Ameen Qudir
Published:2020-02-25 20:59:49 BdST
সত্য ঘটনা অবলম্বনেএকটি প্রতারিত মেয়ে, এক প্রতারক তরুণ ও এক হৃদয়বান ছেলের সত্য কাহিনি
ডাঃ জোবায়ের আহমেদ
__________________________
মেয়েটি তখন ক্লাস টেনে পড়তো।
কিশোরী মনের চঞ্চলতায় চারদিক মাতিয়ে রাখে হাসিমুখ দিয়ে।
সবার মধ্যমনি সে।
বান্ধবীরা তাকে ছাড়া প্রায় অচল।
সেই মেয়েটি একদিন এস এস সি পাশ করে কলেজে যাওয়া শুরু করেছে।
কলেজে এসে হৃদয়ের আকাশে উঁকি দিলো প্রেম।
ছেলেটি পাশের গ্রামের।
মেয়েটি জানতো ছেলেটি দেশের একটা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
বাকপটু ছেলেটি মেয়েটিকে কথায় জাদুতে দূর্বল করে ফেলে।
প্রেম ঠিক অন্ধ না।
প্রেম চোখে শুধু প্রেম ই দেখে।
বিচার বিশ্লেষণ, ঠিক বেঠিক, অনুচিত উচিত এর দরজা মাড়াতে চায়না অন্ধ প্রেম।
মেয়েটি একদিন ছেলেটির হাত ধরে বাড়ি পালালো।
বাড়ি পালিয়ে ছেলেটির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রেমের চূড়ান্ত পরিনতি ঘটালো।
তারপর টোনাটুনির সংসার।
এক রুমের সাবলেট এ চড়াইভাতি খাওয়া জীবন।
প্রেমের আবেশে মেয়েটি আবেশায়িত।
মন্দ কাটছিলো না।
ভালবেসে ভালবাসার মানুষের বুকে ঠাঁই পেতে সে যে কাজ করে এসেছে তা তাকে সাহসী তরুণীর খেতাব এনে দিলো প্রিয়তম এর কাছ থেকে।।
মেয়েটি ভুলে গিয়েছিলো তার মা কেও।
মায়ের ন্যাওটা ছিলো সে।
মা বুড়ো দামড়ি মেয়েকে লোকমা দিয়ে খাইয়ে দিতো।
ছোট সন্তান আবার মেয়ে তাই বাবার আদরের সমুদ্রে সে হাবুডুবু খাওয়া মেয়ের বাবার চেহারাও মনে পড়তো না।
এভাবে গেলো তিন মাস।
তারপর একদিন সকালে বমি হলো খুব।
মাথা কেমন ঘুরাচ্ছে।
ছেলেটি মেয়েটিকে একজন চিকিৎসক এর কাছে নিয়ে গেলো।
ডাক্তার মেয়েটির শরীরে আরেকজন মানুষ এর অস্তিত্বের ঘোষণা দিলো।
মা হবার খবরে মেয়েটির আনন্দ -অশ্রু বয়ে গেলো গাল বেয়ে।
ছেলেটিকে বিচলিত দেখা গেলো।
আস্তে আস্তে মেয়েটি প্রেমের আবেশ কাটিয়ে বাস্তবে ফিরতে শুরু করলো।
ছেলেটির আচরণে পরিবর্তন দেখতে পেলো।
মা এর কথা মনে পড়লো।
একদিন ছেলেটি ক্লাস থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।
এই বয়সে বাবা হওয়া উচ্ছ্বাস এর চেয়ে দায়িত্ববোধের চাপে তার চেহারার মলিনতা চোখে পড়ার মত।
ছেলেটি ঘুমোচ্ছে নাক ডেকে।
মেয়েটি আজ সন্ধ্যায় কি রান্না করবে ভেবে ছেলেটার প্যান্টের পকেটে হাত দিলো টাকার জন্য।
বেরিয়ে এলো একটা আইডি কার্ড।
ছেলেটি একটা পলিটেকনিকে পড়ে।
ছেলেটি মিথ্যা বলেছিলো।
এই মিথ্যা টা মেয়েটিকে নাড়া দিলো।
তারপর বেরিয়ে এলো আরো মিথ্যা।
মেয়েটি নিজেকে প্রতারিত ভাবলো।
মেয়েটি ভেবেছিলো ছেলেটি খুবই মেধাবী,একদিন বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে।
এত বড় নামকরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে ভেবে তার তরুণী মন গর্ব অনুভব হতো।।
সারারাত কাঁদলো মেয়েটি।
তার ভুল বুঝতে পারলো।
এদিকে পেটের ভেতর যিনি বেড়ে উঠছেন তার বয়স তখন চার মাস।।
দিশেহারা সে।
যাকে ভালবেসে ঘর ছেড়েছে, সে প্রেমিক আজ প্রতারক ও মিথ্যুক রুপে তার সামনে দাঁড়ানো।
মেয়েটি সপ্তাহ খানেক নিজের সাথে বোঝাপড়া করলো।
মেয়েটি বাচ্চার কথা ভেবে সংসার করতে চাইলো।
কিন্ত ছেলেটির আসল রুপ প্রকাশিত হবার পর মেয়েটির উপর নেমে আসে অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
সেই নির্যাতন এতই তীব্র হতে লাগলো যে, মেয়েটি সব মায়া ছিন্ন করতে বাধ্য হলো।
তারপর একদিন ভোরের আলো আঁধারিতে টোনাটুনির মিথ্যা ভিতের উপর দাঁড়ানো সংসার কে বিদায় জানিয়ে বাড়ি ফিরলো।
মা সন্তানের শেষ আশ্রয়।
যত অপরাধ ই করুক, মা সন্তানকে তাড়িয়ে দিতে পারেন না।
অপরাধী সন্তানকেও মা জড়িয়ে নেন মায়ার চাদরে।
বাবার বাড়ি এসে নানাজনের নানা কটুকথায় তার মন বিষিয়ে উঠলো।
ভেতরে আরেকজন বড় হচ্ছে দ্রুত।
সবাই বললো, বাচ্চা এবরশান করে ফেলতে।
সেও যে তরুণী মা।
তার বাচ্চার হন্তারক হতে পারলো না।
একদিন মেয়েটি মা হলো।
কোল জুড়ে ফুটফুটে ছেলে সন্তান আসলো।
নিস্পাপ শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে অনেক কাঁদলো মেয়েটি।
বাড়ি ফিরেই মেয়েটি ছেলেটিকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিলো।
তার ভালবাসা ও বিশ্বাস এর অমর্যাদা যে করেছেন,তাকে সে ঘৃণা করতে লাগলো।
ছেলেটিও আর সাহস পেলো না মেয়েটির সাথে যোগাযোগ এর।।
এবার জীবনের আরেক অধ্যায়।
সিঙ্গেল মা হিসেবে আরেকটা যুদ্ধ মেয়েটির।
কত রাত গেলো নির্ঘুম।
কত জ্যোস্না দেখা হলো না।
চোখের নীচে কালি জমেছে মেয়েটির।
আস্তে আস্তে মেয়েটির ছেলে বড় হতে লাগলো।
মেয়েটি আবার কলেজ গেলো।
বি এ পাশ করে ফেললো।
মা ছেলের খুনসুটি দেখে নানী অশ্রুভেজা মুখ শাড়ির আঁচলে লুকান।
একদিন মেয়েটির স্কুলের সহপাঠী তাকে ফোন দেয়।
সহমর্মিতা জানায়।
বন্ধুত্বের অধিকারে তার যেকোন প্রয়োজনে পাশে থাকার প্রত্যয় জানায়।
কথা থেকে বন্ধুত্ব।
চেনা সহপাঠীর সাথে আলাপের গভীরতা বাড়তে থাকলো।
মেয়েটির ছেলের বয়স তখন ৮ বছর।
ছেলেটি একদিন পড়ন্ত বিকেলে মায়াভরা কন্ঠে তার আকুলতা জানায়।
ছেলেটি মেয়েটির হাত আজীবন এর জন্য ধরতে চায়।
তার বাচ্চা সহ তাকে আগলে রাখতে চায়।
ছেলের বন্ধুমহল শুনে নাক সিটকালো।
ছেলেটির ভিমরতি হয়েছে বলে সবাই ধিক্কার দিলো।
এই সমাজ একজন বিবাহিত পুরুষের অবিবাহিত নারীকে বিয়া করাকে দোষের না দেখলেও একজন অবিবাহিত পুরুষের একজন ডিভোর্সী ও ৮ বছর বয়সী বাচ্চা সহ বিয়ে করাকে ভালো চোখে দেখেনা।।
কিন্ত এই ছেলেটি অন্য রকম।
সে সমাজের রাঙা চোখে ভয় পায়না।
তার ব্যক্তিত্ব অনন্য।
ভালবাসাই মুখ্য তার কাছে।
কার মাঝে খুঁত না আছে।
তারপর একদিন ছেলেটি তার পরিবারকে রাজি করিয়ে
শেড়োয়ানি ও পাগড়ী পড়ে বর যাত্রী সহ চললো মেয়েটির বাড়ির দিকে।
মেয়েটি বসে আছে লাল শাড়ি পড়ে।
পাশে খেলা করছে তার ৮ বছর বয়সী ছেলেটি।
মেয়েটি হাত রাখলো আবার নতুন করে নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে একজন মানবিক ও বড় হৃদয়ের প্রেমিক পুরুষের হাতে।
ছেলেটি দুইটি হাত ধরলো একসাথে।
মেয়েটির হাত ও তার সন্তানের হাত।
বিয়ে করেই সে বাবা হয়ে গেলো স্বামী হবার সাথে সাথে।
তারপর তাদের সুখের জীবন।
আমি প্রায়শই তাদের তিনজনের ছবিটা দেখি।
মায়া লাগে খুব।।
ভালবাসার অদম্য শক্তির কাছে কিভাবে পরাজিত হয়ে যায় সামাজিক ট্যাবু ও "মানুষ কি বলবে" মনোভাব তা দেখে প্রশান্ত হই।।
মানুষ কি বলবে এটা ভেবে অনেক মানুষ প্রকৃত ভালবাসাকে ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দেয়।
যখন বুঝে তখন বেলা অনেক হয়ে যায়।
এই ছেলেটি সেই ভুল করেনি।
মানুষ ও সমাজের কথা না শুনে যারা হৃদয়ের গহীনের কথা শুনেন তাদেরকেই হৃদয়বান বলা হয়।।
এই ছেলেটি আমাদের সমাজের সাহসী হৃদয়বান।
#
আপনার মতামত দিন: