Ameen Qudir

Published:
2020-03-03 16:03:25 BdST

একটি মৃতপ্রায় নদীর উৎস সন্ধানে


দেবব্রত তরফদার
প্রখ্যাত মরমী কথাশিল্পী  
_______________________

গ্রাম ছেড়েছি ১৯৯২ সালে মানে আঠাশ বছর হল । আগের প্রজন্মের মানুষ মানে বাবা জেঠু কাকুরা চাষ এবং বাসের জমি বিক্রি করে চলে এসেছেন ।শতাধিক বিঘা জমির এক ছটাকও অবশিষ্ট নেই । ভাবতে অবাক লাগে এঁদের কখনো আক্ষেপ করতেও দেখিনি। মানে নিজেরাই শিকড় উপড়ালে আক্ষেপ থাকবেই বা কেন। সবাই তো সমান নয় তাই বার বার ফিরে ফিরে যাই।
পুরোনো মুখের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসে । আসবেই তো নিজেই তো প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায়। আর নতুন মুখের মেলা । আমি সেইসব নুতন মুখের মধ্যে পুরোনো মুখের সামঞ্জস্য খুঁজি । তারপর কখনো কখনো অনুমান সঠিক হয়। চেহারা গলার স্বরে আগের পরের প্রজন্মের মিল থাকে বৈকি।
অনেকদিন পর আবার গ্রামে গেলাম। নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য না থাকলেও এবার একটি উদ্দেশ্য ছিল। যে নদীটি আমার গ্রামকে ঘিরে আছে সেটি আসলে বড় একটি বিল কিন্তু দৈর্ঘ্যে মাত্র আঠেরো কিলোমিটার হলেও প্রস্থে অনেক বড় নদীকেও হার মানায়। বর্ষায় টইটম্বুর আর সারাবছর টলটলে জল। গ্রাম থেকে শহরে এসেছি ন বছর বয়সে । তাই এই নদীর আসল উৎস এর বিস্তার এর তীরবর্তী গ্রামের সংখ্যা সম্পর্কে প্রায় ধারণা ছিলনা , যা ছিল তা সঠিক নয়। ১৯২৮ সালে আমার ঠাকুরদা এই বিলটি লিজ নেন । ১৮ বছর মাছের ব্যবসা করার পর ১৯৪৬ সালে তাঁর চার পুত্রের নামে বিলটি ক্রয় করেন । সঙ্গে অবশ্য একজন অংশীদার ছিল। আমার পিতৃদেবের ছোটবেলা কেটেছে ওই মাছের ব্যবসা করে । কাজে কাজেই স্কুলের গন্ডি পেরোনোর সময় হয়নি তাঁর । নদীটির মালিকানা আসার পরের বছরই দেশ স্বাধীন হয় । তিন বছর পরেই ঠাকুরদার মৃত্যু । বড়জেঠু ছিলেন একটু ভোলেভালা মানুষ । কাজেই বাবার উপরই জমি আর বিল দেখার ভার পড়ে কেননা ওই পার্টনার তখন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। এর পর ভূমি সংস্কার আইনে সরকারের বিল অধিগ্রহণ এবং কোর্টে প্রমাণিত হয় এটি একটি নদী , বিল নয় । কাজেই লোয়ার কোর্টে পরাজয় অবশেষে মালিকপক্ষ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় । ফল আর কি হবে লক্ষ লক্ষ সিদ্ধান্তহীন মামলার মত সবই চাপা পড়ে আছে।
বর্তমানে কালের চক্রে শ্রীহীন নদীটি চিরকালের মত এখনো আমার স্বপ্নে আসে । ঠাকুর্দাকে কোনোদিন দেখিনি । এমনকি কোনো ছবিও নয় । কিন্তু উনি ছিলেন এই অঞ্চলের একটি মিথ । ছোটবেলায় বয়স্কদের মুখে যে গল্পকথা শুনেছি তাতে তাঁর একটি ছবি তৈরি হয়েছে মনে । যে ছবি এখনো পর্যন্ত অমলিন। আমার ছেলেবেলা কেটেছে এই গ্রামে । এখানকার প্রকৃতি মানুষ গাছপালার প্রতি আজন্ম ঋণ রয়ে গেছে । আমি ভুলতে পারিনা আমার ঠাকুরদা এখানকার মাটিতে নুতন জীবন শুরু করেছিলেন অন্য স্থান থেকে এসে । বাবা জেঠুর ছোট বেলা কেটেছে , মা জেঠিমার নুতন সংসার শুরু হয়েছিল । একবার ঋণ শোধের চেষ্টা করলে ক্ষতি কি । লিখি না কেন এই নদীর তীরের বাইশটি গ্রাম , সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন । রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক আর জীবনধারার পরিবর্তন আর নদীটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক মূল্যবোধের মৃত্যুর । এইসব কথা মানুষের সামনে তুলে ধরতে চাই।
মনের ইচ্ছে জানাতেই গ্রামের মানুষজন খুবই খুশি । বৃদ্ধ মানুষজনের মুখে অনাবিল হাসি । কি করতে পারব জানিনা তবে এদের কথায় মনে হল তারা মনে করছেন তাদের যোগ্য প্রতিনিধি পেয়ে গেছেন বোধহয় । তথ্য নিতে তাই আবার গ্রামে পাড়ি । আমার প্রথম শিক্ষক বনমালী দাদার বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই । বয়স এখনো গ্রাস করতে পারেনি এই লড়াকু মানুষটিকে । তার পুত্র বিধান যে আমার ছাত্র , তা এরা দুজনে অনেক তথ্য দিলেন । একেবারে নদীটির মানচিত্র এঁকে তার দুধারের গ্রামগুলি বসিয়ে । বিধানের অঙ্গীকার তার কাকুর কাজে সবসময় তাকে পাশে পাব । দরকার হলে সামিল করবে বর্তমান প্রজন্মকে । প্রয়োজন হলে জান লড়িয়ে দিতে পিছপা নয় । নদীটির ধারে ঘুরে শুধু যন্ত্রনা বাড়ে । বিধান এযুগের শিক্ষিত গ্রাম্য যুবক । কিভাবে গ্রাম শহরকে গ্রাস করছে সে সম্পর্কে নতুন তথ্য পেলাম এবং ওর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত । যা খুবই মূল্যবান মনে হয়েছে । আজ নয় ভবিষ্যতে এই বিষয় নিয়ে লিখব। এখনই উত্তেজনা হচ্ছে । আমার দিদিরা আমার উদ্যোগে খুব খুশি। উপন্যাস লেখার সাহস দেখাতে পারিনি কোনোদিন। দেখিনা একবার চেষ্টা করে।

_________________________

দেবব্রত তরফদার
প্রখ্যাত মরমী কথাশিল্পী

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়