Ameen Qudir

Published:
2020-03-03 14:51:51 BdST

মার্চ সবিশেষ পাকিস্তানে কয়েক প্রজন্ম ধরে থাকা বাঙালিরা কেমন আছেন: বিবিসির প্রতিবেদন


করাচী থাকেন বহু বাঙ্গালি। কয়েক প্রজন্ম ধরেই। ছবিগুলো বিবিসির সৌজন্যে

মোহাম্মদ হানিফ
লেখক এবং সাবেক সম্পাদক, বিবিসি উর্দূ

______________________

ধরা যাক আপনি করাচীতে বাস করা চতুর্থ প্রজন্মের এক বাঙালি। এমন সম্ভাবনাই বেশি যে আপনি গরীব। কিন্তু আর যে কোন গরীব মানুষের মতই আপনি আপনার সন্তানদের পড়াশোনা করাতে চান।

ধরা যাক, আপনি ভাগ্যবান, কারণ আপনার মেয়ে যে কেবল পড়াশোনায় আগ্রহী তাই নয়, একই সঙ্গে সে 'সিটিজেন্স ফাউন্ডেশনের' পরিচালিত স্কুলে বিনামূল্যে পড়াশোনারও সুযোগ পায়।

মেয়েটি তার পড়াশোনায় বেশ ভালো করছে। ক্লাসের সেরা ছাত্রী। সে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। অথবা কোনদিন মার্ক জাকারবার্গও হতে চায়। তার এই স্বপ্ন দেখা আপনি বন্ধ করতে পারেন না। মেয়েটি নবম শ্রেণীতে উঠলো। কিন্তু এতদূর আসার পর মেয়েটিকে বলা হলো সে দশম শ্রেণীতে বোর্ডের পরীক্ষা দিতে পারবে না, কারণ তার কোন জাতীয় পরিচয়পত্র নেই।

আপনার বাবা-মার জন্ম এখানে, আপনার দাদা-দাদী বড় হয়েছে এখানে। কিন্তু তাতেও কিছু আসে যায় না। আপনার বাবার হয়তো একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল। আপনাকেও হয়তো একটি জন্ম সনদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যখন ন্যাশনাল ডাটাবেজ এন্ড রেজিস্ট্রেশন অথরিটি (নারডা) প্রতিষ্ঠা করা হলো, এটি কম্পিউটারাইজড পরিচয়পত্র চালু করলো। এই নতুন পরিচয়পত্র নাগরিকত্ব আইন লঙ্ঘন করে আপনাকে উধাও করে দিল সরকারি রেকর্ড থেকে।

আপনার সন্তানের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গেই, কারণ সে কোনদিন দশম শ্রেণীর পরীক্ষায় আর বসতে পারবে না।

ধরা যাক আপনি এক বাঙালি তরুণ। জীবিকা নির্বাহের জন্য আপনার আর কিছু জানা নেই, কিন্তু আপনি গাড়ি চালাতে জানেন। করাচী এক নিষ্ঠুর নগরী। কিন্তু একদম নির্দয় নয়। এই নগরীতে ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা না থাকলেও আছে অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস। গাড়ি চালক হিসেবে আপনি যত খারাপই হোন, দেশের যে জায়গা থেকেই আসুন না কেন, বিশ হাজার রূপী বেতনের একটা চাকুরি পাওয়া কঠিন নয়।
আপনার জন্ম এখানে, বেড়ে উঠেছেন এখানে। আপনি এই নগরীর রাস্তাঘাট চেনেন, প্রতিটি অলি-গলি আপনার নখদর্পনে। কিন্তু ড্রাইভারের চাকুরি পেতে তো একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স দরকার। আর এই ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে দরকার একটা জাতীয় পরিচয়পত্র।

আপনার পিতার সেই জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল। কিন্তু আপনার কোন পরিচয়পত্র নেই। কাজেই আপনি আর করাচীতে একজন গাড়িচালক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন না।

ধরা যাক আপনি চার সন্তানের মা। সন্তানদের মাথার ওপর একটা ছাদ আর খাবার জোগানোর জন্য আপনাকে একজন শেঠের বাড়িতে ঝাড়ু দিতে হয়, ঘর পরিস্কার করতে হয়। আপনার গৃহকর্তা শেঠ বেশ দয়ালু। আপনাকে একবেলা খেতে দেয়, দৈনিক মাত্র দশ ঘন্টা আপনাকে কাজ করতে হয়। রোববার আপনি ছুটি পান। তবে বেতন একটু কম দেয়, এই যা।

নিজের পাড়ার অন্যদের কাছে হয়তো শুনেছেন এক সরকারি কর্মসূচির কথা (বেনজির ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম)। আপনার মতো কমর্জীবী নারীরা কয়েক হাজার রূপী ভাতা পায়। এটা কি সত্যি নাকি ভুয়া আপনি ঠিক জানেন না। কিন্তু আপনার অনেক সহকর্মী এরকম কয়েক হাজার রূপীর ভাতা পায় প্রতি মাসে। সেই অর্থ দিয়ে তারা বাচ্চার জন্য জুতা কিনতে পারে কিংবা মাসে একবার মাংস খেতে পারে ভালোভাবে।

কিন্তু এই কয়েক হাজার রূপীর ভাতা আপনার কপালে নেই, কারণ আপনি বাঙালি। আর আপনার কোন পরিচয়পত্র নেই।



করাচীর অনেক বাঙালি এখনও বাংলা বলতে পারেন, কিন্তু লিখতে বা পড়তে পারেন না


এই দেশের এক মর্মান্তিক ইতিহাস হয়তো আপনিও শুনেছেন। আপনার জন্মের আগের ঘটনা সেটি। বাঙালিরা একটা দেশের জন্য লড়াই করেছিল। কিন্তু সেই বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, আপনার বাবা তখন পাকিস্তানি। তিনি তখন এই করাচীতে কাঁকড়া ধরতেন।

ধরা যাক, আপনি একজন বাঙালি। করাচীতে থাকেন। কেউ কৌতুহলবশত আপনার কাছে জানতে চাইলো, কত বাংলাদেশি এখানে থাকে। উত্তরটা আপনার জানা নেই.... বিশ লাখ? তিরিশ লাখ? আদমশুমারি যারা করে, যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষ গোনে, তারাও আপনাদের ভুলে গেছে। তারা মনেই করতে পারে না যে আপনি সেই বাঙালি নন, যারা আশির দশকে কাজের খোঁজে ভারত হয়ে এখানে এসেছিল। বাংলাদেশ যেহেতু এখন অনেক বেশি উন্নত, আমাদের শেঠ হয়তো করাচীতে থাকেন, কিন্তু তার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি এখন ঢাকার উপকন্ঠে করমুক্ত অঞ্চলে।

ধরা যাক আপনি করাচীতে থাকা এক বাঙালি। আপনি একবারই স্বপ্ন দেখেছিলেন। ইমরান খান করাচীতে এসেছিলেন এবং এক বড় জনসভায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আপনার মতো বাঙালিদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। ইমরান খান হয়তো পাকিস্তানিদের কাছে জনপ্রিয়। কিন্তু আপনাদের কাছ থেকে ইমরান খান যে ভালোবাসা পেয়েছিলেন, অন্তর থেকে যে প্রার্থনা আপনারা তার জন্য করেছেন, সেরকমটি ইমরান খান এর আগে কারও কাছ থেকে পাননি।

ইমরান খানের ওপর থেকে করাচীর বাঙালিরা তাদের আশা এখনো ছাড়েননি। তবে তাদের ভয়ও আছে। পুরোনো উপদেষ্টারা, পুরোনো মন্ত্রীরা যে পরামর্শ আগেও দিয়েছেন, সেটাই হয়তো তারা আবার ইমরান খানকেও দেবেন। এই বাঙালিরা কী করতে পারবে? সামনে তো সমূদ্র আছে।

কারও মনে হয়তো ক্ষীণ আশা, ইমরান খান কোন একদিন এই মাচার কলোনিতে (মশক কলোনি) আসবেন। সামনে সমূদ্র আছে বলে যে খোঁড়া যুক্তি সেটা নিজের চোখে দেখবেন। এই সাগর আমরা আবর্জনা ফেলে ফেলে ভরাট করেছি আর তার ওপর আমরা আমাদের বাড়িঘর বানিয়েছি।

ধরা যাক আপনি একজন বাঙালি। আপনার যে মেয়েটি ক্লাসে প্রথম হতো- ডাক্তার, পাইলট বা মার্ক জাকারবার্গ হওয়ার স্বপ্ন দেখতো, এখন সে ঘরে বসে থাকে। তাকে বিয়ে দিতে হবে। মেয়েটি কিন্তু বেশ শক্ত, দশম শ্রেণীতে যে সে পড়তে পারেনি, সেই বেদনা সে ভুলে যায়নি, কিন্তু সেটা কখনো মুখে বলে না।

মেয়েটির বিয়ের কথা-বার্তা চলছে, আজকে তাকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। অতিথিদের সামনে গিয়ে তাকে চা পরিবেশন করতে হবে।

প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পর পাত্রপক্ষ সেই কথাটাই জানতে চাইবে, মেয়েটির কী পরিচয়পত্র আছে?

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়