রাতুল সেন

Published:
2020-06-30 15:38:50 BdST

মিরপুরের ভূতের বাড়ির সেই রিতা মিতা কেসস্টাডি



অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম
________________________

রোগ কাহিনী : সারাদেশ ব্যাপী ব্যাপক প্রচার পাওয়া ডাক্তার - ইন্জিনিয়র দুই বোন রিতা- মিতা আবার ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে।এবার তাদের ঠিকানা হয়েছিল খোদ " ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ,ঢাকায়"।
মনে থাকবার কথা অনেকের। দীর্ঘ ৮-৯ বছর তাবৎ পৃথিবী থেকে বিযুক্ত থেকে নিজ গৃহে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী ও গুরুতর মানসিক ব্যাধীতে আক্রান্ত এই দুই বোনকে ৮-১০ ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস নাটকীয় অভিযান শেষে উদ্ধার করা হয়।
গোড়ার কথা: রিতা,বয়স ৫৩, এমবিবিএস ১৯৮৮( সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ)।৯ম বিসিএস উত্তীর্ণ। সরকারি চাকরী ১৯৯৭-ঢাকার বাইরে।পূর্বের পিজি হাসপাতালে এফসিপিএস( হেমাটলজী) কোর্সে ঢুকেন।গ্রামে পোস্টিং, তাই সেখানে যাওয়া হয় না।ফলে বেতন বন্ধ। আবার এদিকে এফসিপিএস পাশ করাও কঠিন।তাই বিরক্ত ও হতাশ।
ছোট বোন মিতা বুয়েট থেকে কেমিকেল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে সেখানেই কেমিকেল সেকশনে চাকরী হয়।মূল রোগ শুরু হয় ছোট বোন মিতার।তার সন্দেহ হয় অনেকে তার ও তার পরিবারের ক্ষতি করতে চায়।ডিপার্টমেন্ট এর সুপারভাইজার তাকে কেমিকেল ফিউম ছুড়ে মেরে ফেলার চেস্টা করছে।নানাবিধ ষড়যন্ত্রের কারনে দেড় বছর পর সে চাকরী ছেড়ে দেয়। বাবা সার্ভে অব বাংলাদেশের ম্যানেজার ছিলেন
১৯৮২ সনে মারা যান।বড় বোন কামরুন্নাহার হেনার ৯৪ সনে বিয়ে হয়ে যায়।
তিনি বলেন ৬ মাসের মধ্যে দেখি তারা বাসায় কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।তাদের বিশ্বাস অন্যরা তাদেরকে মেরে ফেলবে,খেয়ে ফেলবে।তিনি বলেন বার বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে এক সময় তাদের থেকে দূরে চলে যাই।চেষ্টা করেছি যোগাযোগ করার জন্য। এভাবে ৯ বছর চলে যায়।যখন অপারেশনের জন্য আমার ব্লাড লাগবে তখন বোনদের ডাকি।তারা আমাকে বোন হিসেবে অস্বীকার করে।আমার বাচ্চা পানি খেতে চাইলে বলে পানি নেই।
বাবার পেনশনের টাকা ও দোকান ভাড়া দিয়ে তাদের সংসার চলতো।রিতা বিয়ে করতে চায় কিন্তু মা বড় বোনকে বলে একে বিয়ে দিস না,বিয়ে দিলে বাড়ীতে থাকতে পারবি না।রিতা বলে আমি কোরআন মুখস্হ করতাম।
৯৪ সনের দিকে স্বপ্নে দেখি কে একজন বলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করিও।পরদিন এ কথা ছোট বোন মিতাকে বলি(যিনি ইতিমধ্যে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে চাকরী ছেড়ে দিয়েছে)। মিতা এ সংবাদে আধ্যাত্বিতার আভাষ খুজে পান।সে বলে আজ রাতে মা সহ আমরা ৩ জন উপাসনা করে কাটাবো,কেননা এ খবর আল্লাহতালার কাছ থেকে এসেছে।সারা রাত তারা প্রার্থনা করে কাটায়( দোয়া ইউনুস পড়ে)। এরপর থেকে নিয়মিত তারা প্রার্থনা করতো।দিন রাত ২৪ ঘন্টা প্রার্থনায় মগ্ন থাকতো।রিতার ভাষায় এ সাধনায় মিতা অনেক গভীরে চলে যেতো।মিতা-ই হয় মূল নেতা।সে যা বলতো রিতা তাই মানতো।রিতা বোনের বিশ্বাসের অংশীদারত্ব পেয়ে যায়

অন্ধের মতন সে ছোট বোনকে পীর মানতো।উপর থেকে মিতার কাছে " গাইডেন্স" আসতো।রিতা মিতার সে গাইডেন্স অনুসরন করতো।এক সময় মিতার কাছে গাইডেন্স আছে হিন্দি গান গাওয়ার।এটাও নাকি প্রার্থনা ( মিতার নির্দেশে রিতা আমাদেরকে গান শোনায়-শুনো হে মুসলমান এ দুনিয়া ফানা হবে কিছু রবে না.....
পরে দুবোন মিলে একটি হিন্দি গানও গায়।আমি হিন্দি বুঝি না
তবে সঙ্গে থাকা এক ছাত্রী বললো স্যার এটাতো প্রেমের গান)। তারা নিজেরাও জানে না এরকম চটুল গান কিভাবে ধর্মীয় সাধনা হয়।কিন্তু তারা বিশ্বাস করে এটি অতি উচ্চ স্তরের সাধনা।এর মাধ্যমেই তারা আধ্যাত্বিকতার উচ্চ স্তরে পৌছে যাবে। এক সময় মিতার কাছে গাইডেন্স আসে যে তাকে "অনারেবল রিলিজিয়াস লিডার অব দ্য ওয়ার্ল্ড আর. এইচ( রহমাতুল্লাহ আলায়েস সালাম " ঘোষনা করা হয়।পরে আরো উচ্চতর পদ " অনারেবল লিডার অব মিলিনিয়াম " দেওয়া হয়।এ সবই রিতা বিনা বাক্যে মেনে নেয় ও সেই এই গ্রেট রিলিজিয়াস লিডারের এক মা্ত্র ফলোয়ার।।তারা মনে করে তাদের বড় বোন ও দুলাভাই হচ্ছে গ্যাং লিডার যারা তাদের ক্ষতি করতে চায়।তাদের প্রশ্ন করতে গেলে রিতা বলে আমি ডাক্তার সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি।আমাদের কোন হ্যালুসিনেশন,ডেলুশন নেই।যা কিছু বলে রিতাই বলে।মিতা আধ্যাত্বিক নেতার ভূমিকা নিয়ে কালে ভদ্রে দুএকটা নির্দেশ রিতাকে দিতো( মূলত মিতা মূল রোগিনী বলে ও তার চিন্তা বিভ্রান্তি বেশী বলে সঠিকভাবে সে কারো সঙ্গে কমিউনিকেশন করতে পারতো না।তার হয়ে রিতা গুছিয়ে সব কথার উত্তর দিতো।রিতার মধ্যে শুধু মিতার ভ্রান্ত বিশ্বাস গুলো ধারন করা ছাড়া অন্য কোন অস্বাভাবিকতার লক্ষণ নেই)।
মিতা বলে তার ছবি নাকি প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় আসে।বলে পাতা খুললেই দেখবেন আমার ছবি দিয়ে ভরা।এক ছাত্র পাশের বেড থেকে একটি পত্রিকা এনে কোথায় তার ছবি দেখাতে বলে।সে পত্রিকার সব ছবিই তার ছবি দাবী করে।কে ছবি দেয় জিজ্ঞেস করলে বলে" ডেভিল অব গড" এসব দেয়।আল্লাহ নাকি বলেন রিতার দায়িত্বহীনতার কারনে তাদের সাধনা পুরো সিদ্ধ হচ্ছে না।সে বলে রিতার অপদার্থ স্বভাবের কারনে অনেক কিছু ভন্ডুল হয়ে যায়।সে রিতার ভুল সংশোধন করে দেয়।তখন রিতা তওবা করে।রিতা বলে সাধনা সিদ্ধির পর মিরপুরের রাস্তায় প্রচার করতে যাই।ছেলেরা বলে টিউশনি করেন না কেন? এরপর এলিনা ধরে নিয়ে আসে।

তাদের বর্তমান দায়িত্ব হচ্ছে একটি গানের দল বানানো।পরে সারা পৃথিবীতে সে দল ছড়িয়ে পড়বে এবং এভাবেই নাকি তারা ধর্ম প্রচার করবে।রিতা বলে পুরো বাংলাদেশ মিতার তালুক।
দেশের বাইরেও মিতার প্রচুর ধন সম্পদ রয়েছে। এসব মিতার দাবী,রিতা তা বিশ্বাস করে মাত্র।মিতা কার কি কাজ তা লিখে দেবে তখন সবাই তার নির্দেশে সে অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে।জিজ্ঞেস করি নামাজ রোজা করেন? মিতার উত্তর বন্দিনীদের জন্য নামাজ রোজা জায়েজ না( তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে জোর করে আটকে রাখছে তাই তারা বন্দিনী) ।

তারা কিভাবে ধরা পরলো জানতে চাইলে বলে এই গান গাওয়ার সাধনায় ঘাটতি ছিল তাই ধরা পড়েছে।তারা বলে ৯ বছর ঘরের বাইরে যেতাম না।রিতা চুপিসারে মাঝে মধ্যে দোকান থেকে যা পারতো নিয়ে আসতো। ঐ দিয়েই কয়েকদিন চালিয়ে নিতো।ঘরের বৈদ্যুতিক বাতি ও রাখতো না।বড় বোন হেনা বলে এক সময় আমি একজন সাইকিয়াট্রস্ট এর কাছে বোনদের কথা জানাই কিন্ত তাদের জোরকরে কেমনে বাইরে আনবো? এরমধ্যে তাদের মা বিনা চিকিৎসায় ঘরে মারা যায়।দুবোন মায়ের লাশ ঘরেই রেখে দেয়,কাউকে জানায় না।মধ্যরাতে হ্যারিকেন নিয়ে তারা ঘরের বাইরে যায়। তখন অন্যরা দেখে ফেলে।
হেনা বলেন ইনকিলাব পত্রিকায় পড়ি যে মা মারা গেছে,লাশ ঘরে রেখে ঘরেই কবর দিতে চেয়েছিল।এডভোকেট এলিনা পুলিশ নিয়ে তাদের উদ্ধার করে।সেখানে বাড়ির ঠিকানাও ছিল। পেপার পড়ে সেখানে যাই।দেখি অনেক লোকজন( লাশ ঘরে অনেকদিন ছিল)। লাশ পুলিশ বাসার পাশে কবর দেয়।ওরা বলে আমার বোন আমাদের সম্পদ চায়।পুলিশ কিছু করে না।
ওদের উদ্ধার করে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেওয়া হয়।কঙ্কালসার অবস্হা,প্রায় মরনদশা।একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এর পাশাপাশি ডা. মোহিত কামালের অধীন মানসিক চিকিৎসা চলে।তারা সুস্হ হয়ে উঠে।প্রচুর লেখালেখির কারনে সবার নজরে থাকে তাদের দিকে।
রিতাকে বিএসএমএম ইউতে একটি চাকরি ও দেওয়া হয়,পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে।কিন্তু সে নিয়মিত অফিস করে না,ঔষধ ও খায় না।তাই চাকরি চলে যায়।তারা আবার ২০০৭ সনে বিএসএমএমইউতে ৪ মাস চিকিৎসাধীন থাকেন।বড় বোন জাফরাবাদে ভাড়া বাসায় এনে তাদের রাখে।কিন্তু তারা ঔষধ খায় না।নিজেরা একত্রে গান গায়( উপাসনা করে)। কারো সঙ্গে মিশে না।তাদেরকে খাবার দেওয়া হয় তারা তা খেয়ে নিয়ে নিজেদের মতন চলতে থাকে।ফলে ২০১১ সনে তাদের আবার ভর্তি করা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।এরপর হেনা নিজ বাসায় নিয়ে রাখে।কিন্তু তারা তাদের মতনই থাকে।২০১৩ এ তারা বাসা থেকে গোপনে পালিয়ে বাসে করে বগুড়ায় চলে যায়।
একটি হোটেলে কয়েক মাস থাকে।টাকা শেষ হলে হোটেলের লোকেরা তাদেরকে একটি সমাজ সেবা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন।সেখান থেকে এডভোকেট এলিনা ও বড় বোন গিয়ে তাদের ঢাকায় নিয়ে আসে।একইরকম অবস্হায় বোনের বাসায় তারা থাকে।
কিন্তু গত কিছুদিন যাবৎ তারা খাওয়া দাওয়া একদম বন্ধ করে দেয়।কোনভাবেই তাদের খাওয়াতে না পেরে বড় বোন এবার তাদেরকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করান।
যা শিক্ষনীয়:
১। মানসিক রোগ সম্বন্ধে ন্যুনতম ধারনা থাকলে তাদের পরিবারের লোকদের,আত্মীয়দের সহজেই বোঝার কথা ছিল যে মিতার এই অহেতুক সন্দেহ প্রবনতা বড় ধরনের মানসিক রোগের লক্ষন।তখন তাকে সুচিকিৎসা দিলে তার চাকরি ছাড়তে হতো না,রিতাও তার প্রভাবে আক্রান্ত হতো না।এক কথায় পরবর্তী এতো অঘটনের কোন কিছু ঘটতো না।
২। মায়ের লাশ নিয়ে ঘরে বসে আছে জানার পরও পুলিশ জানতে চেষ্টা করেনি তারা মানসিক রোগী কিনা।অন্তত তখনই তাদেরকে চিকিৎসার আওতায় আমাী উচিৎ ছিল।
৩। যে কয়বার হাসপাতালে ভর্তি করে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়,শুধু সে সময়টুকুতে তারা পূর্ন চিকিৎসার আওতাধীন ছিল ও ভালো হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু বাকী সময়গুলোতে তারা নিজের মতন চলতো,ঔষধ খেতো না।এক কথায় চিকিৎসা বিহীন অবস্হায় থাকতো
৪। এর জন্য বড় বোনকে দায়ী করা অন্যায় হবে।কেননা এ রকম বড় ধরনের মানসিক রোগীরা নিজদেরকে রোগী মনে করে না।তাই তারা চিকিৎসা গ্রহনে রাজী থাকে না
৫। মূল রোগিনী হচ্ছে মিতা।রিতা মিতার উপর নির্ভরশীল হয়ে তার লালিত ভ্রান্ত বিশ্বাসগুলোর অংশীদারিত্ব পেয়ে যায় ( শেয়ার হয়ে যায়)। একে বলা হয় " শেয়ার্ড ডেলুশন"। তুলনামূলক ভাবে এটি নিরাময় করা সহজ,যদি মূল রোগিনী থেকে তাকে " বিচ্ছিন্ন " রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।কিন্তু কোন বারেই তা হয়নি।বরং তারা সব সময় শুধু নিজেদের মধ্যে থাকতো।ক্ষনকালের জন্য ও দূরে থাকতো না।
৬। যেহেতু এ ধরনের ক্রনিক রোগীরা ঔষধ খেতে চায় না,তাই বিদেশে কমিউনিটি সাইকিয়াট্রিক টিম নিজ দায়িত্বে নির্দিষ্ট সময় পর পর ঔষধ, ইনজেলশমএসহ নিয়মিত বাসায় গিয়ে চিকিৎসা দিয়ে আসা হয় ও ফলো আপে রাখা হয়।তাছাড়া যাদের দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের প্রয়োজন তাদের জন্য সরকারী ভাবে হোস্টেল,রি- হ্যাব সেন্টার রয়েছে।
৭। আমাদের দেশে এখনো এই সার্ভিসগুলো চালু হয়নি।কিন্তু পাবনা মেন্টাল হাসপাতাে যে বিশাল অবকাঠামো রয়েছে, অনায়সে সেখানে বড় মাপের দুটি রি- হ্যাব সেন্টার খোলা যায়।ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্হ্য ইনস্টিটিউটেও এখনি বাড়তি কোন জনবল ও পয়সা খরচ ছাড়া কমিউনিটি সাইকিয়াট্রি টিম কাজ করতে পারে এবং এখানেও কয়েকটি বড় রুম নিয়ে রিহ্যাব সেন্টার খোলা সম্ভব।
( সাইকিয়াট্রিতে কিছু কেইস হিস্ট্রি "ইতিহাস " হয়ে যায় যা ছাত্র ছাত্রীদের উদাহরন হিসেবে বলা হয়।বাংলাদেশেও " রিতা- মিতা" তেমন কেইস যা শিক্ষনীয় উদাহরন হিসেবে সবার জানার প্রয়োজন।সে তাগিদে এ কাহিনী লিখলাম)

________________INFORMATION___________________

 

_____________________INFORMATION_____________________

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়