Ameen Qudir

Published:
2020-03-05 00:34:17 BdST

মৌলবাদের রকমফের : মূল কারণ হীনমন্যতা, আত্মকরুণা, আত্মমর্যাদার অবমূল্যায়ন


রাজিক হাসান
_____________________

আমার এক প্রবাসী অধ্যাপক বন্ধু সেদিন আমার উপর বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে ফেসবুকের বন্ধু তালিকা থেকে আমাকে বাদ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন ফেসবুকে আমার লেখালেখি তাকে অনেক ক্ষুব্ধ আর বিরক্ত করে তোলে। সারা জীবন তিনি যে চিন্তাগুলো লালন করেছেন, যেগুলোর উপর ভিত্তি করে তিনি জীবনের একটি সফল ও মধুর পরিসমাপ্তীও টানতে চান, তাঁর সেইসব মৌলিক চিন্তার খুঁটিতে নাড়াচাড়া লাগে আমার এইসব ছাইপাশ লেখা পড়লে। আমার লেখাগুলো তিনি আর পড়বেন না। বন্ধু হিসেবেও তিনি তাঁর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তিনি একা নন। পুরোনো পোস্টগুলোতে গেলে দেখি আগে পড়তেন এমন অনেকেই আমাকে বন্ধু তালিকা থেকে বিদায় করে দিয়েছেন।

আমরা যতই মুক্ত চিন্তার বুলি আওড়াই আধুনিক শহুরে সমাজে শিক্ষা, ক্রিকেট, প্রেম, সমাজ, সরকার সবকিছু সম্পর্কে অন্ধবিশ্বাসকে জিয়িয়ে রাখার একটি নতুন সংস্কৃতি শুরু হয়েছে আমাদের। যেমন বুয়েট বা মেডিক্যাল জ্ঞান ও সফলতার ভিত্তি, পুলিশ খারাপ, সরকার অথর্ব, রাজনিতীবিদ মানেই চোর,বদমাশ ইত্যাদি ইত্যাদী। এই সরল অন্ধবিশ্বাসীরা যখন জীবনে প্রথমবার কোন অস্তিত্বের সংকটে পড়ে, তখন সে নিজেকে সমর্পিত করে ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসে। কিন্তু এই সরল অন্ধবিশ্বাসের কারনটি কি? কারনটি বিমূর্ত বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনায় অক্ষমতা। জীবনের বাস্তবতার জটিল বিষয় সম্পর্কে ধারণা করতে তল না পাওয়া। তখন উপায় হল চিন্তা ভাবনায় সমাপ্তি টেনে প্রচলিত অন্ধ চিন্তায় বিশ্বাস স্থাপন করা।

মৌলবাদ শব্দটির সাধারণ অন্য অর্থ হল মূলজাত। যে মূলজাতকে আঁকড়ে থাকে সেই মৌলবাদী। মৌলবাদ আসলে চিন্তার বন্ধ্যাত্বতা। যদিও আদি কাল থেকেই ধারনাটি শুধু ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। মৌলবাদের মূল কারণ কিন্তু অশিক্ষা নয়। মৌলবাদের মূল কারণ হীনমন্যতা, আত্মকরুণা, আত্মমর্যাদার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি। . ধর্মের নামে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছা, অথবা কোন গুরুজী বা পীরের ভক্ত হয়ে উচ্চমার্গীয় অনুভুতিপ্রাপ্ত হওয়া বা কোন সস্তা আবেগের গল্প লেখকের প্রচন্ড ভক্ত হয়ে যাওয়া, অথবা কোন বিখ্যাত বিজ্ঞানী বা দার্শনিককে গুরু মেনে তাদের অনুকরণ করার চেষ্টা অথবা কোন রকস্টার বা ফিল্মস্টারের অতিভক্ত হওয়া বা পশ্চিমা পুঁজিবাদী চাকচিক্যকে চরম সাফল্য মনে করা, অথবা এ যুগেও মার্কস-এঙ্গেলসের সমাজতন্ত্রকে মুক্তির একমাত্র পথ মনে করা, বুয়েটকে জ্ঞানের আর বিসিএসকে সফলতার ভিত্তি বলে মনে করা - এগুলো আসলে মনোবৈজ্ঞানিক দিক থেকে একই। সেটা হচ্ছে সফল, জনপ্রিয় ও ক্ষমতাশীলের সাথে একাত্মবোধের আগ্রহ। যার মূল কারন হচ্ছে নিজের বিচারবুদ্ধি, অবস্থান ও অস্তিত্বের প্রতি অনাস্থা।

আমরা দশমিক পদ্ধতি আবিষ্কার করছি, বাইনারি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি কিন্তু তাতে আমরা গর্বিত না। পশ্চিমারা সেই গণিত প্রয়োগ করে কম্পিউটার বানিয়েছে আর চীনারা সেটা নকল করে তা সস্তা করেছে। আর আমরা আমাদের গৌরব হারিয়েছি। কেন হারিয়েছি ? কারণ জাতীর মেরুদন্ডের কারিগর সেই শিক্ষকেরা আজ জ্ঞানের গর্বে গর্বিত নন। তাদের জানা নেই বোধের গৌরব দিয়ে ভোগের ব্যাধী তাড়াতে। চারিদিকে শুধু ভুয়া মূল্যবোধের কচকচানি। এই যে ভূয়া মুল্যবোধের আগ্রাসন – এর দায় অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় আর শিক্ষকদের নিতে হবে। তারাই প্রথম নিজেদের চিন্তাশক্তির গৌরবকে ঠেলে ফেলে বস্তুগত গৌরবে আত্মসমর্পন করছে। কেউ জ্ঞানী হতে পারেন আবার কেউ জ্ঞান সংগ্রহ করতে পারেন। দুটো বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। জ্ঞান সংগ্রাহকদের চাপে জ্ঞানীরা বিলুপ্ত আজ। ওমর খৈয়াম এর গল্পের সেই গাধার মতন, যে গাধা ইঁটের বোঝা পিঠে নিয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মিয়মান দালানে ঢুকতে লজ্জা পাচ্ছিল এই কারনে যে যদি তার সহকর্মীরা তাকে চিনে ফেলে? কারন আগের জন্মে সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিল।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়