রাহনুমা নুরাইন
Published:2025-09-19 16:27:43 BdST
ক্রনিক ডিজিজের ওষুধ উৎপাদন, সুলভ বিপণন এবং পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করুন
লেখক
ডা. আজাদ হাসান
________________
ক্রনিক ডিজিজের ঔষধের উৎপাদন, সুলভ মূল্যে বিপণন এবং পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা জানি যে, বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের শরীরে নানা ধরনের রোগ বাসা বাঁধে।
বয়স ৪০ পেরুলেই অনেকের শরীরে ডায়বেটিস (বহুমূত্র রোগ), হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ), হাইপারলিপিডিমিয়া (রক্তে মাত্রাতিরক্ত চর্বি), এজমা (হাফানী) এসব রোগের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। এসব রোগকে একসাথে ডাক্তারী ভাষায় "ক্রনিক ডিজিজ" বলে অবিহিত করা হয়। এসব রোগকে একেবার নির্মূল করা সম্ভব নয় তবে এই রোগ সমূহে নিয়ন্ত্রণ করে স্বাস্থকর জীবন যাপন করা সম্ভব।
রোগের কারণ ও প্রতিকারঃ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ক্রনিক ডিজিজ বা দীর্ঘস্থায়ী রোগের জন্য মূলত দায়ী হলোঃ (১) প্রাত্যহিক জীবনাচার (লাইফ স্টাইল), (২) খাদ্যাভ্যাস এবং (৩) বংশগত প্রভাব (জেনেটিক ইনফ্লুয়েন্স)। এসব রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে জেনেটিক প্রভাবকে পরিবর্তন করা না গেলেও রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে দৈনন্দিন জীবনাচার এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এ জন্য উল্লেখিত এদু'টি ফ্যাক্টরকে একত্রে মডিফাইয়েবল (বা পরিবর্তনশীল) ফ্যাক্টর (বা অনুগঠক) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এজন্যই নতুন ভাবে সনাক্তকৃত ক্রনিক ডিজিজ-এর রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথমে রোগীকে (১) রোগীর লাইফ স্টাইল এবং (২) খাদ্যাভাসে পরিবর্তন (মডিফিকেশন) করার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট সময় কাল রোগীর লাইফ স্টাইল এবং খাদ্যাভাসে পরিবর্তন (মডিফিকেশন) আনার পরও যদি অবজার্ভ করা যায় যে, রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায় নাই, সেক্ষেত্রে এর সাথে ঔষধ (বা মেডিসিন) যোগ করতে হয়।
ঔষধ উৎপাদন, বিপণন এবং সরবরাহঃ
যে কোন রোগের চিকিৎসায় ঔষধের যথাযথ ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিছু কিছু অসুখে অসুস্থতার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সময়ের জন্য ঔষধ সেবন করতে হলেও ক্রনিক ডিজিজ-এর রোগীদের ক্ষেত্রে রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আজীবন ঔষধ সেবন করতে হয়। এখানে একটা কথা বলা দরকার, ক্রনিক ডিজিজ-এর ক্ষেত্রে নিয়মিত ঔষধ না খেলে তাতে সমস্যা কি? জ্বী, ক্রনিক ডিজিজে নিয়মিত ঔষধ সেবন না করলে অনিয়ন্ত্রিত-হাইপার টেনশন এবং আন-কন্ট্রোল ডায়বেটিসের কারণে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা (কমপ্লিকেশন) দেখা দিতে পারে। যেমনঃ ক) হার্ট অ্যাটাক, খ) স্ট্রোক,
গ) কিডনীর সমস্যা, ঘ) রেটিনায় রক্ত জমাট বাধা, ঙ) গ্যাংগ্রিন সহ নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে।
এজন্য ক্রনিক ডিজিজ-এর রোগীদের নিয়মিত ঔষধ খাওয়া জরুরী। আর এ জন্য ঔষধ সিলেক্ট করার সময় আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ঔষধটি~
১) সহজ লভ্য হতে হবে।
২) সুলভ মূল্য হতে হবে।
৩) ইফেক্টিভ/কার্যকর হতে হবে।
৪) মার্কেটে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকতে হবে।
এ প্রসংগে আমি একটি ঔষধের নাম উল্লেখ করতে চাই, ঔষধটি হলো গ্লাইবেনক্লামাইড।
Glibenclamide, একটি Sulphonylurea গ্রুপের ঔষধ,
কিন্তু এই ঔষধটি বর্তমানে বাংলাদেশের কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। এই ঔষধটি ডায়বেটিস এর চিকিৎসায় সুলভ মূল্যে প্রাপ্ত একটি পরীক্ষিত (Time tested) মেডিসিন। এটা হঠাৎ করে বাজার হতে উধাও হয়ে গিয়েছে। বাজার হতে এই ঔষধটি হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার কারণ কি?
ফার্মেসী হতে বলেছে, "এই গ্রুপের ঔষধ নাকি এখন আর বাংলাদেশের ঔষধ কোম্পানি গুলো তৈরী করছে না।"
এ বিষয়টা নিয়ে আমি একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম~
"গ্লাইবেনক্লামাইড"- এর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং "Time tested" ঔষধ কেবল স্বল্প মূল্যের কারণে অতি মুনাফা লোভী ফার্মাসিউটিক্যাল উৎপাদন করতে আগ্রহী নয়। কারণ স্বল্প মূল্যের কারণে কোম্পানির কম লাভ হয়। আর এ কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ উৎপাদন বন্ধ করা কখনো কাম্য নয়। বরং এর উৎপাদন বন্ধ না করে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি গুলো সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে গ্লাইবেনক্লামাইড এর সাথে মেটফরমিন কিংবা সিটাগ্লিপটি অথবা লিনাগ্লিপটিন এর কম্বিনেশন বাজারে আনতে পারতেন।
সরকারের উচিত ক্রনিক ডিজিজের ঔষধের গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং যেহেতু এ জাতীয় ঔষধ রোগীদেরকে দীর্ঘ মেয়াদে খেতে হয় সেজন্যঃ
১) এ জাতীয় ঔষধ যাতে করে সুলভ মূল্যে বাজারে পাওয়া যায় সেজন্য ঔষধের মূল্য নির্দিষ্ট করে দেয়া। এবং
২) এ জাতীয় ঔষধ উৎপাদন করা প্রতিটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির জন্য বাধ্যতা মূলক করা।
৩) ক্রনিক ডিজিজের ঔষধের সার্বক্ষণিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
অনেকে গ্লাইবেনক্লামাইড- এর সাইড এফেক্ট হিসেবে "হাইপোগ্লাইসিমিয়ার" কথা উল্লেখ করেন। এ প্রসংগে আমার মত হলো,
১) ডায়বেটিস এর ঔষধ শুরু করার আগে রোগীকে যথাযথ ভাবে কাউন্সিলিং করতে হবে।
২) ঔষধ শুরু করার সময় প্রথমে লো-ডোজ দিয়ে শুরু করতে হবে।
৩) এই ঔষধটি যেহেতু খালি পেটে খাবার কথা অনেকে ঔষধ খাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খাবার না খাওয়ার কারণে "হাইপোগ্লাইসিমিয়া" হতে পারে।
আর এগুলো সবই ওভারকাম করা সম্ভব যদি রোগীকে ঠিক ভাবে কাউন্সিলিং করা যায়।।
সুতরাং যে কোন বিবেচনায় "গ্লাইবেনক্লামাইড"- এর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণের ঔষধ উৎপাদন বন্ধ করা উচিৎ নয়।
তাছাড়া ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানী সমূহ যাতে মান সম্মত ঔষধ উৎপাদন করে তা নিশ্চিত করতে হবে। ঔষধের মান মনিটরিং এর লক্ষ্যে,
বাজারে বিক্রীত ঔষধের স্যাম্পল দৈব চয়ন (বা রেন্ডম স্যাম্পলিং) এর মাধ্যমে সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষা করে মান যাচাই করতে হবে। কোন ঔষধ কোম্পানী মান সম্মত ঔষধ উৎপাদনে ব্যর্থ হলে, উক্ত কোম্পানীর বিরুদ্ধে জেল, জরিমানা এমন কি প্রয়োজন সাপেক্ষে কোম্পানী সীল গালা করে দেয়ার ব্যবস্থা সম্বলিত বিধি বিধান চালু করতে হবে।
পরিশেষে আর একটি বিষয়ে সদাশয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
১) প্রতিটি ফার্মেসী কোয়ালিফাইড্ ফার্মাসিস্ট দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।
২) প্রতিটি ফার্মেসিতে ফ্রিজার থাকতে হবে এবং নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় স্বার্বক্ষণিক ভাবে সমস্ত ঔষধ সংরক্ষণ ও মজুদ করতে হবে।
৩) সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে ঔষধ বিক্রি করতে হবে।
৪) রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ ডিসপেন্স করা চলবে না।
আপনার মতামত দিন: