ডাক্তার প্রতিদিন

Published:
2020-05-26 19:33:48 BdST

কাহিনিনভেম্বরের শেষে এক মহিলার কাছ থেকে চিঠি আসে


 

ডা.রাজীব হোসাইন সরকার
____________


নভেম্বরের শেষে এক মহিলার কাছ থেকে চিঠি আসে।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আজকাল কেউ চিঠি লিখছে ব্যাপারটা অবাক করবার মত। আমি রাতের খাবার শেষে চিঠি খুললাম।
চিঠিতে তেমন কিছু লেখা নেই। গোটা গোটা বর্ণে একটামাত্র বাক্য লেখা।

‘আপনি আসতে পারবেন?’

বিনীত
রওশন আরা জামান

ফরেনসিক গ্রাফোলজি সম্পর্কে আমার টুকটাক পড়া আছে। ছোট্ট চিঠি থেকে নানাবিধ তথ্য খুঁজে বের করা যায়। আমি নোটবইতে নাম্বার দিয়ে লিখতে শুরু করলাম-
১। প্রেরক মহিলা। (নাম দেখেই মহিলা বোঝা যায়)
২। বয়স ত্রিশের উপরে। (বয়স বোঝা যাচ্ছে নামের প্যাটার্ন দেখে। আজকাল রওশন জামান বা রওনক জামান চলছে। রওশন আরা জামান পুরাতন ফ্যাশন। এই তথ্য ভূলও হতে পারে)
৩। আত্মবিশ্বাসী। (পরিষ্কার ও স্পষ্ট বর্ণে লেখা)
৪। ইন্ট্রোভার্ট কিংবা বিপদে পড়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। (বাক্যের বর্ণগুলো ছোটছোট। প্রতিটি শব্দের মধ্যে স্পেস অল্প। নিজেকে গুটিয়ে রাখার ব্যাপারটি হাতের লেখায় চলে আসে। বর্ন এবং স্পেস ছোট হয়ে যায়)
৫। স্বামীর সাথে সুসম্পর্ক নেই, পছন্দ করেন না কিংবা স্পষ্ট দূরত্ব আছে। (সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়- ‘রওশন আরা’ শব্দদ্বয়ের পর একটা দীর্ঘ স্পেস। এরপর স্বামীর টাইটেল ‘জামান’ লেখা। টাইটেলের মালিকের সাথে সুসম্পর্ক না থাকলে লেখকের অজান্তেই এমন দূরত্ব হাতের লেখায় চলে আসে)
৬। বড় ধরণের বিপদে আছেন। (ছোটখাটো বিপদ হলে অপরিচিত কাউকে ডাকার কথা নয়)
৭। বিপদ সমাধানের অযোগ্য। (সমাধানের সকল উপায় অবলম্বন করবার পর চিঠি লেখা হয়েছে)

খামের গায়ে ঠিকানা স্পষ্ট করে লেখা আছে।
আমি বরাবরের মত চিঠিটা ফেলে দিতে পারি কিংবা ছোট করে উত্তর লিখে উপরোক্ত ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারি।
তেমন কিছুই করলাম না।
যারা রহস্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাদের জানার কথা, রহস্যের উৎসরা বরাবরই রহস্যপ্রেমীদের একটা প্রচ্ছন্ন রহস্যের ডেমো ভার্সন দেখাতে চেষ্টা করে। ডেমো ভার্সন দেখে রহস্যপ্রিয় মানুষ ছুটে চলে যাবে। যেভাবে মিস্টির উপস্থিতি পেলে ছুটে যায় পিপীলিকা।

চিঠি হাতে পাবার সপ্তম দিনে আমি চিঠির ঠিকানায় হাজির হলাম।

সাভার।
মূল শহর থেকে উত্তরে একটা রাস্তা চলে গেছে। রিক্সায় সত্তর টাকা ভাড়া। শীতকাল চলছে। রাস্তায় ধুলোবালি। রিক্সায় উঠে সাভারের বিখ্যাত ধুলোবালি গিলতে গিলতে একটা বাংলো টাইপের বাড়ির দরজায় কলিং চাপলাম।

বাড়ির মূলগেট খুলল সত্তোর্দ্ধ বৃদ্ধ। বাড়ির কেয়ারটেকার। হাতে চাবির গোছা। কিন্তু পায়ে রাবারের স্যান্ডেল। বয়সের ভায়ে ন্যুজ হয়েছেন। একটা লাঠি ধরে ঠুকঠুক শব্দ করে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন।

বসার দশ মিনিটের মাথায় চা দেওয়া হল। চকচকে কাপ। কাপের কিনার পর্যন্ত দুধ চা।
চায়ের স্বাদ দেখে বলা যায়, চা গৃহকর্তী বানিয়েছে নাকি অন্য কেউ। চায়ে চুমুক দেবার পরই মনে হল, বৃদ্ধ নিজে চা বানিয়ে এনেছেন। চিনিহীন বিরস চা কোন নারীর হাতে জন্ম নেবার সম্ভাবনা নেই।
চিঠির প্রেরকের সাথে এখনো দেখা হয়নি। তিনি খুব অসুস্থ কিংবা খুব বড় ধরণের বিপদে আছেন। নতুবা তার নিজে আসার কথা। চা-ও তার নিজে বানানোর কথা।
বসার ঘর গোছানো। শোকেসে বিশেষ শো-পিস নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, শোকেসের তাকভর্তি নানা ধরণের ট্রফি, মেডেল। দুটো পুরাতন কাঠের আলমারি। আলমারি ভর্তি বিদেশি বই। আমি উঠে তাকের সামনে দাঁড়ালাম। সাহিত্যের বই নেই। একটা বইয়ের নাম লেখা- The Gene: An Intimate History by Siddhartha Mukharjee.

ঘরের দেয়ালে অনেকগুলো ফটোফ্রেম ঝুলছে। একজন ভদ্রলোক প্রেসিডেন্ট এরশাদের হাত থেকে ক্রেস্ট নিচ্ছেন। আরেকটা ফ্রেমে তাকে বিদেশী কিছু মানুষের মাঝখানে হাস্যোজ্বল বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। সবার পরণে এপ্রোন। গলার কাছে মাস্ক ঝুলে আছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল ভদ্রলোককে চেনাচেনা মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছি মনে পড়ছে না।

রওশন আরা জামান আসলেন দেড় ঘন্টা পর। আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা। হাতে পায়ে কালো মোজা। চোখের অংশটুকু বের হয়ে আছে। সেটা ঢেকে রেখেছেন কালো সানগ্লাস দিয়ে।
বয়স অনুমান করা যাচ্ছে না। গলার স্বর শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। রওশন আরা আমাকে দেখেই খানিকটা লজ্জিত গলায় বললেন,
‘আমাকে মাফ করবেন, এতক্ষণ বসিয়ে রাখা উচিৎ হয়নি।’
আমি কথার পীঠে জবাব দিলাম না। রওশন আরার গলার স্বরে বৃদ্ধাদের মত কাঁপুনি আছে। বয়স পঞ্চাশ-ষাটের মত।
রওশন আরা বিপরীত দিকের সোফায় বসে বললেন,
‘আপনি লেখক মানুষ। তাই দেরি করে আসলাম। বলুন তো কেন?’
‘বলতে পারছি না।’
তিনি হেসে ফেললেন।
‘লেখকরা কারো সাথে দেখা করতে গেলে বসার ঘরের সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। গল্পে সেটা বর্ণনা করার চেষ্টা করেন। আপনাকে সেই সময়টা দিয়েছি।’
‘চা-কফিও কী এজন্য কাজের লোককে দিয়ে বানিয়েছেন?’
‘না। আমি বানিয়েছি। চিনি দুধ পরিমাণমতো হয়নি জানি। আমি কখনো চা বানাই না। আপনার জন্য চেষ্টা করেছি।’
আমি আলাপের মাঝে গেলাম না। সরাসরি প্রশ্ন করলাম,
‘কেন ডেকেছেন?’
‘আপনিই বলুন। আপনাকে অনেকেই ডাকে। নিশ্চয় সবার ডাকে সাড়া দেন না। চিঠিতে আমার ছোট্ট একটা বাক্য নিশ্চয় আপনাকে এতদূর আনেনি। ঠিক বলেছি?’
‘হ্যা। আপনি চিঠি লিখেছেন অনেক পুরোনো একটা প্যাডে। প্যাডের কোনায় লেখা- আফসার জামান। আফসার জামান বিখ্যাত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার। তার প্যাডে কেউ চিঠি লিখে ডাকলে আমি কেন, প্রেসিডেন্ট স্বয়ং ছুটে আসবেন।’
রওশন জামান খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
‘রাজীব সাহেব।’
‘জ্বি।’
‘আপনাকে একটা গল্প বলার জন্য ডেকেছি।’
‘গল্পটা কী আফসার জামানকে নিয়ে?’
‘হ্যা। তবে আফসার জামানের চেয়ে আরেকজনের গুরুত্ব বেশি। গল্পে গল্পে চলে আসবে।’
‘কী গল্প?’
‘গল্প করার আগে আমরা লাঞ্চ করব। দুপুর পার হয়ে যাচ্ছে।’
‘লাঞ্চও কী আপনিই বানিয়েছেন?’
‘না। হরলাল প্রসাদ রান্না করে। হরলালকে আপনি দেখেছেন। যে গেট খুলেছে।’

লাঞ্চ খুব আহামরি কিছু নয়। পাতলা ডাল। দুই ধরণের ভর্তা। ঘিয়ে ভাজা শুকনো মরিচ। রুইমাছের একটা ভাজির মত কিছু। ক্ষুধায় সবকিছু অমৃত মনে হচ্ছে। অনেকদিন পর আয়েশ করে খাবার আনন্দ পেলাম।
রওশন আর চামুচ দিয়ে খাচ্ছেন। চোখের সানগ্লাস খোলেননি। পর্দা করার ব্যাপারটা খানিকটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে মনে হচ্ছে।
রওশন আরা বললেন,
‘আফসার জামান সম্পর্কে আপনার কোন জানাশোনা আছে?’
‘অল্পস্বল্প। অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন দীর্ঘকাল। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জগতে তিনি কিংবদন্তীতুল্য।’
‘তিনি কীসের উপর কাজ করতেন জানেন?’
‘না। তবে দুটো আর্টিকেল পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। একটা ছিল গিনিপিগ ইনহেরিটেন্সি নিয়ে। গিনিপিগের ক্রোমোসোমের ভেতর পিজিয়নের ক্রোমোসোম প্রবেশ করে একটা সংকর প্রজাতি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছে ছিল, গিনিয়ন নামে একটা নতুন প্রাণি তৈরি করবেন। গিনিপিগের শরীরের কবুতরের মত পাখা থাকবে এমন কিছু।’
‘কিছুটা তেমন। তবে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সবকটা গিনিপিগ অসুস্থ হয়ে জন্ম নেয়। প্রথম সপ্তাহেই সব মারা যায়। আরেকটা কী পড়েছেন?’
‘এন্টিবায়োটিক নিয়ে কী যেন কাজ করছিলেন।’
‘হ্যা। কাজটা শেষ করতে পারেননি।’
আমি আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘তার গল্পটা কী ছিল?’
রওশন আরা গল্পের এই পর্যায়ে থামলেন। আরেক কাপ চা নিয়ে আসলেন। বিস্বাদ চা। কিন্তু তার মুখভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে না তিনি পৃথিবীর জঘন্যতম চা খাচ্ছেন।
‘রাজীব সাহেব, এখন যে অংশটুকু বলব সেটা আপনার অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবে কোথাও খটকা লাগলে আপনি প্রশ্ন করবেন। খটকা কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করব।’
‘আপনি বলুন।’
রওশন আরা চায়ে চুমুক দিলেন। আমি মনোযোগ দিয়ে তার চা খাওয়া দেখছি।
‘আফসার জামান ঢাবি থেকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স করে অস্ট্রেলিয়ায় গেলেন। মেলবোর্ন ইউনিভার্স্টিতে পিএইচডি শুরু করলেন। প্রফেসরের নাম- জোনাথন ফরেস্ট। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ তাকে মাস্টারমাইন্ড বলা হয়। WHO যতগুলো প্রজেক্ট এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় করেছেন তার প্রত্যেকটাতেই তিনি টিমলিডার ছিলেন।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, পিএইচডি শুরু করার পর প্রফেসর ফরেস্ট তার অধীনস্থ ছাত্রের কাজকর্মে মুগ্ধ হলেন। এতটা মুগ্ধ হলেন যে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত জেনেটিক ল্যাব নিউ সাউথ ওয়েলসের গারভানে এন্ট্রি করে দিলেন।
আফসার জামানের জন্য ব্যাপারটা না চাইতে স্বর্গ পাবার মত। তিনি সারাদিন ল্যাবে পড়ে থাকেন। ছোটোখাট কিছু যৌথ প্রজেক্ট চালালেন। অল্পদিনেই কিছু রিসার্স আর্টিকেল লিখে বিজ্ঞানমহলে তাক লাগিয়ে দিলেন। নামে জোনাথন ফরেস্ট থাকলেও মূলত সবগুলো রিসার্স পেপার আফসার জামানের লেখা।
একাশি সালের দিকে একটা দূর্ঘটনা ঘটল।’
‘কী দূর্ঘটনা?’
‘আফসার জামানের মা দেশ থেকে চিঠি পাঠালেন। বাবা অসুস্থ। দেশে ফিরতে হবে।
আফসার জামান দেশে ফিরলেন। বাবা অসুস্থ কথাটা সত্য নয়। তার বাবা একমাস আগে মারা গেছেন। তাকে অন্য উদ্দেশ্যে ডাকা হয়েছে।
আফসার জামানের মা তার বোনের মেয়েকে ডেকে এনে বললেন,
‘এ হল তোমার হবু স্ত্রী। আগামীকাল তোমার বিয়ে। আফসার জামানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।’
‘কেন?’
‘তিনি আপাদমস্তক একজন বিজ্ঞানী। সারাজীবন জেনেটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার স্ত্রী তখন ক্লাশ এইটে পড়ে। অল্পশিক্ষিত কাউকে বিয়ে করবেন এমন ভাবতে পারছেন না। কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে করবেন না। মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন।
খারাপ মুহুর্তগুলো মাকড়সার জালের মত। একবার গায়ে লাগলে সহজে ছোটানো যায় না। সে রাতে তার মা মারা গেল।
সকালবেলা মাকে দাফন করার পর আফসার জামান মেয়েটাকে বিয়ে করলেন।’
গল্পের এই অংশে এসে আমি রওশন আরা জামানকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘সেই মেয়েটা কী আপনি?’
রওশন আরা স্পষ্ট জবাব দিলেন না। মৃদ্যু হাসলেন।
‘এই প্রশ্নের উত্তর গল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই জবাব দিচ্ছি না। তাতে কী অসুবিধা আছে আপনার?’
‘নেই। আপনি গল্প বলুন।’
রওশন আরা আবার গল্প শুরু করলেন।
‘সাতদিন পর আফসার জামান সস্ত্রীক অস্ট্রেলিয়ায় ফিরলেন।
আকস্মিক বিয়ের ব্যাপারটিকে প্রফেসর ফরেস্ট নিতে পারলেন না। কারণ তখন দু’জনে একটা যৌথ প্রজেক্ট শুরু করেছেন। রাগের সিম্পটোম হিসেবে আফসার জামানকে তিনি অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিলেন।
ঘরে নতুন বউকে রেখে তার দিন কাটতে শুরু করল ল্যাবে। গভীর রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরেন। নতুন বউকে দেখে তার মনে মায়া জন্মে। বিজ্ঞানের জটিলতা এবং সাংসারিক ভালোবাসার এক দ্বৈতস্বত্বা তার নিউরনে মধ্যে ঘুরে বেড়ায়।’
‘এরপর?’
‘তখন তিনি যৌথ প্রজেক্টের পাশাপাশি গিনিপিগের এক্সপেরিমেন্ট শুরু করলেন। কিন্তু ব্যর্থ। ইকুয়েশন ঠিকঠাক ছিল। গিনিপিগের ক্রোমোজোমের ভেতর পিজিয়নের জিনের মিশ্রণ তিনি নিজে করেছেন। কিন্তু বারংবার পরীক্ষা করেও সফল হলেন না। শেষ মুহুর্তে হাল ছেড়ে দিলেন।’
‘তার স্ত্রীর সম্পর্কে বললেন না?’
‘বলার মত তেমন কিছু নেই। অল্পবয়স্ক। তরুণী বধু। মন দিয়ে সংসার করছে।’
‘গল্প বলুন।’
‘সংসারের বয়স তখন আট বছর। তখন WHO এর একটা ফিল্ড ভিজিটে আফসার জামান কেনিয়া গেলেন। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ। এন্টিবায়োটিকের উপর একটা ফিল্ড সাইট সার্ভে। সার্ভে করে যখন দেশে ফিরলেন তখন তিনি উদভ্রান্ত মানুষ।’
‘কেন?’
‘তার সার্ভের উদ্দেশ্য ছিল- এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সি। ব্যাকটেরিয়ারা কীভাবে মানুষের দেহের ভেতর একাএকা নিজেদের বিবর্তন করে ফেলছে এই টাইপের একটা ব্যাপার।’
‘উদ্ভ্রান্ত কেন?’
রওশন আরা জামান চায়ে চুমুক দিলেন। ঠান্ডা চা। ঠাণ্ডা বিস্বাদ চাইয়ে কেউ এমন মুগ্ধতার সাথে চুমুক দিতে পারে জানা ছিল না। চায়ের কাপ রেখে খানিকটা উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,
‘লেখকরা কখন উত্তেজিত থাকেন বলুন তো? গল্পের প্লট পেলে নাকি গল্পটা লেখা শেষ করতে পারলে?’
‘প্লট পাবার পর।’
‘আফসার জামানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। একটা নতুন এক্সপেরিমেন্টের চিন্তা তখন তার মাথায়।’
‘কী এক্সপেরিমেন্ট?’
‘কীভাবে ব্যাকটেরিয়াল রেজিস্ট্যান্সি ঠেকাবেন, সেই চিন্তা। সবাই যখন অ্যাওয়ারনেসের উপর গুরুত্ব দিচ্ছিল, তখন তিনি ভাবলেন, এমন কিছু করা যায় না যাতে মানুষ জন্মই নিবে রেজিস্ট্যান্ট প্রতিরোধী অবস্থায়।’
‘ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। একটু ডিটেইল বলবেন?’
‘বলছি।
ধরুন, কোনোভাবে মানুষের ক্রোমোজোমের মধ্যে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে ব্যাকটেরিয়ার বিশেষ কিছু জিন স্থাপন করা হল। তখন কী হবে?’
‘কী হবে?’
‘একটা মানুষ জন্ম নিবে মানুষ হিসেবে। কিন্তু তার ক্রোমোজোমের ভেতরে থেকে যাবে ব্যাকটেরিয়ার জিন।’
‘তাতে লাভ?’
‘পিঁপড়া পিঁপড়াকে কামড়ায় না। জেনেটিক্যালি যে ব্যাকটেরিয়ার জিন বহন করছে তার ভেতর ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন করতে পারবে না। এই টাইপের জটিল একটা কিছু।’
‘এরপর কী হল?’
রওশন আরা গম্ভীর হয়ে গেলেন।
‘গিনিপিগ-পিজিয়নের প্রথম ম্যাসিভ এক্সপেরিমেন্টে তার ভুল ছিল। তাই গিনিপিগের মধ্যে ব্যাপারটা আনতে পারেননি। সাধারণত মানুষের মধ্যে কোন কিছু প্রবেশ করানোর আগে অ্যানিমেল টেস্ট করতে হয়। শতশত টেস্টের পর সেটাকে হিউম্যানে এপ্লাই করা হয়।’
‘জামান সাহেব কী করলেন?’
‘উনি সরাসরি মানুষের ভেতর এক্সপেরিমেন্ট করলেন?’
‘কোন মানুষ?’
‘তার সন্তানের ভেতর।’
গল্পের এই অংশটা ভয় পাইয়ে দেবার মত ব্যাপার। অ্যানিম্যাল টেস্ট ছাড়াই একটা মানুষ তার নিজের সন্তানের ভেতর ব্যাকটেরিয়ার জিন ঢুকিয়ে দিতে পারে সেটা অসম্ভবপ্রায়। আমি চোখ বড়বড় করে প্রশ্ন করলাম,
‘একজন মানুষ জন্ম নেবার পর নিশ্চয় তার মধ্যে জিন প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তিনি কীভাবে করলেন?’
‘ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের মাধ্যমে।’
‘টেস্টটিউব বেবি?’
‘হ্যা। তার স্ত্রীর শরীর থেকে ডিম্বানু এবং তার নিজের শুক্রানুকে টেস্টটিউবের মধ্যে ফার্টিলাইজেশন করলেন। তখনই জাইগোটের ক্রোমোসোম থেকে কিছু জিন সরিয়ে ব্যাকটেরিয়ার জিন ঢুকিয়ে দিলেন।’
‘ব্যাপারটা তো প্রায় অসম্ভব।’
‘হ্যা। একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটালেন। ধরুন, বর্ণের জন্য দুটো জিন থাকে। একটা বাবা থেকে আসে আরেকটা মা থেকে। দুটো জিন মুখোমুখি থাকে ক্রোমোজোমে। এদের অ্যালিল বলে। অ্যালিলের একটা বেশি শক্তিশালী। প্রকট। আরেকটা প্রচ্ছন্ন বা কম শক্তিশালী। যে প্রকট তার বৈশিষ্ট্য মানদেহে প্রকাশ পাবে।
তিনি এমন কিছু স্পেসিফিক অ্যালিল থেকে একটা করে জিন সরালেন। যে জিনটা প্রচ্ছন্ন সেটা সরালেন। সেখানে বসিয়ে দিলেন ব্যাকটেরিয়ার জিন।’
‘এরপর কী হল?’
‘আপনি কী অস্থির হয়ে যাচ্ছেন লেখক সাহেব?’
‘না।’
‘আপনার চোখ বড়বড় হয়ে আছে। আপনি চেয়ার থেকে হেলে এসেছেন।’
‘ব্যাপারটা যে ঘটতে পারে, আমার জানা ছিল না। হিউম্যানকাইন্ডের সবচেয়ে বড় একটা আবিষ্কার হতে চলেছে, এটা ভেবেই আমার মাঝে অস্থিরতা চলে আসছে। আপনি গল্প শেষ করুন।’
রওশন আরা হাসলেন।
‘আবিষ্কার সফল হয়নি। সফল হয়নি সেই ব্যাপারটা জানারও তিনি সুযোগ পেলেন না। আকস্মিক স্ট্রোক করে মারা গেলেন। তখন তার স্ত্রীর পেটে তিনমাসের বাচ্চা।’
‘গল্প কী শেষ?’
‘না। বাচ্চা জন্ম নিল। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায়। প্রিম্যাচিউর ছিল। সেভেন মান্থ। সাথে নানা ধরণের জটিলতা। জন্মের পর হাসপাতালে খুব দৌড়াদৌড়ি। ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিলেন। আধমরা বাচ্চাকে নিয়ে তার স্ত্রী ঘরে ফিরলেন।’
‘বাচ্চা এখন বেঁচে আছে?’
‘হ্যা।’
‘গল্প কী শেষ?’
‘না।’
‘আমাকে কেন ডেকেছেন?’
‘একটা জিনিস দেখাতে।’
‘কী জিনিস?’
‘বাচ্চাটাকে দেখাতে।’
‘বাচ্চা মানে? ত্রিশ পয়ত্রিশ বছরের বাচ্চা?’
রওশন আরা কিছু বললেন না। ক্লান্ত পায়ে সোফা থেকে উঠলেন। আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন তার পিছু যেতে।

বাড়ির ভেতরটা বিশাল।
বিশ পঁচিশটার মত ঘর। করিডোরে শেষ মাথায় একটা আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল। টানেলে লোহার সিঁড়ি। টানেলটা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে খুব বেশিদিন হয়নি বানানো।

টর্চ হাতে রওশন আরা নামতে শুরু করলেন।
টানেলে একটা সুক্ষ্ম শব্দ ভেসে আছে। গোঙ্গানির মত। আমি দীর্ঘকাল হাসপাতালে কাজ করেছি। ক্যাজুয়ালটির সময় ভয়ংকর আহত রোগীরা আসত। কিন্তু তাদের মাঝেও এমন ভয়ংকর আর্তনাদ আমি শুনিনি। আমার হাতের লোম দাঁড়িয়ে আচ্ছে। বামহাতের তালু দিয়ে ডানহাতের দাঁড়ানো লোমগুলো স্পর্শ করতে পারছি।
টানেলের ভেতর ভ্যাপসা গরম। একটা বিদঘুটে দূর্গন্ধ। দূর্গন্ধটাকে চেনাচেনা মনে হচ্ছে। পচা রক্তের গন্ধ।
রওশন আরা একটা লোহার দরজা পার হয়ে গেলেন। আমাকে থামতে বললেন। গন্ধটা আরো প্রকট হয়েছে। আমাকে ইশারা করে জানালা দিয়ে তাকাতে বললেন।
হাসপাতালে মাথার মগজ চুয়েচুয়ে পড়া রোগী দেখেছি। মুখের একটা অংশ থেতলে যাওয়া, চোখের গোলক ঝুলতে থাকা ভয়ংকর সব রোগী দেখেছি। কিন্তু আজ যা দেখলাম তার সাথে পার্থিব কোন পরিস্থিতির মিল হতে পারে না।
ঘরের ভেতর একটা বিশাল লোহার টেবিল। টেবিলে কুচকুচে কালো রক্তের মাঝে একটা মানুষের মত মাংসপিন্ড শুয়ে আছে। মানুষের সাথে মিল থাকার কারণ তার শরীরের উপরে নিচে দুটো হাত এবং দুটো পা দেখা যাচ্ছে। অস্বাভাবিক খাটো। টর্চের আলোয় দেখা যাচ্ছে হাতের আঙ্গুলগুলো সংখ্যায় কম। দুটো করে।
আলোর দিকে ঝট করে মানুষের মত জন্তুটা লাফ দিয়ে বসল। সারা শরীরের শুঁড়ের মত কী যেন নড়াচড়া করছে। মাথার অংশটা দেখে আমার গা গুলিয়ে যাচ্ছে। মুখ নেই। গালের মত পেশি দিয়ে বন্ধ। চোখের জায়গায় একটা মাত্র চোখ। মাথায় অল্পঅল্প চুলের উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে কিন্তু অদ্ভুত জিনিসটা হল তার মাথায় একটা শিং মত কালো রঙ্গের কিছু একটা গজিয়েছে।
আমি প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে প্রায় উন্মাদের মত টানেলের অন্ধকার ধরে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম। মস্তিষ্ক অস্বাভাবিক কিছু সহ্য করতে পারে না। আমার মস্তিষ্কও পারেনি। ধবধবে সাধা টাইলসের মেঝে বমি করে ভাসিয়ে দিলাম।
রওশন আরা আমার পাশে আসলেন। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। দাঁড়াতে পারছি না।
রওশন আরা আমার হাত ধরলেন না। হরলালকে ডাকলেন। হরলাল আমার হাত ধরে বসার ঘরে নিয়ে আসলেন।

‘আপনি ভয় পেয়েছেন?’
‘জ্বি। আপনি জানতেন না আমি ভয় পাব?’
‘জানতাম।’
‘তাহলে কেন ডেকেছেন?’
‘এই জিনিসটা দেখানোর জন্য।’
‘আপনি আমাকে বিনাকারণে দেখতে ডাকেননি। আরো উদ্দেশ্য আছে। স্পষ্ট করে বলুন।’
রওশন আরা এমন বিচিত্র পরিস্থিতিতেও হাসলেন।
‘আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা গল্প লিখবেন।’
‘কেন?’
‘আপনি যেটা দেখে ভয় পেয়েছেন, আমার ধারণা এটা বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার। সব আবিষ্কার নিখুঁত হয় না। এটাও হয়নি। কিন্তু পৃথিবীর এব্যাপারে জানার অধিকার আছে।’
‘গল্পে কেন লিখব?’
‘গল্পে লেখার কারণ হল মানুষ ব্যাপারটাকে পুরোপুরি বিশ্বাসও করবে না। আবার উড়িয়েও দিবে না। মানুষকে সত্যটা জানানোর প্রয়োজন হলে আমি পত্রিকায় নিউজ করতাম। তাতে সমস্যা আছে।’
বমি করার সময় গলায় ব্যাথা পেয়েছি। অনেক কষ্টে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘বাচ্চাটা কী জন্মের সময় স্বাভাবিক ছিল?’
‘হ্যা। সবকিছুই স্বাভাবিক। এসব পরে ঘটেছে।’
‘বিস্তারিত বলুন। শেষ করুন। আমি এখানে এক মিনিটও অতিরিক্ত থাকতে পারব না।’
রওশন আরা বললেন,
‘ওর নাম আজহার। আজহার জামান। হাসপাতাল থেকে ফেরার ছয়মাস পর সে সুস্থ হয়। স্বাভাবিক মানুষের মত বড় হয়। স্কুলে ভর্তি হয়। একটা সময় গ্রাজুয়েশন শেষ করে। এরপর শুরু হয় বিচিত্রসব ব্যাপার।’
‘যেমন?’
‘আপনাকে বললাম না, ক্রোমোজোমের দুটো জিনের মধ্যে ডমিনেন্ট জিনটা (প্রকট বৈশিষ্ট্য) মানুষের ছিল। প্রচ্ছন্ন জিনটা ছিল ব্যাকটেরিয়ার। ত্রিশ পর্যন্ত প্রকটের আড়ালে ব্যাকটেরিয়ার জিন প্রচ্ছন্ন ছিল। এখন ব্যাকটেরিয়ার জিনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে।
ব্যাকটেরিয়ার গঠন দেখলে বুঝবেন, তাদের হাত নেই, পা নেই, চোখ নেই। কিন্তু আজহারের সব ছিল। প্রচ্ছন্ন জিনগুলো প্রকট হবার সাথে সাথে তার মানুষের হাতগুলো ধীরেধীরে লোপ পেতে শুরু করে।
শুরুতে খাটো হতে শুরু করেছে। সাথে সাথে আঙ্গুলের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। একসময় আঙ্গুল-হাত দুটোই অদৃশ্য হয়ে যাবে। আপনি এখন যা দেখলেন সেটা মিড-স্টেজ। এরপর কী হবে?
হাত-পা না থাকলেও ব্যাকটেরিয়ার শরীরের অসংখ্য প্রবর্ধন থাকে। চলাফেরার জন্য। দেখতে চুলের মত। এদের ফ্ল্যাজেলা বলে। তার শরীরের এমন শুঁড়ের মত ফ্ল্যাজেলা গজাচ্ছে।
ব্যাকটেরিয়ার চোখ থাকে না। আজহারেরও চোখ অদৃশ্য হতে শুরু করল। প্রথমে একটা। আরেকটা বাকী আছে। সেটাও কিছুদিনের মাঝে অদৃশ্য হবে।
ব্যাকটেরিয়াদের মুখ নেই। খেয়াল করলে দেখবেন আজহারের মুখটা মাংস্পিন্ড দ্বারা ঢেকে গেছে।’
‘মাথায় শিং এর মত কী?’
‘ব্যাকটেরিয়াদের শরীরে একটা তীক্ষ্ম অংশ থাকে। নাম-পিলি। এটা দিয়ে তারা প্রাণিদের শরীরে আটকে থাকে। আজহার এখন ধীরেধীরে মানুষ থেকে ব্যাকটেরিয়াতে রূপান্তর হচ্ছে।’
‘আশ্চর্য! আশ্চর্য!’
‘আশ্চর্যের কিছু নেই। বিজ্ঞান এভাবেই কথা বলে।’
‘ব্যাকটেরিয়া তো মানুষের মত খাবার খায় না। আজহার কীভাবে বেঁচে আছে?’
‘এটা ইন্টারেস্টিং! ব্যাকটেরিয়া সবচেয়ে ভাল থাকে মানুষের রক্তে। আজহারকেও সেভাবেই থাকতে হয়। তার টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্তগুলো থেকে সে শক্তি নেয়।’
‘রক্ত পাচ্ছে কোথায়?’
রওশন আরা কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন। অতি অল্প সময়। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল কয়েকশ বছর তিনি কথা বলছেন না। নীরবতা ভেঙ্গে গেল এক সময়।
‘হরলাল প্রায়ই শহরে যায়। কিছু মানুষ আছে। যারা রক্ত বিক্রি করে। টাকা দিলেই ব্যাগভর্তি রক্ত পাওয়া যায়।’
আমি অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘আপনার কী মনে হচ্ছে না তাকে ডাক্তার দেখানো উচিৎ।’
রওশন আরা রেগে গেলেন। দ্রুত নিয়ন্ত্রণও নিলেন। খানিকটা কড়া গলায় বললেন,
‘আজহারের জন্মের সময় তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন তো আর কিছুই করার নেই। ডাক্তার ডাকলেই তাকে বন্দী করে রাখা হবে। ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার নামে যন্ত্রনা দেওয়া হবে। আমি এটা চাই না।’
‘সে তো মারা যাচ্ছে।’
রওশন আরা রেগে বললেন,
‘না। মারা যাচ্ছে না। তার রূপান্তর হচ্ছে। পুরোপুরি ব্যাকটেরিয়া-মানবে রূপান্তর হলেই পরিবর্তনটা থেমে যাবে।’
‘এরপর? তখন কোথায় থাকবে? কী খাবে? যদি লোকালয়ে আসে? আপনি কী বুঝতে পারছেন কী ঘটতে যাচ্ছে?’
রওশন আরা চুপ করলেন। হরলালকে ডাকলেন।
‘হরলাল, ডিনার রেডি করো।’

ডিনার টেবিলে আমি কিছু খেতে পারলাম না। গলায় প্রচন্ড ব্যাথা। অস্বাভাবিক শীত লাগছে। হাতের লোমগুলো এখনো দাঁড়ানো।
রওশন আরা খাবার টেবিলে চুপচাপ খেলেন। একটা শব্দও করলেন না। তার চোখে এখনো সানগ্লাস। চোখের ভাষা পড়ার সুযোগ নেই।
খাবার শেষ হরলাল আমাকে হাত ধরে রাস্তায় আনল। একটা রিক্সা ভাড়া করে উঠিয়ে দিল।
পুরোটা রাস্তা মাতালের মত দুলতে দুলতে আমি উত্তরা র‍্যাব অফিসে আসলাম। র‍্যাবের সার্কেল এসপি মোহন শিকদার আমার বন্ধুমানুষ। জরুরি মিটিং এ আছে। দশমিনিট পর ফিরবে। দশমিনিট দীর্ঘ সময়। দুই মিনিটের মাথায় আমি অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেলাম।

আইসিইউতে দশদিন থাকার পর জ্ঞান ফিরল।
অস্বাভাবিক দুর্বল লাগছে। জ্ঞান ফেরার পর আমি মোহনকে ফোন করলাম। ফোনেই হড়বড় করে পুরো ব্যাপারটা বললাম। মোহন চুপচাপ শুনল। এরপর গা দুলিয়ে হাসাহাসি শুরু করল।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমি সাভার গেলাম।
রওশন আরা জামান চুপচাপ বসে আছেন। আজ চা আসেনি। হরলাল আমাকে বসার ঘরে রেখে আবার বাইরে চলে গেল।
আমি প্রশ্ন করলাম,
‘একটা প্রশ্ন করতে এসেছি।’
‘আমি জানি।’
‘কীভাবে জানেন?’
রওশন আরা জামান বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘আপনি প্রশ্ন করুন। আমি নিজে উত্তর দিই।’
আমি শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আফসার জামান কী আপনার বাবা?’
রওশন আরা ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। চোখ সরু করে বললেন,
‘কেন এমন ধারণা হল?’
‘চিঠিতে রওশন আরা শব্দদ্বয়ের পর একটা বড় স্পেস রেখে জামান লেখা হয়েছে। জামান নামটির প্রতি আপনার একটা বিদ্বেষ আছে। মৃত স্বামীর জন্য স্ত্রীদের অভিমান থাকে না। থাকে সন্তানদের। নানাবিধ অভিমান থাকে। অভিমানের কারণ খুঁজতে হলে আপনার হাতের গ্লভস খুলতে হবে।’
রওশন আরা বিস্মিত হবার চেষ্টা করলেন। সানগ্লাসের জন্য ধরা গেল না। বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘গ্লভস কেন খুলব?’
‘সেদিন আমি বমি করে মেঝেতে পড়ে ছিলাম। হাত বাড়িয়েছি কিন্তু আপনি হাত বাড়াননি। কারন আপনার হাত ধরলে আমি বুঝে ফেলব, সেখানে পাঁচটা আঙ্গুল নেই।’
রওশন আরা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘আপনার এমন ধারণা কেন হচ্ছে?’
‘ধারণার পেছনে কিছু লজিক আছে। আপনাকে শুরুতে আমি আফসার জামানের স্ত্রী ভেবেছিলাম। এর কারণ আপনার বয়স। আপনার চেহারা আমি দেখতে পাচ্ছি না। তাই অনুমানে কিছুটা ভুল হয়েছে। আমি শুধুমাত্র গলার স্বর শুনতে পাচ্ছি। স্বর শুনে মনে হচ্ছে আপনার বয়স ষাটের মত। গলার স্বর মানুষের বয়সের হেরফের ঘটাতে পারে।’
‘এখন কী মনে হচ্ছে?’
‘আপনি শারিরীকভাবে অসুস্থ। তাই স্বর পরিবর্তন হয়েছে। কিছুটা কেঁপেকেঁপে কথা বলছেন। আপনার বয়স আজহারের সমান। চল্লিশ পয়তাল্লিশ হবে। আপনি আজহারের বোন।’
রওশন আরা চুপচাপ। কথা বলছেন না।
‘আপনি ঘরের ভেতর বোরখা পরে থাকেন। গতবার আমি আসবে জেনে আগে থেকে পরে থাকতে পারেন। কিন্তু এবার? আমি বলে আসিনি। অথচ আপনি এখনো বোরখা পরে আছেন। বোরখার অন্তরালে আপনার শারিরীক পরিবর্তনগুলো আপনি ঢেকে রেখেছেন।’
রওশন আরা রেগে গেলেন।
‘আফসার জামানের প্রথম সন্তান আজহার। গর্ভে থাকা অবস্থায় আফসার জামানের মৃত্যু হয়।’
‘তাতে সমস্যা নেই। যদি জমজ সন্তান জন্ম নেয় গর্ভে। আপনার মাঝেও কী ব্যাকটেরিয়াল জিনগুলো ডমিনেন্ট হচ্ছে?’
রওশন জামান তীব্রস্বরে বললেন,
‘না।’
‘আপনি সত্যটা লুকোতে চাচ্ছেন। কেউ গ্লভস পরে চামুচ দিয়ে খায় না। আপনি খান। আপনার সানগ্লাসটা এkবার খুলবেন? আমার ধারণা সেখানে একটা চোখ আছে। আরেকটা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তির ব্যাপারটা ঢাকতে আপনাকে সানগ্লাস পরে থাকতে হয়।’
রওশন জামান ভয়ংকররকম ক্ষেপে গেলেন। চিৎকার করে ‘হরলাল হরলাল’ বলে ডাকাডাকি শুরু করলেন। হরলাল ছুটে আসল।
ভয়ংকররকম ক্ষেপে গিয়ে হরলালকে বললেন,
‘লেখক সাহেবকে রেখে আসো। আর কেউ যেন এই বাড়িতে না ঢুকতে পারে।’

পরিশেষ

হরলাল প্রসাদ আমাকে দ্বিতীয়বারের মত রাস্তা পর্যন্ত রেখে গেল।
নিজে রিক্সা ডেকে তুলে দিল। শেষবারের মত আমি সাভার ত্যাগ করলাম।

তিনদিন পর দেশের সবগুলো জাতীয় দৈনিকে প্রথম পাতায় নিউজ হল।

সাভারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড।
অগ্নিকান্ডে বিখ্যাত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার আফসার জামানের পৈত্রিকবাড়ি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। পুলিশের ধারণা, বাড়িটি পরিত্যাক্ত ছিল। তার পুত্র-কন্যারা অস্ট্রেলিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা। তারা কখনোই বাংলাদেশে আসেনি।
পৈত্রিক বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল হরলাল নামের এক বৃদ্ধ। পুলিশ হরলালের অগ্নিদগ্ধ ডেডবডি ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পাঠিয়েছে।
_______________________________

AD..

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়