Ameen Qudir

Published:
2020-03-15 14:32:18 BdST

"বাচ্চা এবরশান করা নিয়ে আমার বন্ধুর সঙ্গে ওর হাজবেন্ডের চরম তিক্ততা চলছে"


ডাঃ জোবায়ের আহমেদ

_____________________

শুধু শিক্ষিত নয়,মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন আপনার সন্তান কেঃ

বছর খানেক আগে আমার এক প্যানক্রিয়াটাইটিস এর রুগী সিলেট এর একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলো।

রুগীটার যখন পেটে তীব্র ব্যাথা শুরু হলো তখন প্রথমে আমার কাছে এসেছিলো।
সাথে সেই রুগীর ৭০ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা মা ছিলেন।
আমি যখন রুগীকে দেখছিলাম,তখন সেই মা কান্নাজড়িত কন্ঠে আল্লাহ এর কাছে বলছিলেন,হে আল্লাহ আমাকে নিয়ে যাও,বিনিময়ে আমার ছেলেকে কষ্ট থেকে মুক্তি দাও।।
সন্তানের ব্যাথা মা সইতে পারেন না।
মা তার জীবনের বিনিময়ে সন্তানের সুস্থতা ও আরাম কামনা করেন।

কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু ম্যাসেঞ্জারে নক দিলো। জানালো জরুরী কথা আছে।
আমি বললাম, বলো কি জরুরী কথা?

সে জানালো, অপ্রত্যাশিতভাবে সে এখন প্রেগন্যান্ট। ৭ সপ্তাহ হয়ে গেছে,ডাক্তার বলছে বাচ্চার কার্ডিয়াক এক্টিভিটি শুরু হয়েছে।

সে তৃতীয় বাচ্চার মা হতে প্রস্তুত কিন্ত তার উচ্চশিক্ষিত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্বামী এই বাচ্চা রাখতে চাননা।

বাচ্চাকে এবরশান করে নষ্ট করা নিয়ে আমার বন্ধুর ওর হাজবেন্ড এর সাথে চরম তিক্ততা চলছে।

বন্ধুর হাজবেন্ড এর দাবী, সে ৩৯ বছর বয়সে সুস্থ বাচ্চা জন্ম দিতে পারবেনা।

আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম,তুমি কি চাও?
সে বললো,আমি মরে গেলেও আমার বাচ্চা নষ্ট করবো না।
আমি তাকে যতদূর চিনেছি,সে বাচ্চার জীবন রক্ষা করতে লড়ে যাবে।

আমাদের বাসায় জান্নাতের ফুল নতুন মেহমান হয়ে এসেছেন।
আমার মা আমার মেয়ের একটু কান্না শুনলেই অস্থির হয়ে উঠেন।
আমার চিকিৎসক স্ত্রী বললো,বাচ্চাতো একটু কান্না করবে কিন্ত তোমার মা তাও সহ্য করতে পারেন না।
সন্তানের সন্তান, তার কান্নাও মা সইতে পারেন না।।

অনেক সময় বাচ্চা রুগীগুলো কে ক্যানুলা করা লাগে।
ক্যানুলা করার সময় মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখি বাচ্চার মা কান্না করে একাকার।
বাচ্চার হাতে বা পায়ে ২৫ G সাইজের ছোট্ট ক্যানুলার আঘাত মায়ের অন্তরে পাহাড় সম যন্ত্রনা হিসেবে অনুভূত হয়।
সন্তানের সামান্য কষ্ট মা জাতি সইতে পারেন না।

আমার স্ত্রী মা হয়েছেন ১১৪ দিন হলো।
বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিডিং করানোর সময় সে মাঝে মাঝে চিৎকার দিয়ে ব্যাথায় কোকিয়ে উঠে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে,তখন বললো, তোমার মেয়ে দাতের মাড়ি দিয়ে নিপলে কামড় দেয়।
খুব ব্যাথা লাগে।
আমি চেয়ে দেখলাম,ব্যাথা পেয়ে সে মেয়েকে আরো বেশি আদর করে দুষ্ট মেয়ে বলে।।

ব্যাথা পেয়েও হাসি দেয় যে জন, সেই মা।।
মেয়েটা আমার দিনে ঘুমাবে সারাদিন, রাত জেগে থাকবে,তাকে নিয়ে আবার বসে থাকা যাবেনা,হাঁটতে থাকতে হবে,বসলেই এমন চিল্লানো শুরু করে, মাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়।

আমি এক রাত থেকে দেখেছি,ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হতে হতে ঘুমিয়েই পড়লাম কিন্ত ঠিকই সকাল ৮ টা পর্যন্ত সে জেগে রইলো।

মায়েরা সন্তানকে রেখে ঘুমিয়ে যেতে পারেন না বুঝলাম।

মা এর কথা লিখে শেষ করা যাবেনা।

এই কথা গুলো লিখার একটা উদ্দেশ্য আছে।

কিছুদিন আগে মুম্বাইয়ের অভিজাত পাড়ায় দশতলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ ১৭ কোটি টাকা দামের ফ্লাটে ১০ মাস আগে মরে কঙ্কাল হয়ে পড়ে ছিলেন এক মা।
উনার উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত একমাত্র ছেলে আমেরিকাতে ইঞ্জিনিয়ার।

ছেলে মস্ত বড় হয়েছে,ব্যস্ততা অনেক।
শেষ ১৫ মাস আগে মায়ের সাথে ছেলের টেলিফোনে কথা হয়েছে।
আর ১৫ মাসে ছেলে এক মিনিট ফোন করে মায়ের খবর নেওয়ার ফুরসৎ পাননি।

আমি হতবাক হলাম,বিস্মিত হলাম,মর্মাহত হলাম,ক্রুদ্ধ হলাম এমন ঘটনা দেখে।

মায়ের আকুলতা ছিলো একমাত্র ছেলের কাছে, হয় উনাকে আমেরিকায় নিয়ে যাবে নতুবা দেশে কোন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে।

ছেলের সময় হয়নি দেশে এসে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার।

এই শিক্ষা, এই প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে ধিক্কার জানাই।

যে লোক মা কেই চিনলো না, তার তো সবই শুন্যতায় ভরা।
তার সবই অন্ধকার।।

মা হলেন জীবনের আলো।
এই একটা মানুষ শতভাগ নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদের জন্য সব যাতনা সয়ে আমাদের মায়া ও ভালবাসায় আগলে রাখেন।

যখন এই মানুষটার একটু মায়া দরকার তখন আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি দুনিয়া নিয়ে, সেই মানুষটাকে বিস্মৃত হয়ে যাই।

পোড়া কপাল সেই সব সন্তানদের।
বড়ই দূর্ভাগা তারা।।

যেসব মা বাবা সন্তানকে মানুষ না বানিয়ে শিক্ষিত বানাতে,প্রতিষ্ঠিত করতে দিনরাত উঠেপড়ে লেগে আছেন, তারা মুম্বাইয়ের আশা সাহানী নামের মায়ের জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।।

আপনার সন্তানকে শুধু শিক্ষিত করে তুলবেন না,সাথে মানুষ হিসেবেও গড়ে তুলবেন।।

ডাঃ জোবায়ের আহমেদ।
সিওমেক ৪২
সেশন ২০০৩-০৪

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়