ডাক্তার প্রতিদিন

Published:
2020-06-07 19:42:58 BdST

হাসান সুরুরের who killed liberal Islam বইটা পড়ছিলাম:তাঁর পর্যবেক্ষণ বহুলাংশে সত্য:ডা. রেজাউল করীম


অধ্যাপক ডা. রেজাউল করীম
লোকসেবী চিকিৎসক,
প্রখ্যাত লেখক চিন্তক , কলকাতা
__________________________

পরশু রাতে ভয়ানক শব্দ করে বাজ পড়ল। আমার ঘরে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের অন্তর্জালের ভাঁড়ার ঘর। জালের আর কিছু আস্ত নেই, পুড়েফুড়ে গেছে বোধহয়। তাতে একদিকে ভালো হয়েছে। নেট না থাকলে একটু প্রডাক্টিভ কাজে সময় দেওয়া যায়। গত দু মাসের কথা ভাবছিলাম। করোনার মত ভীতিজনক অভিজ্ঞতা অনেকদিন হয় নি।রাজনীতি আর ধর্মের এই জগাখিচুড়ি ও অন্ধগলি থেকে কিভাবে বাঁচা যায় সেকথাও ভাবছিলাম।

আমার স্মৃতিতে আছে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় সর্বত্র একটা ভয়ের আবহ ছিল, করোনা যেন সেই ভয়কে জাগিয়ে দিয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি রাজনীতি। আমাদের বাড়ী যেহেতু বর্ডার থেকে মাত্র 30কিমি দূরে দিন রাত কামানের আওয়াজ এত স্বাভাবিক ছিল যে আমার ধারনা হতো এটাই বোধহয় নিয়ম। সেই ভয় যেন আবার ফিরে এসেছে, সবটা হয়তো সত্য নয় কিন্তু হাড়হিম করা একটা আশঙ্কা মনের মধ্যে দানা বাঁধছে- করোনা যে কি করবে কেই বা বলতে পারে। তাই, সেই ভয় হয়তো স্বাভাবিক।

বেশ মনে আছে একবার একটা ফাইটার প্লেন গ্রামের আকাশে ঢুকে পড়েছিল। সামনে একটা আর তার পেছনে আরো দুটো প্লেন দৌড়াচ্ছে খুব নীচু দিয়ে।কাঁচা তেঁতুল ঢিল মেরে পাড়ছিলাম কবর ডাঙার বড় তেঁতুল গাছের তলায়। এমন সময় ভয়ঙ্কর শব্দ করে একেবারে নীচু দিয়ে উড়োজাহাজে এই উড়নচন্ডী কাণ্ডকারখানা। বাড়ীর টিনের চালগুলো পর্যন্ত ঝনঝন করে উঠছিলো। কখনো কখনো শুনতাম কারা যেন অনেক বন্দুক কামান নিয়ে যে কোন সময় ঢুকে পড়তে পারে। মনে মনে খুব ভয় পেতাম। বাবা অবশ্য বলতেনঃ বোকা ছেলে! ওরা কখনো আমাদের সাথে পেরে ওঠে! কোন ভয় নেই, যাও খেলোগে! আর সব আবছা হয়ে গেছে কিন্তু ভয়ের সেই শিরশিরানি দিব্যি মনে আছে।

সেই ভয়ের আবহেও বাড়ীর বড়দের তর্ক-বিতর্ক আর আলোচনায় আসতো রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-গান-কবিতা- থিয়েটার। কখনো সখনো শেখ মুজিব, ওকে জ্যান্ত কবর দেবার ভয়ঙ্কর হুমকি। আর চলতো রিহার্সাল- গ্রামে পুজোয় থিয়েটার হতো। আলোচনা ও তর্ক বিতর্কে আচার সর্বস্ব ধর্ম একেবারে থাকতো না, কেন্দ্রবিন্দু ছিল দর্শন। দাদারা ব্রিজ খেলতে খেলতে আজানের ডাক শুনলে দুয়েকজন নামাজ পড়তে যেত, বেশির ভাগ একটু আড়ালে গিয়ে সিগারেট খেতো। দুয়েক জন তো সরাসরি নাস্তিক ছিল। এখনকার দিন হলে হয়তো মুণ্ডচ্ছেদ করে ফেলতো!

এখন একজন কেউ কিছু একটা বলছে আর অমনি সবাই মিলে রেরে করে তার পেছনে দৌড়াচ্ছে, সেখানে আত্মসমালোচনার কোন স্থান নেই। অবশ্য এটাও ঠিক যে করোনা নিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে সব কথা অনেকে বলছে তাদের বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষ, অনেকে তথাকথিত লিবারেল রাজনীতি করেছে জীবনভর। এরা যে সাম্প্রদায়িক কথা বলছে এটা বোঝার মত সচেতনতা ও নেই, ভেবে দেখার সময়ও তাদের নেই। এমন ও নয় যে তারা এত সাম্প্রদায়িক যে একজন মুসলিমকে হাতের কাছে পেলেই তাকে মেরে ফেলবে কিন্তু একটা নঞর্থক চেতনা অবচেতনে তৈরী হয়েছে। আমাদের কৈশোর বয়সে শিক্ষিত ভদ্রলোক-হিন্দুর মনে মুসলিমদের প্রতি যে স্নেহ ও ভালবাসা ছিল তার অভাব এখন খুব স্পষ্ট।তখনো তাঁরা বেশিরভাগ ছিলেন নিষ্ঠাবান মানুষ, ছোঁয়াছুঁয়ি ছিল, সংস্কারও ছিল কিন্তু ঘৃণা ছিল না। আমরা তো তাঁদের হাত ধরেই বড় হয়েছি, যা শেখার তারাই শিখিয়েছেন। দু চার জন মুসলিম শিক্ষক ছিলেন, তারাও ছিলেন উদার, কেউ চরম নাস্তিক। এই স্বর্গ থেকে পতনের পুরো দায় হিন্দু সম্প্রদায় আর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উপরে চাপানো ঠিক হবে না, অনেক গভীর বিশ্লেষণ দরকার।

হাসান সুরুরের (who killed liberal Islam) বইটা পড়ছিলাম। তাঁর সঙ্গে অনেকেই পুরোপুরি একমত নাও হতে পারেন কিন্তু তাঁর পর্যবেক্ষণ বহুলাংশে সত্য। ইসলামী "উদারতা"র বিদায় ঘন্টা বেজেছে কারণ ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে কোন বিভাজিকা নেই। রাষ্ট্রপ্রধান যদি ধর্মগুরু হন, তাহলে ধর্মই রাজনীতি হয়ে উঠবে, এর মধ্যে কোন ভুল নেই। ধর্ম গ্রন্থের বৃহত অংশে তো রাজনীতিই মুখ্য । রাজ্য শাসন করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে সরাসরি ও নির্লজ্জভাবে। হজরত উমরের মদিনা সনদ পড়লে বুঝবেন যে ধর্ম আর রাজনীতির মধ্যে রাজনীতি ছিল মুখ্য। সৌভ্রাতৃত্ব কেবল মুসলমানদের জন্য, অন্যরা সেখানে গৌণ। কিন্তু, মানব সভ্যতার বিকাশের পূর্ব শর্ত হল সমানাধিকার, আক্ষরিক ও রূপক দুঅর্থেই- কোন বিভাজন যেন সেখানে বাধার বিন্ধ্যাচল হয়ে না দাঁড়ায়। তা কি হয়েছে? অবশ্য ধর্ম সবসময় পুস্তক মেনে চলে না, তা চিরকালীন রীতিনীতি সংস্কারে নিজেকে পাল্টে ফেলে, তার নির্যাস হয়ে ওঠে দৈনন্দিন মঙ্গল-চেতনায় বিধৃত। তাই মতবাদ যখন নাগরিক বিশ্বাসের অঙ্গ হয়ে সংস্কৃতির জগতে আসে তা ক্রমশঃ হয়ে ওঠে শুভচেতনায় উষ্ণ। যেমন, যোদ্ধা ও কূটনৈতিক কৃষ্ণ আমূল বদলে হয়েছেন মুরলীধর কৃষ্ণ: শ্রীরাধিকার কৃষ্ণ পঞ্চদশ শতকে শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে প্রেমময় হয়ে উঠেছেন। মহাভারতের কৃষ্ণ গান্ধারীর অভিশাপে একাকি বন্ধুহীন হয়ে ব্যাধের হাতে মৃত, শ্রীচৈতন্যের প্রেমময় কৃষ্ণ মৃত্যুহীন প্রেমের দেবতা। তাই শ্রীকৃষ্ণের এই উক্তি- "স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি। ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োন্যাৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে--ধর্মযুদ্ধের চেয়ে ক্ষত্রিয়ের কাছে শ্রেয়স্কর কিছু নেই- (অনুবাদ রাজশেখর বসু) কেউ মনে রাখে না। কিন্তু ইসলামের আল্লাহ্ প্রেমময় হয়ে উঠতে পারেন না বরং মহম্মদের জেহাদের অনুরণন গ্রামের অশিক্ষিত মৌলবীর হাতে ঘৃণার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ইসলামের যে "দার্শনিক চেতনার কথা, প্রেমময় ঈশ্বরের কথা বা সব ধর্মমত সেই আল্লাহর সৃষ্টি ও আল্লাহর কাছে একটি মত অন্যের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়", মওলানা রুমির এই মত সাধারনে তেমন জনপ্রিয় নয়। অথচ, মসনবি এখনো একটি বেষ্ট সেলার পুস্তক। আদতে, ওয়াহাবি রাজনীতি ও ফ্যাসিবাদী ধর্মীয় চেতনায় ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মৃত্যু হয়েছে। মুক্তমনা অনেকে তাই মুসলিমদের অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে কখনো সখনো ওয়াহাবিজমের ও রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়ান।

কোন একটি অনন্য পথের ঠিকানা বলা সম্ভব নয় কিন্তু ক্রমাগত আঘাতে আঘাতে মুসলিমদের কাছে একটি সুযোগ উপস্থিত হয়েছে যখন রুমির আদর্শে ধর্মকে পুনর্গঠন করে দুটি বৃহত সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। আরেকটি কথা, যেটা হাসান সুরুর উল্লেখ করেছেন- শিক্ষিত মুসলিম যারা নিজেদের নাস্তিক ভাবেন, ধর্মের কিচ্ছু জানেন না, গরীব নিরক্ষর মুসলিমদের মানুষ বলেই গন্য করেন না তাঁরাই আবার অনেকে ধর্ম নিয়ে পোষ্ট-এডিট লেখেন, টিভিতে গিয়ে গলা ফাটান।কয়েকটা অশিক্ষিত ওয়াহাবি রাজনীতিক ও গিয়ে সেখানে জোটে। তাদের বক্তব্য বেশির ভাগ মুসলিমের মত না হলেও সেগুলি রাজনৈতিক কারনে ছড়ানো হয় ও এই দরিদ্র নিরন্ন মানুষের জীবনযাত্রা আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

বিসমিল্লা খান সাহেব বলেছিলেনঃ "আমি ভোর বেলা গঙ্গাস্নান করে ফজরের নামাজ পড়ে বিশ্বনাথ মন্দিরে সানাই বাজাই, ফিরে এসে মা সরস্বতীর পুজো করি, আমি ধর্ম সমন্বয় কাকে বলে জানিনা"। গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা আগে নামাজ-পুজো রোজা-উপবাসকে ধর্ম ভাবতেন, অন্য বিভেদ তাদের কখনো তেমন বিভক্ত ও বিক্ষত করেনি, তাদের মধ্যেও এখন হিন্দু-মুসলিম চেতনা গেঁথে দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে রাজনীতির হাত সবচেয়ে বেশি- সৌদি সরকারের টাকা এদেশে ঢুকে যেমন সহজিয়া সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে তেমনি অপরিণত ধর্ম আলোচনা আরো বেশি ক্ষতি করেছে। তার সাথে অবশ্যই হিন্দু সম্প্রসারণবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদ সঙ্গত করেছে। "উদার"বাদী রাজনৈতিক দলগুলির হিরন্ময় নীরবতা তাদের সহায়ক হয়েছে। তারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করবেন না বলতে গিয়ে যে আচার সর্বস্ব ধর্ম মনুষ্যত্ব বিকাশের পরিপন্থী তার জ্বলন্ত বহিঃপ্রকাশ দেখেও নিরাপদ দূরত্বে নিশ্চুপ দর্শক সেজে বসে থেকেছেন।

এদেশের কুড়ি কোটি মুসলমান আর 110কোটি হিন্দুকে একসাথে বাঁচতে হবে নাহলে দেশ বাঁচবে না। তার জন্য ওয়াহাবি রাজনীতি ও তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দুটিই চরম বাধা। সংবিধানকেই যদি যথাযথ মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলে সবার জন্য এক আইন দরকার ও প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তি অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। সেখানে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক আইনের অবসান করতে হবে। এই লড়াই লড়তে গেলে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যে ইস্যু তুলে বাজিমাত করতে চাইছে, প্রগতিশীলরা সেই অন্ধগলিতে না ঢুকে মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র, অধিকার ও ধর্ম-আচার-বর্জিত দৈনন্দিন রুটি রুজির সমস্যার কথা তুলে ধরতে হবে। আলাপ আলোচনা ও তর্কের সূচীমুখ যেন কাউকে কটাক্ষ না করে কেবলমাত্র একদেশদর্শী হয়েই সেদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে।

এটা ঠিক অনেকে আজকাল প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক কথা বলছেন। আমি মনে করি উদারবাদী রাজনীতির চরম পরাজয়ের লক্ষণ এটি। বিগত সাত দশকে উদারবাদী রাজনীতি যে আবর্তে বয়েছে সেখানে দুটি বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক মেল বন্ধনের সচেতন চেষ্টা তেমন দেখা যায় নি, রেটোরিক ছিল যতটা, বস্তু ততটা ছিল না। আমাদের দেশে এমন অনেক মনীষী ছিলেন যাদের কথা সহজতর ভাষায় সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হতো না। শ্রীচৈতন্য থেকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, চিত্তরঞ্জন দাশ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কথাই কি সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক ভাবনায় বড় স্থান অধিকার করতে পেরেছিল? পারে নি, কারন তাদের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকলেও সেই সুযোগ ব্যবহার করার জন্য যে ভবিষ্যত-দর্শনের মনন ও বীক্ষা দরকার ছিল থাকলেও তার প্রয়োগ হয়নি। অথবা হয়তো সাময়িক ক্ষমতার মোহ ভুলিয়েছিল যে, "চিরকাল কারো সমান নাহি যায়/ আজ যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়।"

AD..

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়