Ameen Qudir

Published:
2020-02-19 04:53:15 BdST

জার্মানির চিকিৎসা ব্যবস্থাঃ একজন জার্মান প্রবাসীর অভিজ্ঞতা


জার্মানি-প্রবাসী জামান এর লেখা
______________________________________

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলির কারণে অনেকেই জার্মানির চিকিৎসাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক তুলে ধরছেন। আবার অনেকেই বাস্তবিক অবস্থা জানতে চাচ্ছেন। আসলে জার্মানির চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে এক কথায় কিছু বলা যাবেনা। একেক জনের অভিজ্ঞতা একেক রকম। এর মধ্যে বেশীরভাগের মতে জার্মানির চিকিৎসাব্যবস্থা নিম্নমানের। সত্য বলতে তাদের চিকিৎসাব্যবস্থার কাঠামো এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির দিক দিয়ে বিবেচনা করলে জার্মানি বিশ্বে সেরাদের মধ্যে উপরের দিকেই থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ডাক্তারদের যোগ্যতা এবং তাদের সিরিয়াসনেস নিয়ে। এই সম্পর্কে বেশি কিছু না বলায় ভাল। এখানে অনেকেই আছে জার্মানির সবকিছুই পজিটিভ হিসেবে দেখেন, কেউ আবার সবকিছুকে নেগেটিভ ভাবে দেখেন। আমি আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো।
তখন সবেমাত্র আমি জার্মানিতে নতুন এসেছি। আমার নাকে একটু সমস্যা দেখা দিল। গেলাম এক ডাক্তারের কাছে। উনি ইংলিশে কথা বলবেননা। আমাকে বললেন ট্রান্সলেটর নিয়ে যেতে। ট্রান্সলেটর নিয়ে যাওয়ার কথাটা ঠিকই খুব সুন্দর করে ইংলিশে বললেন। মনে হল উনি ইংলিশ পারেন কিন্তু ইংলিশে কথা বলতে আগ্রহী না। এরপর গেলাম আরেক ডাক্তারের কাছে। উনি ইংলিশে কথা বললেন। অনেকগুলো টেস্ট দিলেন। টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে গেলাম। বললেন অপারেশন লাগবে। উনি আমাকে ক্লিনিকে পাঠালেন। ক্লিনিকে গিয়ে বসে রইলাম কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা। এরপর আমার ডাক আসলো। ঢুঁকে যখন ইংলিশে কথা বলা শুরু করলাম ডাক্তার একটু রাগী কন্ঠেই বললেন ট্রান্সলেটর নিয়ে আবার যেতে। আমার পুরো দিনটিই মাটি। এরপর গেলাম এক ভাইকে নিয়ে। একই ডাক্তার ছিলেন। জাস্ট প্রথম কয়েকটি ইনিশিয়াল কথা ডয়েচে বললেন। এরপর ঠিকই ইংলিশে সবকিছু বললেন। বুঝলামনা কেন উনি ঐদিন আমাকে ফিরিয়ে দিলেন, আর কেনই বা ট্রান্সলেটর নিয়ে যেতে বললেন! যাহোক উনি তিনমাস পর আমাকে অপারেশনের দিন নির্ধারন করে দিলেন। সবার কাছে বিদায় নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। জীবনে প্রথম অপারেশন, তাও ভিন্ন একটি দেশে। একাই যেতে হয়েছিল। সবাই ব্যস্ত। একজন ভাইকেও সেদিন পাইনি যিনি আমার সাথে যাবেন, আমাকে সাহস দিবেন, সমস্যা হলে সাহায্য করবেন। সেই দিনটির কথা মনে হলে একটু কষ্টই লাগে। যাহোক, যাওয়ার পর সারাদিন বসে থাকলাম। বিকাল বেলা বলা হল আমার ফাইলটি কমপ্লিট না। আরো এক সপ্তাহ পর সময় দিয়ে আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। এক সপ্তাহ পর একই ভাবে একাই গেলাম। সারাদিন বসিয়ে রেখে বিকাল বেলা আমার ডাক পড়লো। মেকআপ করিয়ে, নতুন কাপড় পড়িয়ে নেওয়া হল অপারেশন থিয়েটারে। অপারেশনে নিয়োজিত সকল ডাক্তার এবং নার্সরা এসে পরিচয় দিল, হ্যান্ডশেক করলো। একজন ডাক্তার বললেন আমাকে এখন ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হবে এবং বললেন আমি নাকি খুব ভাল ভাল স্বপ্ন দেখবো। কথাগুলো বলছেন আর ইনজেকশন পুশ করছেন। সব ডাক্তার নার্সরা হাত নাড়িয়ে বিদায় দিতে দিতে আমি ঘুমের রাজ্যে চলে গেলাম। আর হ্যাঁ, উনারা সবাই ঐদিন ইংলিশে কথা বললেন।
জ্ঞান ফিরার পর খুবই পেইন হচ্ছিল। সমস্যা ছিল নাকের। অপারেশন করেছে টনসিলের। ব্যাপারটা খটকা লাগলেও আমি ভেবেছি যেহেতু এটি জার্মানি তাই ডাক্তাররা অবশ্যই জেনশুনেই সব করছেন। যাহোক, অপারেশনের কারনে মারাত্মক ব্যথা হচ্ছিল, কথা বলতে পারছিলামনা। নার্সকে ইশারায় বুঝালাম পেইনের কথা, কিছুই বুঝলোনা। অনেক কষ্টে মুখ থেকে পেইন শব্দটা বের করলাম। সে তাও বুঝতে পারলোনা। একটা কম বয়স্ক নার্সকে নিয়ে আসলো। সে বুঝতে পারলো আমার পেইন হচ্ছে। একটা বরফের প্যাকেট দিয়ে বলল এইটা গলায় দিয়ে রাখতে। দিলাম, অল্প কাজ হল। সারাদিন কিছুই না খাওয়াতে রাতের বেলায় খুব ক্ষুদা পেয়েছিল। আমি হাসপাতালের দেওয়া খাবার মিস করেছি কারন তখনও আমি আইসিইউতে ছিলাম। একবার সিরিয়াল মিস করলে তারা আর সেই বেলা খাবার দিবেনা। যেহেতু সব পরিচিত ভাইয়েরা ব্যস্ত ছিল তাই উনারা আমাকে দেখতে আসতে পারেননি। মাঝরাতে প্রচণ্ড ব্যথায় কাৎরাচ্ছিলাম। একটা সময় মারাত্মক বমি হল। আমি ইমার্জেন্সি বাটনে ক্লিক করলে নার্স আসেন। এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার বমি করা দেখলেন। বললাম পেইনের কথা। ইংলিশ পারেননা। উনি একাই নাইটশিফট করছেন ঐ ফ্লোরে। বরফের প্যাকেট দেখালাম। উনি ভাবলেন আমি আরো বরফ চাচ্ছি। আরো ৩টা বরফের প্যাকেট এনে দিলেন। কিছুই করার ছিলনা। পরদিন সকালে নাস্তা আর মেডিসিন পেলাম। মেডিসিন বলতে জাস্ট একটা পেইন কিলার। আর যে খাবার দিয়েছে সেটা আমার মত গলার অপারেশনের রুগীর খাওয়ার মত না। বললাম আমি তো এগুলো খেতে পারবোনা। তারা বলল আমি মেন্যু সিলেক্ট না করাতে তাদের ইচ্ছামত দিয়ে গিয়েছে। এখন আর চেঞ্জ করা সম্ভব না। বিকালের খাবারের আগে মেন্যু সিলেক্ট করতে বললেন। আমি জানিনা জার্মান। কি সব লিখে রেখেছে কিছুই বুঝতে পারিনি। ওরা ইংলিশেও বলতে পারলোনা। আন্দাজের উপর সিলেক্ট করে যা অর্ডার করিছি সেটার অবস্থা সকালের চেয়েও খারাপ। পরদিন রাতের বেলায় আমাকে ৩ জন ভাই দেখতে গেলেন। উনারা অনেক কিছু কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার ৪ জন রুমমেটদের মধ্য থেকে ২ জন ভাই একদিন এসেছিলেন দেখতে। এরমধ্যে এক ভাইকে বলেছিলাম সম্ভব হলে নরম খাবার কিনে দিয়ে যেতে। কিন্তু উনার পড়াশুনা+জবের ব্যস্তটার কারণে অনেক চেষ্টা করেও সময় করতে পারেননি। আরেক ভাই রাত ৮ টার পর এসেছিলেন খাবার নিয়ে। কিন্তু উনাকে হাসপাতালের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাই আমাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি উনার।
এক সপ্তাহ পর হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলাম। ঠিকমত খেতে না পেরে শরীর খুব দুর্বল ছিল। সব জিনিসপত্র নিয়ে একাই গেলাম বাসায় অনেক কষ্টে। কারণ কাউকে ফোন দেওয়ার সাহস হয়নি। বাসায় গিয়ে দেখলাম রুমমেট পড়াশুনা করছে। উনাকে ডিস্টার্ব না করে নিজেই রান্না করলাম নিজের মত করে। খাওয়ার পর কিছুটা সুস্থ্ অনুভব করলাম।
মনে করলাম নাকের সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ঘোড়ার ডিম কিছুই হলনা। গেলাম ডাক্তারের কাছে। উনি কি যে আবোল তাবোল মেডিকেল টার্ম বললেন কিছুই বুঝলামনা। এরপর কয়েক মাস পর গেলাম আরেক ডাক্তারের কাছে। উনাকে অপারেশনের কথা বললাম। উনি ঠিক বুঝতে পারলেননা নাকের সমস্যার কারণে টনসিল রিমুভ করলেন কেন। কিন্তু এরা আবার এক নীতিতে বিশ্বাসী।
________________________
লেখা জার্মান প্রবাসী জামান এর ওয়াল থেকে নেয়া।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়