Ameen Qudir
Published:2020-04-12 17:07:21 BdST
করোনার বিরুদ্ধে লড়াই এবং লন্ডনের বাসিন্দা বাংলাদেশী ডাক্তারের অভিজ্ঞতা
ডেস্ক
_______________________
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া লড়াইয়ের মাঝে কেমন আছেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডাক্তাররা। নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথাই শেয়ার করেছেন যুক্তরাজ্যের রয়েল লন্ডন হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহরিয়ার মো. সাদেক। তার লেখা জনস্বার্থে প্রকাশ হল।
ডাঃ শাহরিয়ার মোঃ সাদেক
কনসালটেন্ট সার্জন
রয়েল লন্ডন হাসপাতাল
লন্ডন , ইউ কে।
আজ থেকে প্রায় ৮ সপ্তাহ আগে হঠাৎ আমার মেইল বক্সে একটা “Urgent” flagged মেইল দেখতে পাই । মেইলের সারমর্ম তাৎক্ষণিক জরুরী মিটিং। মিটিং এ উপস্হিত হয়ে বুঝতে পারলাম কেমন যেন একটা থমথমে অবস্থা । মিটিং পরিচালনা করছেন হাসপাতালের ডিভিশনাল ডাইরেক্টর, যিনি একজন anaesthetist and intensivist. ভদ্রমহিলার বয়স ষাট ছুই ছুই , তাকে আমরা সবাই workoholic হিসাবে জানি।
খুবই authoritative type এর মানুষ। মিটিংএ উপস্হিত ছিলেন আমাদের chief executive officer( non clinical adminstrative chief).
৩০ মিনিটের মিটিংএ তিনি ( ডিভিশনাল ডাইরেক্ট র)প্রথমে খুব সংক্ষিপ্ত একটা presentstion দিলেন যার সারমর্ম ছিল মূলত হাসপাতাল কিভাবে covid 19 মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হবে এবং কি কি ব্যাবস্থা immediately গ্রহন করা হবে। তিনি হাসপাতালে ১০ সদস্যের একটা কমান্ড হাব গঠন করেন
যার কাজ হবে এই পুরো হাসপাতালের কর্মকান্ড সমন্বয় করা । সার্জিক্যাল ডিভিশন থেকে আমার ধূরন্ধর (!)কলিগরা আমাকে এই কমান্ড হাবে ঠেলে দেন। পুরো মিটিংএ আর কেউই খুব একটা কথা বলেনি । ওইসময় আমাদের হাসপাতালে কোন covid আক্রান্ত রোগী ছিলনা। আমাদেরকে তথ্য উপাত্ত দিয়ে বোঝানো হলো কি পরিস্থিতি আসন্ন।আরও বলা হলো কতো দ্রুত হাসপাতাল ফুল কেপাসিটি absorb করবে, ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেডের সংখ্যা কি পরিমান বৃদ্ধি করা হবে etc.
উল্লেখ্য ওই সময়টাতে ইউকের সবকিছু খুব স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল। সরকারের তরফ থেকে কোন সুনির্দিষ্ট directive ছিল না । কিন্তু আমাদের হাসপাতাল সহ লন্ডনের বেশীরভাগ হাসপাতাল ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। পুরো বিষয়টা আমার কাছে খুব বেমানান লাগছিল, মনে হচ্ছিল এত তোড়জোড়ের কি প্রয়োজন ! (স্বভাবগত বাংগালী চিন্তা) ।
এখানে বলে রাখি আমার হাসপাতালের বেড সংখ্যা প্রায় ৮৪৫, তার মধ্যে এডাল্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেডের সংখ্যা প্রায় ৫০( ইনটেনসিভ কেয়ার এবং হাই ডিপেন্ডন্সি ইউনিট মিলিয়ে ).আমাদের অপারেশন থিয়েটারের সংখ্যা প্রায় ২০টি। প্রত্যেক থিয়েটারে দুটি করে ভেন্টিলেটর আছে।
গতকালকের হিসেব অনুযায়ী আমাদের হাসপাতালে কোভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭৩২ জন । এর মধ্যে ৬২২ জন ওয়ার্ডে এবং বাকি ১১০ জন আই সি ইউতে।বলা বাহুল্য , শুধু মাত্র ৩টা থিয়েটার একটিভ রেখে বাকি সবগুলো থিয়েটারের ভেন্টিলেটরগুলো ব্যাবহর করে make shift ITU গঠন করা হয়েছে। গত ৪-৬ সপ্তাহে আমরা যে সব ইমার্জেন্সি measure নিয়েছি তা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরছিঃ
১) পুরো হাসপাতালের ওয়ার্ড সমূহকে কোভিড এবং নন-কোভিড জোনে ভাগ করা হয়। কোভিড উপসর্গ সম্পন্ন সকল রোগী দের কোভিড জোনে রাখা হয়, কোভিড ওয়ার্ড গুলোতে আবার দুই ধরনের bay arrange করা হয় । পজিটিভ পেশেন্টদের এফেক্টেড বে তে রাখা হয় । নেগেটিভ কিন্তু উপসর্গ সম্পন্ন রোগীদের ওই ওয়ার্ডের সাইডরুম বা আইজোলেসন বে তে রাখার ব্যাবস্থা করা হয়। পর্যায়ক্রমে বর্তমানে হালপাতালের প্রায় আশি শতাংশ capacity কোভিড জোনের অন্তর্ভুক্ত ।
২) সকল প্রকার elective clinical activity ( যেমন আউট পেশেন্ট ক্লিনিক , সাধারন নন ক্যানসার সার্জারী ও প্রসিডিওর ) পর্যায়ক্রমে বন্দ্ধ করে দেয়া হয়েছে । বর্তমানে energency life or limb saving intervention ছাড়া আর কোন ইনটারভেনশনই করা হচ্ছে না। উল্লেখ্য টেলিফোন কনসালটেশনের মাধ্যমে রোগী দের ফলো আপ বা নতুন আর্জেন্ট রেফারেল কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
৩) ক্যান্সার চিকিৎসা লিমিটেড করা হয়েছে , বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে শুধুমাত্র suitable candidate দের কেমোথেরাপি বা সার্জারীর জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে ( only if benifit outweighs the risk) .
যেক্ষেত্রে সম্ভব সেক্ষেত্রে চিকিৎসা ৮-১০ সপ্তাহের জন্য পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে ।
৪) সকল ধরনের ফিজিশিয়ানস and allied specialists দের কোভিড চিকিৎসায় পদায়ন করা হচ্ছে। শুধু মাত্র skeleton service maintain করে সার্জিকেল trainee বা জুনিয়র গ্রেডদের মেডিকেল ওয়ার্ড বা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে পদায়ন করা হচ্ছে। এইসব চিকিসকদের গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্রস্তুত করা হয়।
৫) অপারেশন থিয়েটার , এন্ডস্কপি, ওপিডি নার্স দের বেশীরভাগকেই ওয়ার্ড বা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে ডিপ্লয় করা হয়েছে।
৬) কমান্ড হাব থেকে পুরো বিষয়টা সার্বক্ষণিক ভাবে তদারকি করা হচ্ছে । ২ tier rota system adopt
করা হয়েছে যাতে একজন অসুস্থ হলে আরেকজন সাথে সাথে কাভার করার জন্য প্রস্তুত থাকে।
৭) এই সব ব্যাবস্থাকে আরো বেগবান করেছে বিভিন্ন প্রফেশনাল বডির প্রকাশিত গাইডলাইন্স।
BSG, Royal college of surgeons/ physician / anaesthetists, NMC সমূহ নিয়মিত ভাবে গাইডলাইন্স পাবলিশ এবং আপডেট করে যাচ্ছে ।
৮) কমান্ড হাবের মাধ্যমে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যাক্তিগত পর্যায়ে ও প্রতিনিয়ত হাসপাতালের স্টাফদের অভাবনীয় সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে ।
হাসপাতালের ওয়ার্ড গুলোতে ঢুকলে এখন মনে হয় যুদ্ধ ক্ষেত্র । পরিস্থিতির ভয়াবহতা লিখে প্রকাশ করা যাবেনা।
এখন আমি বাংলাদেশের চিকিসক , নার্স সহযোদ্ধাদের সাথে আমার কিছু ভাবনা শেয়ার করতে চাই। বাংলাদেশের জন্য এই মহামারী কী পরিমান বিপর্যয় ( scale of disaster) ডেকে আনতে যাচ্ছে তা এদেশের রাজনীতিবিদ, প্রশাসন কর্তাদের ধারনার উর্দ্ধে। চিকিসক হওয়ার সুবাদে আপনাদের পক্ষেই এই ভয়াবহতা আচ করা সম্ভব । এই যুদ্ধ শুধু আপনাদের দ্বারাই মোকাবেলা করা সম্ভব। এই মুহুর্ত থেকে আপনারা আপনাদের প্রস্তুত করুন। সরকারি হাসপাতালের পরিচালক , ডিপার্টমেন্টাল হেডবৃন্দগন বসে আপনাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করুন। প্রতিটি হাসপাতালে কোভিড জোন ডেভেলপ করেন যা প্রকোপ বৃদ্ধির সাথে সাথে হাসপাতালের সিংহভাগ capacity occupy করবে। ধীরে ধীরে নন-ইমার্জেন্সি , ইলেকটিভ interventions, routine outpatient activities কমিয়ে আনুন। Capacity compromised হতে শুরু হলেই emergency only policy adopt করুন।
যারা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, এনেস্থেটিস্ট, ইনটেনসিভিস্ট আছেন তারা সকল বিভাগের জুনিয়র , মিড লেভেল চিকিসকদের basic respiratory support প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করুন।
নিজ নিজ হাসপাতালে যে সব যন্ত্রাংশ অকার্যকর অবস্থায় আছে সেগুলো মেরামত সাপেক্ষে কার্যকর করার চেষ্টা করুন।
জীবন রক্ষাকারী adjuncts / medicines stock assess করে যতটুকু সম্ভব বৃদ্ধি করার চেষ্টা করুন।
বেসরকারিকারী হাসপাতাল পরিচালনা , চিকিৎসার সাথে অসংখ্য চিকিসক নিয়োজিত আছেন , আপনারা সাধ্যমত চেষ্টা করেন যাতে তারাও এই স্ট্রাকচারাল অ্যারেন্জমেন্ট ফলো করতে পারেন।
বিভিন্ন সার্জিকেল, মেডিকেল সোসাইটি সমূহ এব্যাপারে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিসিপিএস বাংলাদেশের কনটেক্সটে বিভিন্ন গাইডলাইন্স প্রকাশ করতে পারে যেটা উপেক্ষা করা স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের পক্ষে রীতিমত অসম্ভব হয়ে দাড়াবে। এই মুহুর্তে এই প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে ।
গত ২৪ ঘন্টায় ইউকে র মৃতের সংখ্যা প্রায় ১০০০,
এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকে তা এখনো ধারনাতীত। আজ বাংলাদেশ যে অবস্থানে আছে
ঠিক ৪ সপ্তাহ আগে UK সেই অবস্থায় ছিল। এই সহজ হিসাব করলেই বাংলাদেশের অবস্থা বুঝতে পারবেন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা তথাকথিত রোগ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো not mature enough to deal with such situation.
এদের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকলে এই ধ্বংসযজ্ঞ বহগুন বেড়ে যাবে।
এই সব প্রতিষ্ঠান বা রাজনীতিবিদদের তুলোধোনা করে কোন সমস্যারই বিন্দুমাত্র সমাধান হবে না।
এই সব নামসর্বস্ব ব্যাক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠান থেকে আপনাদের সামর্থ্য অনেক অনেক অনেক বেশী ।
আপনারা আপনাদের কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে যেভাবে এই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা আগলে রেখেছেন তা সত্যিকার অর্থেই এক দানবীয় প্রচেষ্টা । এই ভয়ঙ্কর সময়ে আপনারা হেরে গেলে এই দেশ আর কখনই মাথা তুলে দাড়াতে পারবেনা। যে যার যার অবস্থানে থেকে যতটা সম্ভব প্রস্তুতি নেয়ার চেষ্টা করুন।
অন্যান্য সকলকে আমার অনুরোধঃ আপনারা যে যেভাবে পারেন সকল হাসপাতাল, চিকিৎসক এবং নার্স দের সাহায্যে এগিয়ে আসুন। আগামী ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে প্রচুর সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এই যোদ্ধাদের যুদ্ধ করার জন্য যা প্রয়োজন তার সিকিভাগও সরকারের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। আপনাদের সাহায্য ছাড়া এই সুনামি কোন ভাবেই মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
আমেরিকা , বৃটেন স্পেন , ইটালীর কথা চিন্তা করুন। অসহায় বিপর্যস্থ । অসংখ্য মর্গ আর আর কবরস্থান প্রিপেয়ার করা হচ্ছে । এই ভয়ঙ্কর অবস্থায় ও মনকে চাঙ্গা করার মত কিছু খবর শুনি।
বৃটিশ সরকারের আহবানে ২০ সহস্রাধিক অবসরপ্রাপ্ত চিকিসক ও নার্স আবার কাজে ফেরার জন্য রেজিস্টার করেছে। সরকার আড়াই লক্ষ এন এইচ এস ভলান্টিয়ারের জন্য আহবান করেছিল তার বিপরীতে প্রায় ৮ লক্ষাধিক লোক আবেদন করেছে।
এই যুদ্ধকে আমাদের সবাইকে মিলে মোকাবেলা করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দ্বারাই এই মহাপ্রলয় থামানো সম্ভব ।
আপনার মতামত দিন: