ে ব্যবসা করে চলেছে তারা |


(তথ্য – শ্রীলেদার্স ওয়েবসাইট)
সৌজন্য বাংলা আমার প্রাণ

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়