ডাক্তার প্রতিদিন

Published:
2020-05-24 15:25:50 BdST

ইদ সবিশেষমায়ের বামপায়ে শিকল পরানো হল


লেখকের ছবি


ডা. রাজীব হোসাইন সরকার
_________________________

মায়ের বামপায়ে শিকল পরানো হল।
দেড় সুত ঢালাই লোহার শিকল। বাবা নিজে ঢাকা থেকে কিনে এনেছেন। শিকল কেন ডানপায়ে লাগানো হল না, এ নিয়ে রীতিমত তর্কবিতর্ক হতে পারে। বাবা আমাকে সে সুযোগ দিলেন না। ফিসফিস করে বললেন,
‘বাবু, তোমার মায়ের ডানপায়ে ঘা আছে। দেখতে পাচ্ছ?’
‘হুম।’
‘শিকল লাগালে ঘায়ে পঁচন শুরু হতে পারে। বামেরটায় লাগালাম।’
মায়ের ডান পায়ের ঘা নিয়ে বাবার চিন্তার ব্যতিব্যস্ততা দেখে আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। বাবা নিজেও খানিকটা অস্বস্তিবোধ করলেন।
মায়ের পায়ে ঘা যে আজকেই প্রথম আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন নয়। দীর্ঘ আঠারো বছর আগে মায়ের পায়ে দড়ি পড়েছে। কখনো পাটের দড়ি, কখনো নাইলন। দড়ির টান লেগে পায়ের চামড়া ঘন কালো হয়েছে। শেষে বড়বড় ঘা হয়েছে।
মাস ঘুরছে ঘড়ির সেকেণ্ডের কাটার মত। দড়ি খোলা হয়নি। ঘন বর্ষা শেষে দড়িতে পঁচন ধরে। ছিড়ে যাবার উপক্রম হয়। তখন বদলে দেওয়া হয়। শেষবার দড়ি ছিড়ে মা পালিয়ে গিয়েছিলেন। অনেক খোজাখুজির পর খুজে পাওয়া গেল মাধবপুরে। পাড়ার ছোটছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে মাকে ঢিল ছুড়ছিল। একটা ঢিল লেগে মায়ের কপাল ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরছিল।
শিকলের আংটা লাগাতে লাগাতে বাবা বললেন,
‘বাবু, তোর মায়ের এ-কী হাল?’
‘কী হাল বাবা?’
‘জ্বর টর বাঁধিয়েছে মনে হচ্ছে। অবস্থা তো ভাল নয়। নরেন ডাক্তারকে খবর দে। একবার দেখে যাক।’
‘এখন ডাকব?’
বাবা কি যেন মনে করে বললেন,
‘থাক। কাল ডাকলেও হবে।’
বাবা যখন শিকল লাগানো শেষ করলেন তখন চারদিক অন্ধকারে ঝাপসা হয়ে এসেছে। পুকুর পাড়ের বড় তালগাছটার পাতায় সড়সড় করে শব্দ হল। গ্রামের মসজিদের মাগরিবের আজান ভেসে আসল। বুড়ো মুয়াজ্জিনের আজান। গলা কাঁপতে কাঁপতে বলছে, ‘আশশাহাদু-আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’ বড় ভীতিকর পরিবেশ।
চেয়ার পাতা হয়েছে উঠোনে। বাবা কিছুক্ষন চেয়ারে বসে ঝিম ধরে রইলেন। আমাকে বললেন,
‘বাবু এদিকে আসো।’
আমি এগিয়ে আসলাম। আমার মনে হল তিনি বড় ধরণের আত্মশ্লাঘায় ভুগছেন। এমনিতেই তিনি বেশ একমুখী। এখন তো খোলনলচে বদলে ফেলেছেন। নিজের চারপাশে চক্রবুহ্য তৈরি করে ফেলেছেন। কারো সাধ্য নেই এই বুহ্যের ভেতর ঢোকে।
‘পড়ালেখা শেষ তোমার?’
‘জ্বি।’
‘চাকরি বাকরি কিছু করছ?’
‘একটা পেয়েছি।’
‘বেশ তো। বেশ তো।’ বলে বাবা হাঁপাতে শুরু করলেন।
বাবা দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিলেন। কোথায় ছিলেন জানা নেই। নিখোঁজ হবার আগমুহুর্তে তাকে সুস্থ্যই মনে হয়েছিল। আজ তাকে হঠাৎ দেখে আমি চমকে গেলাম। বুড়ো মানুষের মত লাগছে। বয়সের ভারে খানিকটা নত হয়েছেন। আগের মত মোটা গলায় কথা বলতে পারেন না। অল্প কাজ করলেই হাঁপিয়ে যান। ধীরেধীরে নিজেকে প্রবীণ কচ্ছপের মত খোলশবন্দী করে ফেলছেন। আমাকে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
‘তোমার মাকে গাছের সাথে বেধে রাখা হয়েছে, এ ব্যাপারে তোমার মনে খেদ আছে?’
আমি মাথা ঝাঁকালাম। আমার মনে খেদ নেই।
বাবা বললেন,
‘গুড। কেউ পাগল হলে তার চিকিৎসা আছে। আমি সর্বধরণের চিকিৎসা করেছি। তোমার মা সুস্থ্য হয়নি। বরং ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাই তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। বুঝেছ?
‘জ্বি।’
‘সাধারণ পাগল চুপচাপ থাকে। তোমার মা থাকে না। হাঁসমুরগিও কাছে গেলে আছড়ে মেরে ফেলে। এই ব্যাপারটা খুব খারাপ।’
আমি কিছু বললাম না।
বাবা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেলেন। জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে হতাশায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত সৈনিকের মত মাথা নিচু করে উঠে গেলেন।
বাবা উঠে যাবার সাথসাথে মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হল। অনর্গল গালিগালাজ করছেন। একজন মহিলা মানুষের মুখে এমন জঘন্য ভাষায় গালি আসতে পারে আমি ভেবে পেলাম না। তিনি শিকল পায়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন। শিকলের মাথা বাঁধা আছে বকুল কাছের গোড়ায়। শক্ত গাছের গুড়ি। মা তেমন সুবিধা করতে পারলেন না।
মায়ের চেঁচামেচি দেখে নতুন মা ভয় পেয়ে গেল। দীর্ঘক্ষণ ঘরের দরজায় মাথা বের করে দেখছিলেন। ভীতসন্ত্রস্থ চোখে ঘরের ভেতরে ছুটে গেলেন।


মা অসুস্থ হন----যখন আমি বারো বছর। তপু নামের দুই বছরের একটা ছোট ভাই আছে। রানু তখনও পেটের ভেতর। রোগটা তখনই দেখা দিল। একদিন নানাবাড়ি থেকে মা ফিরলেন। সারাশরীর পানিতে ভেজা। চোখ আগুনের মত লাল। বাবা অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘তপু কোথায়?’
মা জবাব দিলেন না। ক্রমাগত নিজের সাথে কথা বলছেন। অসংলগ্ন কথাবার্তা। কোন সুনির্দিষ্ট অর্থ নেই।
দু’দিন পর তপুকে খুজে পাওয়া গেল শোলাগাড়ির বিলে। মা তাকে নানাবাড়ি থেকে ফেরার পথে বিলের এক ডোবায় চুবিয়ে মেরে ফেলেছেন। তপু পানির উপর ভেসে উঠেছে দুদিন পর। পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে।
নানাজান লোক পাঠালেন। মাকে ফিরিয়ে নিবেন। বাবা যেতে দিলেন না। আজন্ম বংশগৌরবে গৌরবান্বিত নানাজান নিজে আসলেন। বাবা সসম্মানে তাকে ফেরালেন।
মায়ের অসুস্থতার মাঝেই জন্ম নিল রানু। কী সুন্দর চোখমুখ। আটার মত ফর্সা। আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকালাম। পাশের বাড়ির ব্যাংকার চাচার বউ এসে বলল,
‘কী বাবু, তোমার বোনের হাত নাই কেন?’
চাচির কথায় আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তার চটুল ধাঁচের প্রশ্ন আমার চোখে জল এনে দিল। রানুর হাত নেই কথাটা মিথ্যা নয়। আবার পুরোপুরি সত্যও নয়। মায়ের পেট থেকেই তার ডান হাতের কবজি থেকে নেই। মনে হয় কেউ একজন ধারালো ছুরি দিয়ে সুন্দর করে কেটে রেখে দিয়েছে। ডাক্তার বলেছে, ব্যাপারটা স্বাভাবিক। নাড়ি প্যাঁচিয়ে যাওয়ায় হাতটা কাটা পড়েছে পেটের ভেতর।
রানু বড় হতে শুরু করল।
সে আমার একমাত্র কাছের জন। আমি বিস্মিত হয়ে খেয়াল করলাম, একহাতেই সে নিজেকে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে। আমাদের জন্য রান্না করছে। কাপড় ধুচ্ছে। এত চমৎকার কাজ হয়তো হাত থাকলেও করতে পারত না।
শুধু ঝামেলা বেঁধে যেত চুল আচড়ানোর সময়। মায়ের অবর্তমানে এই মাতৃকার্যটির দায়িত্ব নিতে হল আমাকে। আমি গভীর মমতায় রানুর চুলে তেল দিয়ে দিই। চিরুনীতে টান দিই।
রানু চোখের সামনে বড় হয়ে গেল। কলেজে যাতায়াত শুরু করল। কথাবার্তায় চলে আসল নারীত্ব। আগের মত ছোটাছুটি করে না। আমি যখন বকুলতলায় বসে থাকি, মাঝেমাঝে আমাকে এসে বলে,
‘বাবু, অনেক রাত হয়েছে। চল খেতে বস।’
বাবু ডাক শুনে আমি চমকে উঠি। মা আমাকে বাবু বলে ডাকতেন। রানুর গলার সাথে মায়ের গলার কি আশ্চর্য মিল!
রাত তার নিয়মে গভীর হয়। আমি চোখ বুজে গুনগুন করে গান গাওয়া এক নারীকণ্ঠ শুনি। বিমোহিত হই। বাবা একদিন আমাকে ফিসফিস করে বলল, রানুটা তার মায়ের গলা পেয়েছে। দেখেছিস বাবু?’
আমি কিছু বলি না।


মায়ের অসুস্থতার পর দীর্ঘকাল বাবা বিয়ে করেন নি। তিনি মাঝেমাঝে উদাস ও নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বকুলতলায় বসে থাকেন। আশ্চর্যজনকভাবে বাবা বসে থাকার সারাটা সময় মা শান্ত হয়ে থাকেন। তাকে বেশ স্বাভাবিক মানুষের মত লাগে। তিনি যে বাবাকে ভয় পেয়ে শান্ত থাকেন তেমন নয়।
বাবা মানুষ হিসাবে তেমন রাগী নন। নিরীহ ও নির্লিপ্ত ধরণের একজন দূর্বল মানুষ। ভয় পাবার পেছনে যুক্তি খুবই সামান্য। যে ঝড়ের আগে প্রকৃতি যত শান্ত থাকে, সে ঝড় তত ভয়ংকর।
বাবা একদিন এসে বলল,
‘রানুর কি বিয়ে দেওয়া উচিৎ নয়?’
আমি বললাম,
‘মাত্র তো ষোল বছর। এখন বিয়ে দিবেন?’
বাবা জবাব দিলেন না। তাকে বেশ বিভ্রান্ত মনে হল। একাএকা চলাফেরা করেন। সংসারে মনোযোগ নেই। বিভ্রান্তির অতল সমুদ্রে একজন মহীরুহকে চোখের সামনে ডুবে যেতে দেখা গেল। একদিন হঠাৎ তিনি উধাও হলেন। রানু সারারাত কাঁদল। বাবা ফিরলেন না। সেদিনই মা প্রথমবার কথা বললেন। শেষরাতে বললেন,
‘বাবু কোথায়? বাবু?’
আমি অস্থির হয়ে বের হলাম ঘর থেকে। মাকে বেশ স্বাভাবিক লাগছে। পায়ের দড়িটা হাতে ধরে স্বাভাবিক গলায় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘বাবুকে দেখেছেন?’
আমি কিছু বলতে পারলাম না। আশৈশব জেনে এসেছি, মা নামক বিচিত্র প্রজাতিটি তার সন্তানকে চিনতে ভুল করেন না। আমার মা ভুল করে ফেললেন। রানু হতাশ গলায় আমার হাত ধরে বলল,
‘এই আপনার বাবু?’
মা বলল,
‘তা কী করে হয়? বাবু তো ছোট।’
‘বড় হয়ে গেছে। এখন ছোট নাই। আমাকে চিনেছেন?’
মা হতাশ চোখে তাকালেন। চিনতে পারলেন না। বিড়বিড় করে বললেন,
‘না, চিনি না।’
রানু আমার পীঠে মুখ লুকিয়ে নিজেকে রক্ষা করল। ধরা গলায় বলল,
‘ভাইজান, মা কী আমাকে কোনোদিন চিনবে না?’
রানুর এই প্রশ্নের জবাব নেই আমার কাছে। আমার ভুঁইফোড় মস্তিষ্কে আসমান জমিন এক করে ফেলল। প্রশ্নের জবাব পেল না। রানু অভিমান করল। মারাত্মক অভিমানে সে বাড়ি ছেড়ে নানাবাড়িতে চলে গেল।
আমি একা হয়ে গেলাম। মা একা হয়ে গেল। সারাদিন দড়িবাধা পায়ে তিনি বকুলতলায় পড়ে থাকেন। যখন মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয় তখন চেঁচামেচি করেন। আশপাশে যে যায় তাকেই গালিগালাজ করেন। বর্ষায় ভিজতে ভিজতে মাঝেমাঝে জ্বর বাধিয়ে ফেলেন। আমি নিতান্ত বাধ্য হয়ে ব্যাংকার চাচীর সাহায্য নিয়ে মাঝেমাঝে কাপড় বদলে নিতাম। মায়ের শরীরে কাপড় থাকত না। সহস্র হাহাকারের মাঝেও এই ব্যাপারটি বিচ্ছিন্ন হাহাকারের মত দাঁড়িয়ে গেল।
একদিন চাচী চাপা কৌতূহলে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘বাবু, তোমার বাবার খবর জানো?’
‘না চাচী। জানি না।’
‘শুনলাম উনি নাকি বিয়ে করেছেন? এক গার্মেন্টসের মেয়েকে?’
ব্যাপারটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। বাবাকে আমরা চিনি। তার বিচরণ আমাদের চেনা গণ্ডির মাঝে। চাচী ফিসফিস করে বললেন,
‘পাশের গ্রামের আতিয়ার খবর আনছে। সেও নাকি তোমার বাবার সাথে গাজীপুরে থাকে।’
চাচীর সাথে কথা বলতে ভাল লাগছে না। বাবার বিয়ের ব্যাপারটি আলোচনা করা একজন পুত্রের নিকট জঘন্য লাগবে। স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি এড়িয়ে গেলেও চাচী এড়ালেন না। একদিন বললেন,
‘তোমার নতুন মায়ের বয়স নাকি বারো। শুনেছ বাবু?’
এই খবর আমি শুনিনি। আমার কাছে ব্যাপারটি অবিশ্বাস্যই লাগত। বাবা আর যাই করুক এমন একটি হাস্যরসের কারণ ঘটাতে পারেন না।


নানাবাড়ির লোকজন রানুর বিয়ে ঠিক করল।
ছেলের অবস্থা ভাল। সাতক্ষীরার কাছাকাছি একটা কলেজে পড়ায়। মা বাবা নেই। রান্নাবান্না করতেও কষ্ট করতে হয়। বিয়ের দিনেই রানুকে তুলে নিয়ে যাবে।
বিয়ে হচ্ছে নানার বাড়ীতে। রানুর বড় ভাই হিসাবে আমার দায় হল রানুকে পাত্রস্থ করা। বাবা নেই। এমন্তবস্থায় মাকে ছেড়েও আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।
একদিন রানু বাড়ি ফিরল। তাকে হাসিখুশি লাগছে। সারাক্ষণ মায়ের পাশে টুল নিয়ে বসে রইল। আমাকে জিজ্ঞাসা করল,
‘তুই কবে বিয়ে করবি দাদা?’
‘জানি না। সম্ভবত বিয়ে করব না।’
‘ভার্সিটির কোন ছাত্রীকে পছন্দ হয়নি?’
আমি জবাব দিলাম না। রানু খিলখিল করে হেসে বলল,
‘দাদাভাই লজ্জা পেলি? যা আর বলব না। এখনো মন খারাপ করে আছিস?’
আমি হেসে বললাম,
‘না পাগলী। মন খারাপ করিনি। তোর বরের বাড়ি কোথায়?’
রানু লজ্জা পেয়ে গেল। উদাস গলায় বলল,
‘সমুদ্রে।’
‘সমুদ্রে মানে কী?’
‘কোন মানে নেই। কলেজটা নাকি সমুদ্রের আশেপাশে।’
‘ভালোই হল তো। সুখে থাকার জন্য সমুদ্রের হাওয়া পথ্যসরূপ। আমাদের ভুলে যাবি?’
রানু আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করল। দীর্ঘদিনের চাপা কান্না বাধ ভেঙ্গে ধেয়ে আসল। আমি মাথায় হাত রেখে বললাম,
‘কাঁদছিস কেন রে পাগলী?’
রানু বলল,
‘দাদাভাই, মা কী কোনোদিন আমাকে চিনতে পারবে না?’
‘অবশ্যই পারবে।’
‘কবে পারবে?’
‘আমি জানি না।’
‘আমি তো চলে যাচ্ছিরে দাদাভাই। চলে গেলে চিনবে কীভাবে?’
আমি আরেকবার পরম প্রত্যাশীত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না।
রানু যখন জন্ম নেয় তখন মা তখন পুরোমাত্রায় অসুস্থ। কিছু চেনেন না, বোঝেন না। যাকে দেখেন তাকেই গালিগালাজ করেন। ক্লিনিকে মায়ের হাত পা বেঁধে রাখা হল। সেই ঘোর বিপদের মুহুর্তে জন্ম নিল রানু।
রানু ফিরে গেল দুপুরে। সেই বিকেলেই বাবা ফিরলেন। দুবছর পর।
বাবা বদলে গেছেন। বড় দাড়ি রেখেছেন। দাড়িতে মেহেদী। শার্ট ছেড়ে পাঞ্জাবী ধরেছেন। বাবা একা আসেননি। তার সাথে একজন অল্পবয়স্কা মেয়ে। তরুনী বলা ঠিক হবে। রানুর বয়সী। চোখভরা কৌতুহল। কৌতুহল নিয়ে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
বাবা বলল,
‘বিয়ে করেছি বাবু। আজ থেকে এ হল তোর মা।’
নতুন মাকে পরিচয় করে দেবার সময় বাবা চোখের দিকে তাকালাম। সংসারের প্রতি অতি মাত্রায় নিরাসক্ত এক মানুষের প্রতিচ্ছবি আমাকে আলোড়িত করল। আমি বললাম,
‘বাবা ভাল আছেন?’
বাবা জবাব দিলেন না। চেয়ার টেনে আঙ্গিনায় বসে ব্যাগ খুললেন। ব্যাগে নানান জিনিস। একটা লোহার শিকল। আমার হাতে ধরিয়ে বললেন,
‘দেড় সুতি লোহা। আর ছিড়বে না। চল তোর মায়ের পায়ে লাগাই।’
শিকলধারণ পর্ব সমাপ্তির পর বাবা ছোটমাকে সঙ্গে করে নানাজানের বাসায় গেলেন। কণ্যাদায়গ্রস্থ পিতার দায়িত্ব পালন করতে হবে।


রানুর বিয়ের রাতে মা আমাকে নাম ধরে ডাকলেন।
বাড়িতে কেউ নেই। আমি বিকেল থেকে বকুল তলায় টুল পেতে বসে আছি। মা স্পষ্ট গলায় বললেন,
‘বাবু।’
আমি মায়ের ডাক শুনে চমকে জবাব দিলাম,
‘কিছু বলবেন মা?’
‘তুই এভাবে মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন?’
‘মন ভাল মা।’
‘বাইরে শীত। ঘরে যা।’
‘শীত লাগছে না। আপনার কি শীত লাগছে মা?’
মা সেই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তাকে দুর্বল লাগছে। প্রচণ্ড রকমের অসুস্থ্য। টানা বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়া বাঁধিয়েছেন। ঘন শ্বাস নিচ্ছেন। শ্বাসের সাথে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে। মা ক্ষীন স্বরে বললেন,
‘আমার মেয়েটা কোথায়?’
‘কে মা? রানু?’
‘রানুই হবে হয়ত। ও কোথায়?’
‘রানুর আজ বিয়ে।’
মা কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। শব্দ করে কাশলেন। কাশি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ছেলে কী করে?’
‘কলেজে মাস্টারি করে।’
‘খুব ভাল। রানুর সাথে একটু কথা বলতাম।’
আমি প্রচণ্ড হতাশায় বসে রইলাম। মহাজগতিক দূর্ঘটনার মত অনিশ্চিত একটি মুহুর্তে মা স্বাভাবিক হয়েছেন। অতি দ্রুতই আবার বদলে যাবেন। কিছুক্ষনের মাঝে আর কিছু চিনতে পারবেন না। আমি সেই মুহুর্তের অপেক্ষায় বসে আছি।
মায়ের পরিবর্তনটা হল খুব দ্রুত।
তিনি বিড়বিড় করে কথা বলছেন। একটা পোকাকে কড়া গলায় গালিগালাজ করলেন। হালকা বাতাসে বকুল ফুল ঝরে পড়ছে। আমি ঝরা বকুলের তলে নির্বিকার হয়ে বসে রইলাম।

পরিশিষ্টঃ
বিয়ের রাতেই রানু সাতক্ষীরা চলে যায়। বাবা ছোট মাকে নিয়ে দ্বিতীয়বার উধাও হয়ে যান। সেদিন আকাশ জুড়ে অসংখ্য তারা উঠেছিল। উজ্জ্বল নক্ষত্রের রাতে সবহারাদের মিছিলে শামিল হন মা। ভোর হবার একটু আগে তিনি মারা যান।
_____________________

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়