Ameen Qudir

Published:
2020-02-23 06:53:29 BdST

ছোট গল্পশাহানা আজ ভোরবেলা হতে'লাশ' :মৃত্যু এবং তারপর



ডা. নাহিদ ফারজানা
_____________________________

চারদিকে ঘুরে ফিরে একটাই শব্দ... লাশ।
"লাশের গোসল দিতে এতো দেরি করছেন কেন?"
"এতো কান্নাকাটি করেন না,লাশ কষ্ট পাচ্ছে। "
"লাশের দাফন কোথায় হবে,ঠিক করেছেন?"

যখন অাপন চাচাও বললেন,"দেরি করা ঠিক হবেনা,লাশ পচা শুরু করবে", তখন অরু অার পারলো না। চিৎকার করে কেঁদে বললো,"কেন অামার মা'কে লাশ বলছেন অাপনারা?উনি অামার মা। অাপনাদের খালা,ফুপু,মামী,চাচী। কারোর অাপা,কারোর ভাবী। তাহলে লাশ বলে ডাকছেন কেন?"

শাহানা অাজ ভোরবেলা হতে "লাশ।" দিব্যি ভালো মানুষটার হার্ট অ্যাটাকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু। কি অাশ্চর্য! কি অাশ্চর্য!

অাব্বা যখন মারা যান,অরু তখন শিশু। ঘর ভরা অাত্মীয়-স্বজন দেখে তার বিপুল অানন্দ হয়েছিল। অাব্বা শুয়ে অাছেন,ঘুম ভাঙলে বাইরে যাবেন,একসময় ঘরে ফিরবেন,খাবেন-দাবেন,অরুকে কোলে নিবেন,এটাই ছিলো তার বিশ্বাস। সবাই কেন কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে অাব্বা ঘুমিয়ে থাকার জন্য, এটা তার বোধগম্য হচ্ছিলো না। সে তার সমবয়সী মামাতো-চাচাতো ভাই বোনদের সাথে অানন্দে মত্ত ছিল। এই সময়ে মিজান চাচা,মনি মামী, শানু চাচী,রোজি বুবুদের অাহাজারি-গড়াগড়ি অার কিছু কাজকর্মে অরু দারুণ অবাক হয়,অার নিদারুণ ব্যথা পায়। ওরা অরুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে যা বলছিল তার মর্মার্থ হলো,কি হবে এই মাসুম বাচ্চার?কি হবে ওর বড় তিন ভাই -বোনের?মা তো অল্পবয়সী, তার উপর রঙিলা কিসিমের,দুূদিন পরেই অাবার বিয়ে বসবে,তখন এই মাসুম বাচ্চাগুলোর কি গতি হবে?এই পাষাণী মেয়ে বুঝতেও পারছেনা কি সর্বনাশ হয়ে গেলো তার।

অজানা ভয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে পাড়া মাথায় তুলেছিল অরু। অাত্মীয়রা শিশুর কান্নায় তৃপ্ত। মরা বাড়িতে একটা দলই থাকে অাপনজনদের চোখের পানি পরিমাপ করার জন্য। তারা নিজেরাও কাঁদে, কান্নার মধ্যে তাদের চোখ দুটো ক্রমাগত এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকে, কান দুটো খরগোশের মতো খাড়া থাকে কে কি বললো,কে কতজোরে কাঁদলো তা শোনার জন্য। মন অার মস্তিষ্কও যদি একটু সক্রিয় অার সংবেদনশীল হতো!

মা'কে গোসল করাতে নিয়ে গেছে চাচী,খালারা। সেই একই কথা।

"লাশের নাকফুল, চেইন,দুল,চুড়ি কিছুইতো খোলা হয়নি।"

"দেন,অামার হাতে দেন।" বড় ভাবী হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে অাসে।

"তোমার হাতে কেন? বড় চাচী অাম্মার হাতে দিই। উনি পরে ভাগ করে দেবেন।"

ভাগ! মা এখনো মাটির উপরে,এখনই ভাগ?

"এতো জোরে ডলা দিওনা,লাশ ব্যথা পায়।"

অরু গতকালের কথা ভাবে। মা কাল এই সময়েই গোসল সেরে বের হয়েছিল লাক্স সাবানের সুবাস ছড়িয়ে, মাথায় টাওয়েল বেঁধে। মা তারপরে পাটভাঙা সূতি শাড়ি পড়েছিল.....

কাফন পরানো হচ্ছে মা'কে। অরু অাবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মা গোসল সেরে তাড়াহুড়া করে মুখে ক্রিম দিতো,গায়ে লোশন,ঠোঁটে ভেসলিন। নইলে মায়ের গা চড়চড় করতো। ভেজা চুল না শুকানো পর্যন্ত মায়ের চরম অশান্তি, তাই গোসল সেরেই টেবিল ফ্যানের পাশে চুল এলিয়ে বসা। অাজ ভেজা চুলেই কাফনের কাপড়, সাবান ধোয়া গায়ে ক্রিম লোশনের বালাইটুকু নেই। মায়ের কি অস্বস্তি হচ্ছে খুব?

"মা গো..."

"চুপ মাইয়া,চিল্লায় না, লাসের কস্ট হয়।"

মা এখন সবার কাছে একটা লাশ। মায়ের অার কোন পরিচয় নেই।

অাসরের অাজান শুরু হতেই ওরা মা'কে নিয়ে গেল। এতো অাচমকা, এতো দ্রুত! অরু খাটিয়ার পা জড়িয়ে ধরলো। তারপরে অার কিছু মনে নেই।

রাতে অাপার পাশে শুয়ে অরু বড় অার ছোট ভাবির কথোপকথন শুনতে পেলো। দুজনেরই ভয় লাগছে। গা ছমছম করছে। বাথরুমে যেতে পারছে না।

হায়রে ভাবিরা! ভয় পাচ্ছ মরা শাশুড়িকে যে কিনা নিজেই তোমাদের ভয়ে অস্থির থাকতো। কিসে তোমাদের বাচ্চাদের অযত্ন হয়, কোন্ কথায় তোমাদের বদনগুলো মলিন হয়ে যায়, কোন্ কথাগুলো ভাইদের কানে অন্য রকম ভাবে ঢুকানো হয় অার ভাইদের মুখগুলোও তখন ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে উঠে, সেসব টেনশনে যে শাশুড়ি চিন্তায় অধীর হয়ে থাকতো, তার ভয়ে তোমাদের অাজ হাত-পা বরফ হওয়ার যোগাড়!

"অামাকে একটু দেখা দাও,মা।একবার। একবার হলেও দেখা দাও,মাগো।" অরু ডুকরে কেঁদে উঠলো। কেঁদে উঠলো অাপাও।

রাতে পাশের বাসার মলিরা খাবার দিয়ে গেল। এই এতো মানুষের। সকালে দেবে পলাশরা। অরু নিষেধ করলো এবং শুনলো,মরা বাড়িতে অন্তত তিন দিন চুলা ধরাতে নেই।

মা'কে ভাবি-ভাইঝি অার কিছু অাত্মীয়ের খুব ভয় লাগলেও মায়ের শাড়ি-গয়নাকে কারো ভয় লাগছে না। মা'র তিরিশ ভরি সোনার গয়না নিয়ে রীতিমতো ঠান্ডা লড়াই হয়ে গেল দুই ভাবির মধ্যে। বড় ভাবি বললেন,"মা নওরীনকে এতো ভালোবাসতেন! নওরীনও একটা ভাগ পাবে।" ছোট ভাবি বললেন,"অাপনি অাপনার ভাগ থেকে নওরীনকে দিবেন। ওর জন্য অালাদা ভাগ কেন? গয়না সমান চারভাগে ভাগ হবে, দুই মেয়ে-দুই বৌ এর মধ্যে। "

সেজ খালা ভারি ঠোঁট কাটা। তিনি ফস করে বলে উঠলেন,"পরের ঘরের মেয়েরা, ভালোবাসার সময় শাশুড়ি নাই, সুনামের বেলায় শাশুড়ি নাই, শুধু নিন্দা অার শাড়ি-গয়নার সময় শাশুড়ি।" মায়ের মরার দুদিন।তাও ভালো রকম ঝগড়াঝাটি হয়ে গেলো।

চল্লিশ দিন পার হবে বলে বিশাল অায়োজন। অতি শান্ত অরু প্রথম তার মতামত জানালো। এতিমখানায় খাওয়ানো হোক, কোন বাস্তুহারাকে ঘর বানিয়ে দেওয়া হোক, কোন অতি দরিদ্রকে দোকান বানিয়ে দেওয়া হোক, কিন্তু অাত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে ডেকে পোলাও -কোর্মা খাওয়ানো যাবে না। মায়ের চলে যাওয়া কোন অানন্দদায়ক উপলক্ষ না।

"তাই হয় নাকি?এটা একটা কালচার। আত্মীয়-স্বজনরা কি মনে করবে? সমালোচনা তোদের হবেনা,হবে অামাদের ভাইদের। "

অতএব হলো।বিশাল পরিসরে হলো। দুশো স্বচ্ছল মানুষকে দাওয়াত খাওয়ানো হলো মায়ের চিরপ্রস্থান উপলক্ষে। খাসির বিরিয়ানি, মুরগীর রোষ্ট, টিকিয়া,জর্দা,বোরহানি দিয়ে অাপ্যায়ন করা হলো সবাইকে কমিউনিটি সেন্টারে। মহিলারা অনেকেই সুরুচি অার অাভিজাত্যের পরিচয় দিলেন সাজসজ্জায়। জায়গা বুঝে ড্রেস অাপ,মেক অাপ করতে হয়। সাদা জামদানি, সাদার মাঝে কালো বুটি দেওয়া জামদানি, অফ হোয়াইট দামি সিল্ক, মুক্তোর হালকা গয়না পরলেন অধিকাংশ মহিলা।

নওরীন এসে বললো,"ফুপি, চল্লিশ দিন হলে নাকি অাত্মা পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়? যদি ব্যাপারটা সত্যি হয়,তাহলে তো অাজ দীদার এই প্ল্যানেটে লাস্ট ডে?"

অরুর চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। দেখা দিলেনা তবে!
বিদায় মা,চির বিদায়।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়